চলে গেলেন প্রাক্তন ভারতীয় ফুটবল তারকা সুরজিৎ সেনগুপ্ত। দীর্ঘদিন ধরে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার পর বৃহস্পতিবার দুপুরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বয়স হয়েছিল ৭১। কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পরে গত ২৩ জানুয়ারি কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। গত শুক্রবার পর্যন্ত তাঁর অবস্থা স্থিতিশীল ছিল বলে জানা যায়। কিন্তু পরের দিন থেকেই তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে এবং তাঁকে ভেন্টিলেশনে দেওয়া হয়। সোমবার রাত থেকে বাইপ্যাপ সাপোর্টেও ছিলেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জীবন-যুদ্ধে হার মানেন বৃহস্পতিবার দুপুর দুটো নাগাদ। এই দুঃসংবাদে বাংলার ক্রীড়ামহলে শোকের ছায়া নেমে আসে। দেশের ফুটবল মহলও শোকাহত।

কয়েক দিন আগেই আর এক ফুটবল কিংবদন্তি সুভাষ ভৌমিককে হারিয়েছেন বাংলার ফুটবলপ্রেমীরা। সেই শোকের ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই আছড়ে পড়ল আর এক দুঃসংবাদ। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত ভারতীয় দলের হয়ে খেলেছেন এই তারকা মিডফিল্ডার। কলকাতার তিন বড় ক্লাবের জার্সি গায়েই খেলেছেন তিনি। ১৯৭২-৭৩-এ তিনি খেলেন মোহনবাগানের হয়ে। ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৯— এই পাঁচ বছর ইস্টবেঙ্গলের জার্সি গায়ে। ১৯৮০-তে যোগ দেন মহমেডান স্পোর্টিংয়ে। ১৯৮১-তে ফেরেন মোহনবাগানে, খেলেন ১৯৮৩ পর্যন্ত। ২০১৮-য় সারা জীবনের অবদানের জন্য তাঁকে সন্মানিত করে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব।

অসাধারণ উইঙ্গার ছিলেন সুরজিৎ সেনগুপ্ত, ছিলেন দুরন্ত বল প্লেয়ার। প্রত্যক্ষদর্শীদের কথায় তাঁর খেলার স্টাইল ছিল দর্শনীয় ও সুন্দর। ১৯৭৪-এর ২৪ জুলাই কুয়ালা লামপুরে মারডেকা কাপে তাইল্যান্ডের বিরুদ্ধে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে প্রথম মাঠে নামেন তিনি। এর পরে দেশের হয়ে ১৪টি ম্যাচ খেলেছেন তিনি। ১৯৭৮-এর এশিয়ান গেমসে কুয়েতের বিরুদ্ধে নেমে একটি গোল করেছিলেন। ১৯৭০-এ এশিয়ান গেমসে ব্রোঞ্জজয়ী ভারতীয় দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন সুরজিৎ। সেই দলের কোচ ছিলেন পিকে ব্যানার্জি ও অধিনায়ক ছিলেন সৈয়দ নইমউদ্দিন।

শুধু খেলা নন, বঙ্গ সংস্কৃতিতেও তাঁর আগ্রহ ছিল উল্লেখযোগ্য। যেমন ভাল গান গাইতে পারতেন, তেমনই তাঁর লেখনিও ছিল প্রশংসা করার মতো। দীর্ঘকাল ক্রীড়া সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক সংবাদপত্র আজকাল-এর সহযোগী সম্পাদকের দায়িত্বেও ছিলেন বহুদিন।  

সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট প্রফুল্ল পটেল তাঁর শোকবার্তায় জানিয়েছেন, ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম সেরা উইঙ্গার সুরজিৎদা আর নেই, এই সংবাদ খুবই দুঃখের। ভারতীয় ফুটবলে তাঁর অবদানের কথা কোনও দিন ভোলা যাবে না। তাঁর মৃত্যুতে ভারতীয় ফুটবল অনেক কিছু হারাল। তাঁর পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই

হুগলি জেলার ব্যান্ডেলের কেওটা ত্রিকোন পার্ক থেকে উঠে এসে কলকাতা ময়দানের তারকা হয়ে ওঠা সুরজিৎ সেনগুপ্তকে হারিয়ে শোকস্তব্ধ বাংলার ফুটবল মহল। তাঁর সতীর্থরা ভাবতেই পারছেন না তিনি নেই। সুব্রত ভট্টাচার্য যেমন বলেছেন, খবরটা শোনার পর থেকে ভাবতেই পারছি না। এত বড় মাপের ফুটবলার ছিল। অথচ ওর আচরণে সেটা কখনও বোঝা যেত না। ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে ফুটবল খেলেছি। একসঙ্গে বড়ও হয়েছি। আমি এর বেশি কিছু বলতে পারছি না

আর এক প্রাক্তন ভারতীয় ফুটবলার প্রসুন ব্যানার্জি বলেন, কয়েক দিন ধরে যে খুব অসুস্থ ছিল, তা জানতাম। কিন্তু এ ভাবে চলে যাবে ভাবিনি। আমরা একে অপরের কাছের বন্ধু ছিলাম। একসঙ্গেই থাকতাম। আমরা বিভিন্ন ক্লাবে খেললেও আমাদের বন্ধুত্বে কখনও প্রভাব পড়েনি। কখনও কারও নিন্দা করতে শুনিনি। শিল্পী ফুটবলার ছিল সুরজিৎ। আমার দাদা পিকে ব্যানার্জির পর আমার দেখা সেরা রাইট আউট ছিল ও-ই

প্রাক্তন তারকা ফুটবলার গৌতম সরকার বলেন, সুরজিতের মতো টিমম্যান আমি খুব কমই দেখেছি। অসাধারণ উইং প্লেয়ার ছিল। ও রকম ফুটবলার বারবার আসে না। ওর সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। তাই ভাবতেও খারাপ লাগছে যে, ও নেই। এই অভাব কোনও দিন পূরণ হবে না

কিংবদন্তি গোলকিপার ভাস্কর গাঙ্গুলি বলেন, সুরজিৎদা আমার দাদার মতো ছিলেন। আশা করেছিলাম, এই যুদ্ধটা উনি জিতে ফিরবেন। কিন্তু সে আর হল কোথায়? বড় খেলোয়াড় অনেকেই হয়। কিন্তু সুরজিৎদার মতো বড় মনের মানুষ সকলে হয় না। পাঁচ গোল খাওয়ার পরে আমার দুঃসময়ে উনিই আমাকে সাহস জুগিয়েছিলেন, উনিই আমাকে ভরসা দিয়েছিলেন। এই ধরনের মানুষের চলে যাওয়ার ব্যথা সহ্য করা যায় না

বিদেশ বসু বলেন, আমি এই কষ্ট ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। মানুষ হিসেবে অসাধারণ ছিল সুরজিৎ। কয়েকদিন আগেই সুভাষ ভৌমিক আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে। এ বার সুরজিৎ। এটা মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কম্পটন দত্ত বলেন, আমার চেয়ে বয়সে উনি বড় ছিলেন। চিরকাল আমাদের পথ দেখিয়ে গিয়েছেন। সব সময় উৎসাহ জোগাতেন, যাতে ভাল খেলতে পারি। বাংলা ও ভারতীয় দলে একসঙ্গে খেলেছি। জুনিয়র বলে কখনও ছোট করে দেখেননি। এত ভাল মানুষ ছিলেন। তাঁর মৃত্যু আমাদের বিরাট ধাক্কা দিয়ে গেল

হিরো আইএসএলে অংশগ্রহনকারী কলকাতার দুই দলই শোকবার্তা দিয়েছে। এসসি ইস্টবেঙ্গল তাদের শোকবার্তায় জানিয়েছে, ক্লাবের কিংবদন্তি খেলোয়াড় সুরজিৎ সেনগুপ্তের মৃত্যুতে আমরা গভীর ভাবে শোকাহত। ওঁর পরিবারের প্রতি সমবেদনা রইল। লাল-হলুদ রংয়ে আপনি সারা জীবন বেঁচে থাকবেন। শান্তিতে ঘুমোন

এটিকে মোহনবাগান তাদের শোকবার্তায় জানিয়েছে, সুরজিৎ সেনগুপ্তের প্রয়াণের সংবাদে আমরা গভীর বাবে মর্মাহত। ওঁর দক্ষতা ও প্রতিভা একসময় বছরের পর বছর কলকাতার ফুটবলপ্রেমীদের মাতিয়ে রেখেছিল। আপনি চিরকাল আমাদের হৃদয়ে থাকবেন, কিংবদন্তি

বৃহস্পতিবার রাতে তাঁর শেষকৃত্যের আগে দুই ক্লাবেরই তাঁবুতে নিয়ে যাওয়া হয় সুরজিৎ সেনগুপ্তর মরদেহ। মোহনবাগান তাঁবুতে এসে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে যান মহমেডান স্পোর্টিং ক্লাবের কর্তারাও।

তাঁর প্রয়াণে শোকাহত হিরো আইএসএল পরিবারের প্রতিটি সদস্য তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করেন।