বেজে গিয়েছে ডার্বির দামামা। তাই সারা বাংলা এখন দু’ভাগে বিভক্ত। এক ভাগের রঙ লাল-হলুদ ও আর এক ভাগের রঙ সবুজ-মেরুন। ছুটির রাতে দু’পক্ষই হয়তো পাশাপাশি বসে দেখবে ডার্বির যুদ্ধ। কিন্তু খেলার শেষে একদলকে হাসতে দেখা যাবে ও আর এক পক্ষ ডুবে যাবে হতাশার কালো আঁধারে। কিন্তু সে নেহাতই সাময়িক। সব আনন্দ-হতাশার পর দুই পক্ষই ফের পরবর্তী ডার্বির জন্য কোমর বাঁধা শুরু করবে। এর নামই ‘বড় ম্যাচ’।  

রবিবার রাতে কাদের মুখে জয়ের হাসি দেখা যাবে, সে তো সময়ই বলবে। কিন্তু চলতি ইন্ডিয়ান সুপার লিগ এমনই এক আকর্ষণীয় পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়ে যে, ফিরতি ডার্বিতে নামার আগেই প্লে অফে জায়গা পাকা করে ফেলল মোহনবাগান এসজি। শনিবার রাতে হায়দরাবাদ এফসি-র প্রথম জয়ের ফলে টানা চতুর্থবার প্লে অফে খেলার যোগ্যতা অর্জন করল সবুজ-মেরুন বাহিনী। এ দিন চেন্নাইন এফসি-কে ১-০-য় হারানোর ফলে লিগ টেবলের যা অবস্থা দাঁড়াল, তাতে লিগ টেবলে পাঁচ থেকে ১১ নম্বর দলের পক্ষে আর মোহনবাগানকে ছোঁয়া সম্ভব নয়।  

শনিবারের এই ম্যাচের আগে পরিস্থিতিটা ছিল অন্যরকম, ডার্বিতে ড্র হলে লিগের প্লে অফে তাদের জায়গা পাকা করে ফেলত সবুজ-মেরুন বাহিনী। এখন আর সেই তাগিদও রইল না তাদের। সামনে শুধু লিগশিল্ড, রবিবার ড্র হলে যে এই স্বপ্ন কিছুটা হলেও ধাক্কা খেতে পারে, এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তাই লিগ টেবলের শীর্ষস্থান দখলের জন্য আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের দলের কাছে এই ম্যাচে জয় অবশ্যই দরকার।    

ড্র হলে ইস্টবেঙ্গলের প্লে অফের রাস্তা কার্যত সেখানেই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু তিন পয়েন্ট পেলে তারা সেই রাস্তায় থাকবে। যদিও আশেপাশের দলগুলি কেমন কী করছে, সে দিকেও তাকিয়ে থাকতে হবে তাদের। অর্থাৎ, রবিবারের ডার্বি কার্লস কুয়াদ্রাতের দলের কাছে কার্যত আইএসএলের ফাইনালের মতো। হারা চলবে না কিছুতেই। অর্থাৎ, রবিবার রাতে আবহাওয়ায় উত্তাপ কমলেও যুবভারতীর পরিবেশে ফুটবলের উত্তাপ বোধহয় কমবে না।

ফের এক ঘটনাবহুল ডার্বি?

কে না জানে, কলকাতা ডার্বি মানেই সারা দুনিয়ার বাঙালিদের কাছে মান-ইজ্জতের লড়াই। সেই লড়াইতে কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জমিও ছাড়তে রাজি থাকেনি কোনও দিন, কখনও থাকবেও না। কারও ভোলার কথা নয় মাস খানেক আগের সেই ডার্বির কথা।

ফুটবলের যুদ্ধ ছাড়াও সে দিন দু’পক্ষের খেলোয়াড়দের মধ্যে অশান্তিও বাধে দফায় দফায়। সারা ম্যাচে মোট ২২টি ফাউল হয় এবং রেফারি দশবার হলুদ কার্ডও বার করেন, দুই দলের পাঁচ জন করে খেলোয়াড়কে দেখানোর জন্য। মাঠের এই অশান্তি প্রায়ই ম্যাচের ছন্দ নষ্ট করলেও তা শালীনতা বা হিংসার সীমা ছাড়িয়ে যায়নি কখনও। কলকাতা ডার্বিতে এমন হয়েই থাকে। কিন্তু সমস্ত শত্রুতা, বিদ্বেষের উর্ধে উঠে বারবারই জিতে যায় ফুটবলের গরিমা, ঔজ্জ্বল্য।

এ বারেও নিশ্চয়ই তার অন্যথা হবে না। সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স যে দলের যেমনই হোক, ডার্বিতে সম্পুর্ণ অন্য রূপে দেখা যায় দুই শিবিরকে। এমন অতীতে অনেকবারই হয়েছে। এ বারেও যদি কেউ ভেবে থাকেন, মোহনবাগান এসজি-র সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স ভাল, তারা নতুন বছরে একটিও ম্যাচে হারেনি বলে এই ম্যাচেও অবশ্যই জিতবে এবং ইস্টবেঙ্গলের দুঃসময় যাচ্ছে বলে তারা এই ম্যাচে পিছিয়ে, তা হলে রবিবার রাতে আপনার ধারনা যেমন ঠিকও হতে পারে, তেমনই বদলেও যেতে পারে।

ছন্দে ফেরা সবুজ-মেরুন বাহিনী

জানুয়ারিতে এএফসি এশিয়ান কাপের জন্য আন্তর্জাতিক অবকাশের পর যখন ফের আইএসএল শুরু হয়, তার পর থেকে সবুজ-মেরুন শিবিরকে একেবারে অন্য চেহারায় দেখা গিয়েছে। অবকাশের আগে মোহনবাগান যেখানে দশটি ম্যাচের মধ্যে ছ’টিতে জেতে, একটিতে ড্র করে ও তিনটিতে হারে, সেখানে নতুন বছরে তারা ছ’টি ম্যাচ খেলে চারটিতে জিতেছে ও দু’টিতে ড্র করেছে। একটিতেও হারেনি। অবকাশের আগে যেখানে দশ ম্যাচে ১৯ পয়েন্ট পেয়েছিল তারা, সেখানে অবকাশের পরে তারা ছয় ম্যাচে ১৪ পয়েন্ট অর্জন করেছে। বোঝাই যাচ্ছে হাবাসের প্রশিক্ষণে কতটা উন্নতি করেছেন দিমিত্রিয়স পেট্রাটস, জেসন কামিংসরা।

গত বছরের শেষে টানা তিনটি ম্যাচে হারার পর লিগ টেবলের পাঁচ নম্বরে নেমে গিয়েছিল তারা। সেটিই ছিল মোহনবাগানের সবচেয়ে খারাপ অবস্থা। এ বছর ফের লিগ শুরু হওয়ার পর তারা ক্রমশ চার নম্বরে উঠে আসে, তার পর দুইয়ে এবং এখন তারা আছে তিন নম্বরে। রবিবার যদি তারা জিততে পারে, তা হলে মুম্বই সিটি এফসি-র পরেই দু’নম্বরে উঠে আসবে।

লাল-হলুদের চড়াই-উতরাই

ইস্টবেঙ্গলকেও যদি এ ভাবে বিশ্লেষণ করা যায়, তা হলে দেখা যাবে অবকাশের আগে পর্যন্ত এবং কলিঙ্গ সুপার কাপে তাদের যে উন্নতি দেখা গিয়েছিল, তা অবকাশের পরে আর তেমন ভাবে দেখা যায়নি। ফেব্রুয়ারি থেকে তারা যে আটটি ম্যাচ খেলেছে তার মধ্যে মাত্র দুটিতে জিতেছে ও পাঁচটিতে হেরেছে। যার ফলে লিগ টেবলেও ক্রমশ পিছিয়ে পড়েছে।

গত ডার্বিতে নামার সময় লিগ টেবলে তাদের অবস্থান ছিল সাত নম্বরে। তার পরে আর তারা ওপরের দিকে উঠতে পারেনি। ক্রমশ তারা আট নম্বরে নেমে যায় এবং এখন তাদের স্থান নয়ে। এই জায়গা থেকে উঠে আসতে গেলে কুয়াদ্রাতের দলকে টানা সাফল্য পাওয়া ছাড়া কোনও উপায়ই নেই। তাই রবিবার দুই পক্ষেরই জয় চাই-ই চাই।

গত মাসে কুড়ি দিনের মধ্যে ছ’টি ম্যাচ খেলতে হয় ইস্টবেঙ্গলকে। তাই দলের ফুটবলারদের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খেলান কোচ কার্লস কুয়াদ্রাত। তার ওপর কলিঙ্গ সুপার কাপের পর হঠাৎ চার বিদেশীর অভাব দেখা দেয় দলে। বোরহা হেরেরা, হাভিয়ে সিভেরিও চলে যান অন্য দলে এবং হোসে পার্দো ও সল ক্রেসপো চোট পেয়ে বসে পড়েন। ফলে দলের সব বিদেশীকে একসঙ্গে পাননি নতুন বছরের কোনও ম্যাচেই।

পূর্ণশক্তি ও কৌশলের লড়াই

এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে গত ম্যাচের আগে কোচ বলেই দিয়েছিলেন, তিনি এ বার থেকে পূর্ণশক্তির দল নিয়েই মাঠে নামবেন। সে দিন দলে পাঁচটি পরিবর্তন করে মাঠে দল নামান তিনি। আক্রমণে নন্দকুমার শেকর ও নাওরেম মহেশ, মাঝমাঠে শৌভিক চক্রবর্তী এবং রক্ষণে হিজাজি মাহের ও নিশু কুমারকে দলে ফেরান। ডাগ আউটে রাখেন মন্দার রাও দেশাই ও ফেলিসিও ব্রাউনকে। রবিবার এই দুজনকে প্রথম এগারোয় ফিরিয়ে আনতে পারেন কুয়াদ্রাত।

অন্যদিকে, জামশেদপুর এফসি-র বিরুদ্ধে জেসন কামিংস, অভিষেক সূর্যবংশী ও লিস্টন কোলাসোকে প্রথম দলে ফেরান হাবাস। সে দিন আরমান্দো সাদিকু ও আশিস রাইদের প্রথম দলে রাখেননি। পরে এঁদের পরিবর্ত হিসেবে নামানো হয়। কিন্তু সহাল আব্দুল সামাদকে সে দিন বিশ্রাম দেওয়া হয় সম্ভবত ডার্বির কথা ভেবেই। রবিবার কামিংস বা সাদিকুর মধ্যে হয়তো কেউ একজন শুরু করবেন। দলের বাকি অংশে খুব একটা বেশি পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা কম।

ডার্বিতে কোনও কোচই দল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ঝুঁকি নেবেন বলে মনে হয় না। তবে দুই স্প্যানিশ কোচই কৌশলের বিশেষজ্ঞ। রবিবার তাই মাঠের বাইরেও একটা ম্যাচ দেখা যাবে, যেখানে মুখোমুখি হবে দুই কোচের কৌশল।

কোচ হিসেবে হাবাস ও কুয়াদ্রাত এ পর্যন্ত আইএসএলে ছ’বার মুখোমুখি হয়েছেন। এর মধ্যে তিনবার জিতেছে হাবাসের দল ও একটিতে জিতেছেন কুয়াদ্রাত, দু’বার ড্র হয়েছে। হাবাসের দল তিনবারই জিতেছে হোম ম্যাচে। এ বার কী হবে, তার উত্তর তো রবিবার রাতের আগে পাওয়া যাবে না। তবে আন্দাজ করে নেওয়া যেতেই পারে যে ফুটবলের মহাযুদ্ধে যে যে উপাদান থাকা উচিত, তার সব কিছুই এই যুদ্ধেও থাকবে।

 পরিসংখ্যান বলছে

  • রবিবারের ডার্বি ইস্টবেঙ্গলের হোম ম্যাচ। ঘরের মাঠে টানা তিন ম্যাচে জয়হীন থাকার গত হোম ম্যাচেই তারা চেন্নাইন এফসি-র বিরুদ্ধে জেতে ১-০-য়। রবিবারের ম্যাচ জিততে পারলে আইএসএলের ইতিহাসে এই প্রথম তারা পরপর দুটি হোম ম্যাচে জয় পাবে।
  • চলতি লিগে ইস্টবেঙ্গল এখন পর্যন্ত ১৯ গোল খেয়েছে। গত তিন মরশুমের তুলনায় ১৮টি ম্যাচের পর এ বারই সবচেয়ে কম গোল খেয়েছে তারা। এ পর্যন্ত ১৯ গোল করেছে তারা। তবে ১৮টি ম্যাচ খেলে এর চেয়ে বেশি গোল করার নজির তাদের আছে। ২০২২-২৩-এ ১৮ ম্যাচে ২১ গোল করেছিল তারা।
  • চলতি লিগে তাদের শেষ দু’টি অ্যাওয়ে ম্যাচে কোনও গোল খায়নি মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। রবিবারও যদি ক্লিন শিট বজায় রাখতে পারে তারা, তা হলে এই প্রথম বিপক্ষের মাঠে টানা তিনটি ম্যাচে ক্লিন শিট বজায় থাকবে তাদের।
  • চলতি লিগে এ পর্যন্ত ওপেন প্লে থেকে ২৭টি গোল করেছে মোহনবাগান এসজি, যা অন্য দলগুলির চেয়ে বেশি। এই মরশুমে তারা পেনাল্টি থেকে একটিও গোল করতে পারেনি। এই ব্যাপারে তাদের পাশে আছে হায়দরাবাদ এফসি।
  • ট্যাকলে সাফল্যের দিক থেকে চলতি লিগে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের পিছনে ফেলে দিয়েছে ইস্টবেঙ্গল এফসি। এ পর্যন্ত ৭৩.১% ট্যাকলে সফল হয়েছে তারা। মোহনবাগানের ক্ষেত্রে যা ৬৫.৯%। ২৫৩টির মধ্যে ১৮৫টি ট্যাকলে সাফল্য পেয়েছে ইস্টবেঙ্গল।
  • প্রতি ম্যাচে গড়ে প্রায় ৭০ বার করে বল ছুঁয়েছেন মোহনবাগানের অধিনায়ক শুভাশিস বোস, যা চলতি লিগে তৃতীয় সর্বোচ্চ, আহমেদ জাহু (৯৮) ও জয় গুপ্তার (৭২) পরেই। ১৬ ম্যাচে ১১২৬ বার বল ছুঁয়েছেন শুভাশিস।
  • রবিবারের ম্যাচে শুরু থেকে খেললে নাওরেম মহেশ সিং হবেন আইএসএলে ইস্টবেঙ্গল এফসি দলের প্রথম ফুটবলার, যিনি ৫০টি ম্যাচে প্রথম দলে ছিলেন। এই নিয়ে ৫৪তম ম্যাচ খেলতে চলেছেন তিনি, যা ক্লাবের খেলোয়াড়দের মধ্যে সর্বোচ্চ।    

দ্বৈরথের ইতিহাস

ইন্ডিয়ান সুপার লিগে কলকাতার দুই দল মুখোমুখি হয়েছে মোট সাতবার। ছ’বারই জিতেছে সবুজ-মেরুন বাহিনী। একবার ড্র হয়েছে। ইস্টবেঙ্গল এফসি আজ পর্যন্ত হারাতে পারেনি চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের। দুই দলের দ্বৈরথে মোট ২১ গোল হয়েছে। মোহনবাগান করেছে ১৭টি ও ইস্টবেঙ্গল চারটি। ২০২০-২১ মরশুমে প্রথম ম্যাচে ২-০ ও দ্বিতীয় ম্যাচে ৩-১-এ জেতে মোহনবাগান। ২১-২২ মরশুমে প্রথমে ৩-০-য় ও পরে ৩-১-এ জেতে সবুজ-মেরুন বাহিনী। গত মরশুমের দুই ম্যাচেই ফল হয় ২-০। চলতি মরশুমের প্রথম লেগে ম্যাচ ২-২-এ ড্র হয়।

ম্যাচ- ইস্টবেঙ্গল এফসি বনাম মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট

ভেনু- বিবেকানন্দ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন, কলকাতা

সময়- ৯ মার্চ, ২০২৩, রাত ৮.৩০

সরাসরি সম্প্রচার ও স্ট্রিমিং

টিভি চ্যানেল: ডিডি বাংলা ও কালার্স বাংলা সিনেমা- বাংলা, স্পোর্টস ১৮ খেল- হিন্দি, স্পোর্টস ১৮ ১ এসডি ও এইচডি- ইংলিশ, ভিএইচ ১ এসডি ও এইচডি- ইংলিশ