এশিয়ান কাপ বাছাই পর্বের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে হংকংয়ের মুখোমখি ভারত
মানোলো মার্কেজ দায়িত্ব নেওয়ার পর খুব একটা ভাল ফল করতে পারেনি ভারত। মাত্র একটি ম্যাচ জিততে পেরেছে, হংকং গত ১২টি ম্যাচের মধ্যে মাত্র একটিতে হেরেছে। গত ন’টি ম্যাচে অপরাজিত তারা।

এএফসি এশিয়ান কাপের মূলপর্বে ওঠার রাস্তা যে মোটেই সোজা নয়, তা ভারত বাছাই পর্বের প্রথম ম্যাচেই টের পেয়েছে। লড়াইয়ে শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে মানোলো মার্কেজের ভারত। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তাদের গোলশূন্য ড্র আবু ধাবির রাস্তা কিছুটা হলেও কঠিন করে দিয়েছে। এ বার তাদের দ্বিতীয় ম্যাচে মুখোমুখি হংকং। মঙ্গলবারের এই ম্যাচও মোটেই সোজা হবে না ভারতীয়দের কাছে।
প্রায় ৫০ হাজার দর্শকে ঠাসা নবনির্মিত কাই তাক স্পোর্টস স্টেডিয়ামে এই ম্যাচ হবে, যেখানে ম্যাচের সময় স্টেডিয়াম ছাদে ঢাকা থাকবে। ভিন্ন পরিবেশে এই ম্যাচে জিততে হলে দক্ষতা ও ফুটবল বুদ্ধি ছাড়াও ভারতীয় ফুটবলারদের এই ম্যাচে চাই কঠোর মানসিকতা ও প্রত্যয়। যা সপ্তাহখানেক আগে দেখা যায়নি থাইল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচে।
হংকংয়ের বিরুদ্ধে মঙ্গলবারের ম্যাচের প্রস্তুতি হিসেবে গত বুধবার ভারত থাইল্যান্ডের বিরুদ্ধে যে ম্যাচ খেলে, সেই ম্যাচে জোড়া গোলে হারে। ফলে আত্মবিশ্বাসে যে বেশ ঘাটতি হবে মঙ্গলবার এই নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু শুরু থেকেই যদি নিজেদের সেরাটা দিতে পারে ভারতীয়রা, তা হলে সেই ঘাটতি পুষিয়ে ম্যাচে ফেরা সম্ভব। প্রবল লড়াকু মনোভাব ছাড়া যে এই ম্যাচে সফল হওয়া যাবে না, তা খুব ভাল করেই জানে ভারতীয় শিবির।
কঠিন চ্যালেঞ্জ ভারতের
কোচ মানোলো মার্কেজ ছাড়াও দলকে মানসিক শক্তির তুঙ্গে থাকার জন্য হয়তো তাতাচ্ছেন সুনীল ছেত্রী, সন্দেশ ঝিঙ্গন, লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতের মতো অভিজ্ঞ তারকারা। দলে একাধিক জুনিয়র খেলোয়াড়। তাদের অভিজ্ঞতা কম, চাপ নেওয়ার শক্তি কম। কিন্তু লড়াই করার অদম্য ইচ্ছা তাদের মধ্যে রয়েছে। সেই ইচ্ছাটাকেই মঙ্গলবারের ম্যাচে জাগিয়ে রাখতে হবে ৯০ মিনিট বা তারও বেশি সময় ধরে। তবেই কঠিন পূরণ করা সম্ভব হবে।
Cross, shoot, repeat 🔁 🎯#BlueTigers #IndianFootball ⚽️ pic.twitter.com/dpGFxrHJ9F
— Indian Football Team (@IndianFootball) June 9, 2025
চলতি বাছাই পর্বে ভারত যে গ্রুপে রয়েছে, সেই ‘সি’ গ্রুপের সব দলই তাদের প্রথম ম্যাচে ড্র করায় এখন সব দলই সমান জায়গায়। তাই বাড়তি চাপ নিয়ে নামতে না হলেও জয়ের তাগিদ অবশ্যই রয়েছে ভারতের। এই গ্রুপে ভারতই (১২৬) ফিফা ক্রমতালিকায় সবার ওপরে থাকা দল। হংকং রয়েছে ১৫৫ নম্বরে, সিঙ্গাপুর ১৬০-এ ও বাংলাদেশ ১৮৫। অর্থাৎ, মঙ্গলবার গ্রুপের দুই শীর্ষস্থানীয় দলের লড়াই, যা অবশ্যই জমজমাট হবে।
দুই পক্ষ দুই মেরুতে!
মানোলো মার্কেজ দায়িত্ব নেওয়ার পর অবশ্য খুব একটা ভাল ফল করতে পারেনি ভারত। মাত্র একটি ম্যাচ জিততে পেরেছে, মলদ্বীপের বিরুদ্ধে। বাকি ম্যাচগুলিতে হয় হার, নয় ড্র।
হংকং-এর অবস্থা ঠিক উল্টো। ২০২৪-এর অগস্ট থেকে তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন অ্যাশলে ওয়েস্টউড, যিনি ভারতীয় ফুটবলে পরিচিত মুখ। ২০১৩ থেকে ২০১৬ তিনি বেঙ্গালুরু এফসি-র দায়িত্বে ছিলেন। এটিকে ও রাউন্ডগ্লাস পাঞ্জাবকেও কোচিং করিয়েছেন পরে। ভারতীয় ফুটবল সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা রয়েছে তাঁর। হংকংয়ের জাতীয় দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর যে ১২টি ম্যাচ খেলেছে তারা, তার মধ্যে মাত্র একটিতে হেরেছে। ক্রমতালিকায় তাদের চেয়ে ওপরে থাকা দু’টি দলকেও হারিয়েছে। গত ন’টি ম্যাচে অপরাজিত তারা।
এমন পারফরম্যান্স যাদের, তাদের হারানো যে ভারতের এই দলের পক্ষে কঠিন হবে, এই নিয়ে সন্দেহ নেই। ভারতীয় দলের তারকা ফরোয়ার্ড ও উইঙ্গার লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতে বলেছেন, “হংকংয়ের বিরুদ্ধে খেলা আমাদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, ওদের রক্ষণ ভাল। কাউন্টার অ্যাটাকেও ওরা বেশ ভাল। ওদের কোচকেও আমরা ভাল করে চিনি। ভারতে ওঁর অভিজ্ঞতা অনেক। ওঁদের নিয়ে আমাদের নির্দিষ্ট পরিকল্পনা আছে। তা কাজে লাগাতে হবে আমাদের। সঠিক মানসিকতা নিয়ে মাঠে নামতে হবে। জয়ের খিদে থাকা দরকার। তা হলে আমরা সফল হতে পারি”।
চাই সঠিক সিদ্ধান্ত, নিখুঁত ফুটবল
ওয়েস্টউডের হংকংকে হারাতে গেলে বুধবার পাথুম থানির থাম্মাসাত স্টেডিয়ামে থাইল্যান্ডের বিরুদ্ধে যে রকম পারফরম্যান্স দেখা গিয়েছিল ভারতের, তার চেয়ে অনেক ভাল খেলা দেখাতে হবে। দলের অধিনায়ক সন্দেশ ঝিঙ্গন এই ব্যাপারে আশাবাদী। তিনি বলেছেন, “কলকাতায় আমরা প্রস্তুতি শিবিরে পরিশ্রম করেছি এই ম্যাচকে মাথায় রেখেই। এই ম্যাচের আগে শারীরিক ও মানসিক থেকে আমরা সেরা জায়গায় থাকব, বরাবর এই লক্ষ্যই ছিল আমাদের”।
সদ্য থাইল্যান্ডের বিরুদ্ধে হারের ফলে তারা সেই জায়গায় থেকে মঙ্গলবার মাঠে নামতে পারবে কি না, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। সন্দেশের মতে, “দুই বক্সেই আমাদের আরও ভাল সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং আরও নিখুঁত খেলা খেলতে হবে। সবার আগে রক্ষণে আমাদের শক্তপোক্ত হতে হবে। রক্ষণ শক্তিশালী হলে আক্রমণে ধার বাড়ানো সম্ভব হবে। আর অবশ্যই আক্রমণে আরও নিখুঁত হতে হবে আমাদের”। সত্যিই তা সম্ভব হবে কি না, তা মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বোঝা যাবে।
ব্রাজিল, স্পেনের ছোঁয়া হংকং দলে
হংকং দলে বিদেশ থেকে আসা একাধিক ফুটবলার রয়েছে, যাঁদের এখন হংকংয়ের নাগরিকত্ব দিয়ে এ দেশের ফুটবল দলে খেলানো হচ্ছে। দুই ফরোয়ার্ড জুনিনহো ও স্তেফান পেরেইরা ব্রাজিলীয়, মিডফিল্ডার ফেরনান্দো ও ডুডু তাঁদেরই স্বদেশীয়। স্পেন-জাত ফরোয়ার্ড মানোলো ব্লেদা ও জাপানি ইচিকাওয়া-ও দলের নির্ভরযোগ্য সদস্য।
এঁদের সঙ্গে স্থানীয় ফুটবলাররাও যথেষ্ট ভাল খেলছেন। অভিজ্ঞ গোলকিপার ইয়াপ হাং ফে একশোর ওপর ম্যাচ খেলেছেন জাতীয় জার্সিতে। এ ছাড়াও ডিফেন্ডার সুন মিং হিম, ইউ জে নাম, সুই ওয়াং কিট, তান চুন লোক-রা চিনের সুপার লিগে খেলেন। বাকিরা খেলেন হংকং প্রিমিয়ার লিগেই। মঙ্গলবার এঁদের বিরুদ্ধেই লড়তে হবে সুনীল ছেত্রীদের।
সংখ্যায় এগিয়ে ভারত
প্রায় ১৬ বছর পরে হংকংয়ের কোনও মাঠে ম্যাচ খেলতে নামছে ভারতের সিনিয়র দল। ২০০৯-এ সেখানে একটি ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলতে গিয়েছিল ভারত। সেই দলের শুধুমাত্র সুনীল ছেত্রী এই সফরেও রয়েছেন দলের সঙ্গে। এই দলের সহকারী কোচ মহেশ গাওলিও সেই ম্যাচে খেলেছিলেন এবং ১-২ হারে দলের একমাত্র গোলে অ্যাসিস্ট করেন তিনি। ম্যাচের ৭০তম মিনিটে হংকং গোল করে এগিয়ে যাওয়ার পর ৮০ মিনিটের মাথায় গোল শোধ করেন বাইচুং ভুটিয়া। কিন্তু ইনজুরি টাইমে গোল করে ম্যাচ জিতে নেয় হংকং।
১৯৫১-র পর থেকে মোট ২৪বার ভারত-হংকং ফুটবলে মুখোমুখি হয়েছে। ভারত জিতেছে ন’বার, হংকং আটবার। ২০২২-এ শেষ বারের মুখোমুখিতে কলকাতায় ভারত ৪-০-য় জিতেছিল। সেই দলে ছিলেন সন্দেশ ঝিঙ্গন। তিনি ফেডারেশনের ওয়েবসাইটে বলেন, “সে দিন অনায়াসে জিতলেও হংকং এই কয়েক বছরে অনেক পাল্টে গিয়েছে। ওদের নতুন কোচের সঙ্গে অনেক নতুন খেলোয়াড়ও এসেছে। তাই এই ম্যাচে মোটেই সহজ হবে না”।
ভারতের সবচেয়ে বড় সমস্যা প্রতিপক্ষের গোলের সামনে গিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত না নিতে পারা এবং গোলের সুযোগ তৈরি করা সত্ত্বেও তা থেকে গোল করতে না পারা—এই দুইই গত কয়েকটি ম্যাচে দলকে ভোগাচ্ছে। সোমবার সাংবাদিক বৈঠকেও এ কথা স্বীকার করে নেন। তবু তিনি এই ম্যাচের ফল নিয়ে আশাবাদী।
আশাবাদী কোচ মার্কেজ
তিনি বলেন, “গত বারের তুলনায় এ বার আমাদের প্রস্তুতি অনেক ভাল হয়েছে। কলকাতা, ব্যাঙ্কক ও এখানে (হংকং) তিন সপ্তাহ প্রস্তুতি নিতে পেরেছি আমরা। আমরা এই ম্যাচের জন্য তৈরি। দলের ড্রেসিং রুমের পরিবেশ ভাল। সাধারণত যে দলগুলি ধারাবাহিক ভাবে জয় পায়, তাদের পরিবেশ ভাল থাকে। তবে আমাদের ফল যাই হোক, খেলোয়াড়দের মধ্যে সম্পর্ক বেশ ভাল”।
গত সপ্তাহে থাইল্যান্ডের কাছে দু’গোলে হার নিয়ে ভারতীয় কোচ খুব একটা চিন্তিত নন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “ফ্রেন্ডলি ম্যাচের ফল নিয়ে কোচেরা সাধারণত চিন্তিত হয় না। আমরা হংকং ম্যাচ নিয়ে বেশি চিন্তিত। জানি থাইল্যান্ড ম্যাচের ফল নিয়ে অনেক চর্চা হচ্ছে। কিন্তু আমরা সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পারলে ব্যাপারটা অন্যরকম হত”। ছাদঢাকা স্টেডিয়ামের ভিন্ন পরিবেশে সোমবার অনুশীলন করার সুযোগ পায় ভারতীয় দল।
এই পরিবেশ নিয়ে মার্কেজ বলেন, “এই পরিবেশটা উপভোগ করার চেষ্টা করব আমরা। জানি না গ্যালারি পুরো ভরবে কি না, তবে, আশা করি, প্রচুর লোক আসবে। জমজমাট পরিবেশ থাকবে। তবে আমাদের ফোকাস থাকবে জয়ের ওপর”। হংকংয়ের কোচ অ্যাশলে ওয়েস্টউড ভারতীয় কোচের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা প্রকাশ করে জানিয়ে দেন, তাঁর দল এই ম্যাচের জন্য তৈরি।
হংকং বনাম ভারত ম্যাচটি শুরু হবে মঙ্গলবার ভারতীয় সময় অনুযায়ী বিকেল ৫.৩০-এ। ম্যাচটি সরাসরি স্ট্রিমিং হবে ‘ফ্যানকোড’ অ্যাপে।