সুপার সানডে-তে টানটান উত্তেজনায় ভরা সেই ম্যাচে যারা জিতত, তারাই হিরো আইএসএল ২০২০-২১-এর লিগসেরা হত এবং তাদেরই খেলার কথা ছিল এ মরশুমের এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগে (এসিএল)। বাম্বোলিমের জিএমসি স্টেডিয়ামে সেই ম্যাচে হারলে সে সুযোগ হাতছাড়া হত দুই দলেরই। কিন্তু ড্র হলে? এটিকে মোহনবাগানের ভাগ্যেই ছিঁড়ত শিকে। সে দিনের অবস্থাটা ছিল এমনই।

সোমবার যেমন চলতি লিগের শেষ ম্যাচে লিগশিল্ড জয়ের লক্ষ্য নিয়ে জামশেদপুর এফসি-র বিরুদ্ধে নামবে এটিকে মোহনবাগান, গতবারেও লিগের শেষ ম্যাচে তেমনই মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে লিগ তালিকায় এক নম্বর দল হওয়ার লড়াইয়ে নেমেছিল তারা। তবে এ বারের মতো কঠিন লড়াই ছিল না তাদের। মাত্র এক পয়েন্ট পেলেই সেই লক্ষ্য পূরণ হত। এ বারে যেমন তাদের জিততে তো হবেই, তার ওপর আবার অন্তত দু’গোলের ব্যবধানে হারাতে হবে জামশেদপুরকে। গতবারের পরীক্ষাটা তাই এত কড়া ছিল না সবুজ-মেরুন শিবিরের। বছর খানেক আগে সে দিনের সেই ম্যাচ ঘিরে যে টানটান উত্তেজনার বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল, সেই ঘটনাই আর এক বার ফিরে দেখা যাক।

ম্যাচের আগে যে যা বলেছিলেন

আন্তোনিও লোপেজ হাবাস (হেড কোচ, এটিকে মোহনবাগান): ড্র নয়, মুম্বই সিটি এফসি-কে হারিয়েই এক নম্বর হতে চাই আমরা। আমাদের জিততে হবে, ড্র নয়। প্রথম লেগের ম্যাচটা আমরা ড্র করতে পারতাম। এই ম্যাচটা সম্পুর্ণ আলাদা একটা পরিস্থিতিতে হচ্ছে। আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ম্যাচটা জিততে হবে। একটা ঐতিহাসিক মুহূর্তে প্রবেশ করতে চলেছি আমরা। তিন পয়েন্টের জন্য লড়তে হবে। আমরা এমন এক প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হতে চলেছি, যারা আক্রমণে খুবই শক্তিশালী।

সের্খিও লোবেরো (হেড কোচ, মুম্বই সিটি এফসি): এরকম ম্যাচই সবাই খেলতে চায়। অসাধারণ একটা ম্যাচ হতে চলেছে। আমাদের স্বপ্নপূরণের ম্যাচ এটা। এই জায়গায় আসার জন্য আমরা প্রচুর খেটেছি। আমাদের এই ম্যাচটা উপভোগ করতে হবে। ক্লাবকে বড় কিছু এনে দেওয়ার সুযোগ এটা। আমাদের প্রতিপক্ষ যথেষ্ট শক্তিশালী। গতবারের চ্যাম্পিয়ন ওরা। এই ম্যাচ জিততে গেলে আমাদের একশো শতাংশ দিতেই হবে। এই ম্যাচে দল হিসেবে যারা ভাল খেলবে, তারাই জিতবে। ওদের দলে দারুন ভারসাম্য রয়েছে। ওদের ডিফেন্স শুধু ভাল, তা বললে চলবে না। ওদের অ্যাটাকও দুর্দান্ত।

ডেভিড উইলিয়ামস (ফরোয়ার্ড, এটিকে মোহনবাগান): শেষ ছ’টা ম্যাচের মতো এই ম্যাচেও আমাদের পজিটিভ রেজাল্ট করতে হবে। দলের প্রত্যেকের কাছে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ। আমরা ড্রয়ের উদ্দেশ্য নিয়ে খেলব না। জেতার জন্যই মাঠে নামব। সে ভাবেই আমাদের প্রস্তুতি চলছে। মুম্বই কাকে ছ’গোল দিল তা নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নই। ওদের হারানোটাই আমাদের চ্যালেঞ্জ। কেউ যদি ভেবে থাকেন আমরা সুবিধাজনক জায়গায় রয়েছি, তা হলে তারা ভুল ভাবছেন।

বার্থোলোমিউ ওগবেচে (ফরোয়ার্ড, মুম্বই সিটি এফসি): দলের পরিবেশ খুবই ভাল। আমরা একটা ভাল জয়ের পরে এই ম্যাচে নামছি। এই ম্যাচেও আমাদের জিততেই হবে। আমাদের দলের মধ্যে যথেষ্ট একতা আছে, চারিত্রিক দৃঢ়তা আছে। আমরা একটা কঠিন অথচ আকর্ষণীয় ম্যাচের খেলার জন্য মুখিয়ে রয়েছি। ম্যাচটা আমাদের কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। বড় বড় বাধা টপকাবার ক্ষমতা আমাদের দলের মধ্যে আছে। আমরা আত্মবিশ্বাসী আমরা যে ফল চাইছি এই ম্যাচে, সেই ফলই হবে।

ম্যাচে যা হয়েছিল

এটিকে মোহনবাগানের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়ে মুম্বই সিটি এফসি ২-০ গোলে জিতে সে বার শীর্ষস্থান দখল করে লিগ শেষ করে। ফলে এই মরশুমে এশিয়ার সবচেয়ে বড় ক্লাব-লিগ এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে স্প্যানিশ কোচ সের্খিও লোবেরার দল।

এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের টিকিট পাওয়ার জন্য এ দিন মুম্বই সিটি এফসি-র সামনে জয় ছাড়া কোনও রাস্তা ছিল না। এটিকে মোহনবাগান ড্র করলেই সেই সম্মান অর্জন করে নিতে পারত। কিন্তু হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করেও মুম্বইয়ের দু’টি গোল শোধ করতে পারেননি রয় কৃষ্ণা, ডেভিড উইলিয়ামসরা।

প্রথম এগারোয় দুটি পরিবর্তন করে দল নামান হাবাস। শুভাশিস বসুর জায়গায় প্রণয় হালদার ও হাভিয়ে হার্নান্ডেজের জায়গায় মার্সেলো পেরেইরা বা মার্সেলিনহো। মুম্বই সিটি এফসি কোচ সের্খিও লোবেরা তাঁর প্রথম দলে তিনটি পরিবর্তন করেন। মান্দার রাও দেশাই, হারনান সান্তানা ও প্রাঞ্জল ভূমিজ মাঠে নামেন মেহতাব সিং, ডি ভিগ্নেশ ও সি গদার্ডের পরিবর্তে। 

দ্রুত গতিতে আক্রমণ-প্রতি আক্রমণে খেলা শুরু হওয়ার পরই গোলের সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলেন রয় কৃষ্ণা। চতুর্থ মিনিটে গোলে কোণাকুণি শট নেন রয়, কিন্তু তা বাঁচিয়ে দেন মুম্বই গোলকিপার অমরিন্দর সিং। একাধিক আক্রমণের চেষ্টার পরে সাত মিনিটের মাথাতেই গোল পেয়ে যায় সাগরপাড়ের দল। বক্সের মধ্যে রাখা আমেদ জাহুর ফ্রি কিক ডানদিক দিয়ে ঢুকে হেড করে গোলে ঠেলে দেন প্রায় অরক্ষিত মুর্তাদা ফল। স্প্যানিশ ডিফেন্ডার তিরি লাফিয়ে উঠেও সেই উড়ে আসা বলের নাগাল পাননি। গত ম্যাচেও তিরি তাঁর সেরা ফর্মে ছিলেন না। দ্বিতীয়ার্ধে তাঁকে বসিয়ে দিতে বাধ্য হন হাবাস।

সেই ম্যাচে দলে ছিলেন না শুভাশিস বসু। তার ওপর ম্যাচের ১৯ মিনিটের মাথায় হ্যামস্ট্রিং পুল হওয়ায় মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যান সন্দেশ ঝিঙ্গনও। এর ফলে এটিকে মোহনবাগানের শক্তিশালী ডিফেন্স বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে। রক্ষণের দুর্বলতারই মাশুল তাদের আবার দিতে হয় ৩৯ মিনিটের মাথায়, যখন দ্বিতীয় গোল পেয়ে যায় মুম্বই সিটি এফসি। বক্সের বাইরে থেকে হারনান সান্তানার বাঁকানো ফ্রি কিক ক্রস বারে লেগে ফিরে আসে। ফিরতি বলে হেড করে জালে বল জড়িয়ে দেন বার্থোলোমিউ ওগবেচে। প্রথম গোলের ক্ষেত্রে যেমন মুর্তাদা ফল আনমার্কড্ ছিলেন, এই গোলের ক্ষেত্রেও ওগবেচে কোনও রকম পাহাড়ায় ছিলেন না।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই যে সবুজ-মেরুন ঝড় ওঠার আশায় ছিলেন সমর্থকেরা, তা কিন্তু দেখা যায়নি। বরং দেখা যায় উল্টোটা। এটিকে মোহনবাগানের রক্ষণের ওপর চাপ বাড়ায় মুম্বই সিটি এফসি। ক্রমশ সেই চাপ সামলে পাল্টা আক্রমণে ওঠা শুরু করে এটিকে মোহনবাগান। কিন্তু মুম্বইয়ের তৎপর ডিফেন্সের জন্য বারবার বাধা পায় তারা।

নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার আট মিনিট আগে মার্সেলো পেরেইরার জায়গায় হাভিয়ে হার্নান্ডেজ নামেন। উদ্দেশ্য অবশ্যই আক্রমণে ধার বাড়ানো। শেষ ২৫ মিনিট ঘন ঘন আক্রমণে ওঠে এটিকে মোহনবাগান। এই সময়টা বেশিরভাগই খেলা হয় মুম্বইয়ের অর্ধে। তবে এই চাপ যথেষ্ট দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সামলান দুগোলে এগিয়ে থাকা মুম্বইয়ের ফুটবলাররা।

ম্যাচের পরে যে যা বলেন

লোবেরা: দলের ছেলেদের ওপর আমি কখনও আস্থা হারাইনি। কারণ, ওদের সঙ্গে আমি সবসময়ই কাজ করি। ওরা প্রত্যেকে একেকজন যোদ্ধা। প্রত্যেকেই যথেষ্ট উচ্চকাঙ্খী ও ভাল মানুষ। মাঠে ও মাঠের বাইরে আমরা একটা পরিবার। মানসিক ভাবেও আমরা খুবই শক্তিশালী। জামশেদপুরের কাছে হারার পরে আমাদের খারাপ সময় এসেছিল ঠিকই। কিন্তু ফের নিজেদের শক্তির প্রমাণ দিতে পেরেছি এবং শীর্ষস্থানটা আমাদেরই প্রাপ্য ছিল। এখন এই সাফল্য উপভোগ করার সময়। সমর্থক, কর্মকর্তাদের মুখে যে আমরা হাসি ফোটাতে পেরেছি, এটাই সবচেয়ে বড় কথা। ওঁরা আমাদের সব কিছু দিয়েছেন। গত এক মাসে অনেক কিছু ঘটেছে। সব কিছুর শেষে উপভোগ করার মতো একটা মুহূর্তে আসতে পেরেছি আমরা। দলের ছেলেরা এই লিগ শিল্ড জেতার জন্য নিজেদের উজাড় করে দিয়েছে। এটা ওদের প্রাপ্য ছিল। আশা করি, এ বার আমরা চ্যাম্পিয়নের ট্রফিটাও জিতব।

প্রীতম কোটাল: যে ভাবে আমরা দুটো গোল ওদের দিয়েছি, নিজেদেরই দোষ দেব। কিছু করার নেই, আমরা চেষ্টা করেছি, একশো শতাংশ দিয়েছি। ম্যাচটা জিততে পারিনি ঠিকই। কিন্তু আমাদের সামনে এখন সেমিফাইনাল রয়েছে। পরবর্তী লক্ষ্য সেমিফাইনালে জেতা। খারাপ লাগছে যে এত কাছে এসেও একটা ভাল সুযোগ হাতছাড়া করলাম। তবে এখান থেকেই আমাদের শিক্ষা নিয়ে পরের ধাপে যেতে হবে। নিজেদের শোধরাতে হবে। যাতে পরের বার যখন এই সুযোগ আসবে, তখন যেন সেটাও হাতছাড়া না হয়।

গতবারে বলা কথাগুলো প্রীতমের এখনও মনে আছে বোধহয়। দেখা যাক, গতবারের শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে এ বার আরও কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেন কি না।