মাঠের ধারে তিনি থাকলে দল ভাল খেলে। কিন্তু মাঠের পাশে তিনি না থাকলে তাঁর দলের ছেলেরা আত্মবিশ্বাস পায় না, ভাল খেলতে পারে না—স্প্যানিশ কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাস সম্পর্কে এমনই কথা শোনা যাচ্ছিল গত কয়েক দিন ধরে। এই আলোচনাটা শুরু হয় মার্চের শেষ দিনে, ঘরের মাঠে চেন্নাইন এফসি-র কাছে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট ২-৩-এ হেরে যাওয়ার পর থেকেই।

অসুস্থতার জন্য সে দিন দলের সঙ্গে মাঠে থাকতে পারেননি হাবাস। ছন্দে ছিলেন না দলের অন্যতম সেরা গোলদাতা দিমিত্রিয়স পেট্রাটসও। ফলে বিরতিতে এক গোলে এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও জয়ের হাসি মুখে নিয়ে মাঠ ছাড়তে পারেননি আরমান্দো সাদিকুরা। ম্যাচের শেষ ২৫ মিনিটের মধ্যে তিন-তিনটি গোল করে তাদের সে দিন বড়সড় ধাক্কা দেয় ওয়েন কোইলের দল।

তার পর থেকেই আলোচনাটা শুরু হয়ে যায়, হাবাসই কি তা হলে মোহনবাগানের প্রধান ফ্যাক্টর বা লাকি চার্ম? ধারণাটা যে পুরোপুরি ঠিক না, তা সবুজ-মেরুন বাহিনীর ফুটবলাররা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন পরের দু’টি ম্যাচে। পাঞ্জাব এফসি-কে ১-০ ও বেঙ্গালুরু এফসি-কে ৪-০-য় হারিয়ে। পাঞ্জাবের বিরুদ্ধে যে দাপুটে ফুটবল খেলে জিতেছিল তারা, তা একদমই বলা যায় না। বরং বেঙ্গালুরুতে গিয়ে সুনীল ছেত্রীর দলের বিরুদ্ধে তার চেয়ে অনেক ভাল ফুটবল খেলে তারা। হেক্টর ইউস্তে, মনবীর সিং, অনিরুদ্ধ থাপা, সাদিকুরা গোল করে দলকে জেতান। এই দুই ম্যাচেও কিন্তু দলের সঙ্গে ছিলেন না হাবাস। তবু জিতেছিল তাঁর দল।

যখন না থেকেও ছিলেন

রোগশয্যায় শুয়েই দলের কৌশল, পরিকল্পনা সব তৈরি করেন তিনি। যা চেন্নাইনের বিরুদ্ধে ম্যাচে করতে পারেননি তিনি। ফলে অথই জলে পড়ে যান তাঁর বাধ্য ছাত্ররা। সব কিছু ছকে দিয়ে কখনও নিজে, কখনও সহকারী মানুয়েল কাসকালানার মাধ্যমে তা খেলোয়াড়দের কাছে পাঠিয়ে দেন। খেলোয়াড়রাও জানেন, কী চান কোচ তাঁদের কাছ থেকে। বাকিটা ছিল তাঁদের সঙ্গে কোচের বোঝাপড়া। সেটা যে যথেষ্ট ভাল জায়গায় রয়েছে, তারই প্রমাণ পরপর দুই ম্যাচে জয়।

এসব সত্ত্বেও মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে শেষ ম্যাচে নিজেদের ওপর পুরোপুরি ভরসা রাখতে পারেননি হাবাসের দলের ছেলেরা। হেড কোচকে সশরীরে সাইডলাইনে চেয়েছিলেন তাঁরা। চেয়েছিলেন, তিনি শুধু বসে থাকুন, তাতেও চলবে। কিন্তু তিনি যেন ডাগ আউটে থাকেন। কোচের ওপর এত আস্থা আর কোনও দলের খেলোয়াড়দের আছে কী? ব্যাপারটা তদন্তসাপেক্ষ। কিন্তু এতটা ভরসার পাত্র কি হাবাসের পূর্বসূরী হুয়ান ফেরান্দোও হয়ে উঠতে পেরেছিলেন? বোধহয় না।

হাবাস কেন এতটা ভরসাযোগ্য হয়ে উঠবেন না? গত বছরের শেষে টানা তিনটি হারের পর যখন সবুজ-মেরুন শিবিরের অবস্থা শোচনীয়। লিগ টেবলের এক নম্বর থেকে তিন নম্বরে নামার পর কেরালা ব্লাস্টার্সের কাছে হেরে যখন পাঁচ নম্বরে নেমে যায় তারা। যখন ফেরান্দোকে অব্যহতি দিয়ে হাবাসকে কোচের দায়িত্ব দেয় ক্লাব, তখন দলের সবাইকে হাবাস বলেছিলেন, “তোমরা যদি আমার ওপর ভরসা রাখতে পারো, যদি আমার কথা অনুযায়ী খেলতে পারো, তা হলে আমরা লিগ চ্যাম্পিয়ন হতে পারি”। তাঁর সহকারী মানুয়েল সাংবাদিক বৈঠকে এ কথা বলেন।

ভরসার পাত্র

হলও ঠিক তা-ই। এমন প্রতিশ্রুতি আর কে-ই বা দিতে পারে। হাবাস পারেন। সে জন্যই তিনি ইন্ডিয়ান সুপার লিগের সফলতম কোচ। এই আত্মবিশ্বাস, এই প্রত্যয় বরাবরই তাঁর শক্তি এবং এই শক্তিই তিনি দলের ছেলেদের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। ধীরে ধীরে প্রভাব বিস্তার করেন এবং শেষে সবচেয়ে বড় ভরসার পাত্র হয়ে ওঠেন। হয়ে ওঠেন ফুটবল পরিবারের কর্তা, অভিভাবক, বন্ধু, পরামর্শদাতা ও শুভাকাঙ্খী।

শিল্ড জয়ের পর সংবাদপত্র ‘দ্য টেলিগ্রাফ’-কে হাবাস বলেন “প্লে-অফে পৌঁছনোটাই ছিল আমাদের লক্ষ্য। দলের ছেলেদের আমি জানি। কারণ, এই দলটার স্পোর্টস ডিরেক্টর ছিলাম আমি। তাই জানতাম যে, এদের সেই সাফল্য পাওয়ার ক্ষমতা আছে। ছেলেরা আমার চাহিদা বুঝেছে এবং সফল হয়েছে”।

মুম্বই সিটি এফসি-কে হারানোর পর দিমিত্রিয়স পেট্রাটস আইএসএলের ওয়েবসাইটকে বলেছিলেন, “দলে যোগ দেওয়ার পর কোচ আমাদের সবসময় বলেছেন একটা দল হিসেবে খেলতে। আমরা আজ খেলা শুরুর বাঁশি থেকে শেষ বাঁশি বাজা পর্যন্ত একদম এককাট্টা ছিলাম, একসঙ্গে লড়েছি। সেই জন্যই জিতলাম”। তাঁর সতীর্থ ও স্বদেশীয় জেসন কামিংস সে দিন বলেন, “আমাদের দলটা অসাধারণ, যেখানে একজন মহান কোচ ও একদল দুর্দান্ত স্টাফ আছে। সব মিলিয়ে খুব ভাল দল আমাদের। আমাদের এটা প্রাপ্য ছিল”।

অতীতে এই হাবাস আইএসএলে কী করেছেন, তা কতটা জানেন দিমি, জেসনরা, তা অবশ্য জানা নেই। কিন্তু বিশ্বকাপে খেলে আসা ফুটবলাররা যদি কোনও কোচের এ রকম প্রশংসা করেন, যদি কাউকে কোচ হিসেবে এমন শ্রদ্ধা করেন, তা হলে বুঝতেই হবে, তাঁর এই সন্মান অবশ্যই প্রাপ্য।

সফলতম, তবু ...

আইএসএলে সফল কোচেদের মধ্যে সামনের সারিতে রয়েছেন হাবাস। যখন এটিকে এফসি-র কোচ ছিলেন, তখন তাদের দু’বার হিরো আইএসএল খেতাব জিতিয়েছেন তিনি। ২০১৪ ও ২০১৯-২০-তে। ২০১৫-য় তাঁর প্রশিক্ষণে কলকাতার দল সেমিফাইনালে উঠেছিল। ২০২০-২১-এ এটিকে মোহনবাগানকেও তুলেছিলেন ফাইনালে।

এ রকম একজন সফল কোচকে ২০২২-এর ডিসেম্বরে লিগ চলাকালীনই বিদায় জানানো হয়! দলকে সঠিক পথে চালিত না করতে পারার জন্যই নাকি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মোহনবাগান কর্তৃপক্ষ। ২০২১-২২ মরশুমে ডিসেম্বরে মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে ১-৫ গোলে হারার পর এটিকে মোহনবাগান জামশেদপুরের কাছেও ১-২-এ হারে, চেন্নাইন এফসি-র বিরুদ্ধে ১-১ ড্র ও বেঙ্গালুরুর বিরুদ্ধে ৩-৩ ড্র করে। এর পরই হাবাসকে অব্যহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ক্লাব কর্তৃপক্ষ।

সে মরশুমের আগে ২০২১-এর এপ্রিলে এটিকে মোহনবাগানের পক্ষ থেকে জানানো হয়, টানা তৃতীয় বছরের জন্য আইএসএলে কলকাতার দলের দায়িত্বে থাকছেন হাবাস। কলকাতায় কোচ হিসেবে সেটি ছিল তাঁর চতুর্থ বছর। ২০১৪-য় প্রথম হিরো আইএসএলে চ্যাম্পিয়ন এটিকে-র কোচ ছিলেন বলিভিয়ার জাতীয় দলের প্রাক্তন কোচ হাবাস।

আইএসএল ২০২০-২১ মরশুমে তিনি নবগঠিত এটিকে মোহনবাগানকে ফাইনালে তোলেন। কিন্তু সফল হননি। তবে সারা লিগে তাঁর দল প্রথম চারের মধ্যেই ছিল। তাই আরও এক বছর চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্তই নিয়েছিল ক্লাব কর্তৃপক্ষ।

সে মরশুমের আগে দলবদলে সবচেয়ে এগিয়ে থেকে শক্তিশালী দল গড়ার পরেও দু’টি করে জয়, হার ও ড্রয়ে আট পয়েন্ট নিয়ে ছয় নম্বরে নেমে যায় এটিকে মোহনবাগান। তার আগের বার সারা লিগে তারা যেখানে ১৫টি-র বেশি গোল খায়নি, সেখানে ছ’টি ম্যাচেই ১৩টি গোল খায় তারা।

টানা চার ম্যাচ জয়হীন থাকা প্রসঙ্গে হাবাস সাংবাদিক বৈঠকে বলেছিলেন, “ব্যাপারটা মোটেই ভাল হচ্ছে না। ক্রমশ নিজেদের সুনাম হারিয়ে ফেলছি আমরা। প্লে অফে খেলতে গেলে এই সুনাম পুনরুদ্ধার করতেই হবে। দলের ফুটবলারদের এটা বুঝতে হবে। আমরা যদি এই জায়গা থেকে বেরোতে না পারি, তা হলে আমাদের প্লে অফে ওঠার সম্ভাবনা থাকবে না”। কিন্তু সুনাম পুণরুদ্ধারের কাজ আর তাঁকে দেওয়া হয়নি। ডিসেম্বরে লিগের মাঝপথে তাঁকে অব্যহতি দিয়ে আনা হয় হুয়ান ফেরান্দোকে।

প্রত্যাবর্তনেও সেরা

পরে হয়তো ভুল বুঝতে পেরে সেই হাবাসকেই ফিরিয়ে আনা হয় সবুজ-মেরুন শিবিরে, তবে টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পদে। মূলত সবুজ-মেরুন বাহিনীর বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলের পরামর্শদাতার ভূমিকা পালনের জন্য নিয়ে আসা হয় এই স্প্যানিশ কোচকে। শক্তিশালী সিনিয়র দল তৈরির পাশাপাশি যুব ফুটবলের উন্নতিতে কাজে লাগানো হবে তাঁকে, এ রকমই একটা উদ্দেশ্য ছিল তাদের। সব বয়সভিত্তিক দলকে পর্যবেক্ষণ করে তাদের উন্নতির পরামর্শ দেবেন হাবাস, এমনই ঠিক ছিল।

এই নতুন ভূমিকা পালনের প্রস্তাবে রাজিও হয়ে যান হাবাস। তখন বলেছিলেন, “কোচিং জীবনের সেরা সময়টা কলকাতায় কেটেছে। এ বার আমি ক্লাবের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হিসেবে যোগ দিচ্ছি। মোহনবাগানের ফুটবল স্ট্র্যাটেজির উন্নতির জন্য ম্যানেজমেন্ট ও টেকনিক্যাল স্টাফের সঙ্গে কাজ করব”। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুরনো ভূমিকাতেই ফিরে আসতে হয় তাঁকে।

এটিকে মোহনবাগান ও মোহনবাগান এসজি-তে হাবাসের পরিসংখ্যান যে কোনও কোচের কাছেই ইর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে। এ পর্যন্ত সবুজ-মেরুন বাহিনীকে মোট ৩৮টি ম্যাচে নামিয়েছেন তিনি। তার মধ্যে ২৩টিতেই জিতিয়েছেন দলকে। আটটিতে ড্র হয়েছে এবং সাতটি হেরেছেন। জয়ের শতকরা হার ৬০.৫০%। ম্যাচপ্রতি গড়ে ২.০৩ পয়েন্ট করে পেয়েছে হাবাসের প্রশিক্ষণাধীন সবুজ-মেরুন বাহিনী। তাঁর সময়ে তাঁর দল ৬৯টি গোল করে ৪০টি গোল খেয়েছে।

এ হল লিগ পর্বের পরিসংখ্যান। প্লে অফে হাবাসের নেতৃত্বে এখন পর্যন্ত একবারই খেলেছে মোহনবাগান। তাতে তিনটি ম্যাচ খেলে একটিতে জয়, একটিতে ড্র ও একটিতে হারে তারা। এই তিন ম্যাচে চারটি গোল দিয়ে চারটি খায় তারা। লিগে ফেরান্দোর মোহনবাগানের জয়ের শতকরা হার হাবাসের চেয়ে কম, ৫৪.৫০%। ৪৪টির মধ্যে ২৪টি ম্যাচে দলকে জিতিয়েছেন তিনি। প্লে-অফে ছ’টির মধ্যে দুটি ম্যাচে জিতেছে ফেরান্দোর মোহনবাগান।

হাবাসের সবচেয়ে বড় সাফল্য অ্যাওয়ে ম্যাচে দলকে ৮৩.৩৩% শতাংংশ ম্যাচে জেতানো। ছ’টির মধ্যে পাঁচটি অ্যাওয়ে ম্যাচেই জিতেছে হাবাসের দল। সেখানে ফেরান্দোর দল ১৬টি ম্যাচের মধ্যে সাতটিতে জিতেছে। অর্থাৎ সাফল্যের শতকরা হার ৪৩.৫ শতাংশ। পরিসংখ্যান সব দিক থেকেই হাবাসকে এগিয়ে রেখেছে। এ বার যদি লিগ শিল্ডের পর কাপও জিততে পারে মোহনবাগান এসজি, তা হলে আইএসএলের সেরা কোচের মুকুটও উঠবে এই স্প্যানিশ ফুটবল বৃদ্ধের মাথাতেই। যা হবে তাঁর কোচিং কেরিয়ারের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।

সেই জন্যই বোধহয় শিল্ড জয়ের সেলিব্রেশন আপাতত মুলতুবি রেখেছেন শিবিরে। যাতে কাপ জয়ের মানসিক প্রস্তুতিতে ব্যাঘ্যাত না ঘটে, দলের ছেলেরা যাতে আত্মতুষ্ট হয়ে না পড়ে। কারণ, কোচ হাবাসের লক্ষ্য অনেক উঁচুতে, পাহাড়ের চূড়ায়, যেখানে সবাই উঠতে পারে না। ওঠে তারাই, যারা যোগ্যতম।