ইন্ডিয়ান সুপার লিগে আবার জয়ে ফিরল ইস্টবেঙ্গল এফসি। ঘরের মাঠে গত তিনটি ম্যাচে জয়হীন থাকার পর সোমবার যুবভারতীতে সমর্থকদের মুখে হাসি ফোটাল লাল-হলুদ বাহিনী। বহু চেষ্টার পর ম্যাচের ৬৫ মিনিটের মাথায় নন্দকুমার শেখরের গোলে এ দিন ম্যাচ জেতে ইস্টবেঙ্গল। নিজের শহরের দলের বিরুদ্ধে এই জয়সূচক গোল চলতি লিগে তাঁর পাঁচ নম্বর। ভারতীয় ফুটবলারদের মধ্যে তিনিই এখন সর্বোচ্চ গোলদাতা।

এ দিন প্রথমার্ধের বেশিরভাগ সময় চেন্নাইন এফসি আধিপত্য বিস্তার করলেও দ্বিতীয়ার্ধে তিনটি পরিবর্তন করে আক্রমণে তীব্রতা বাড়ায় ইস্টবেঙ্গল এবং তারই ফল তারা পায় ৬৫ মিনিটের মাথায়। চেন্নাইন সমতা আনার মরিয়া চেষ্টা করে এদিন। বিশেষ করে দুই উইং দিয়ে সমানে আক্রমণ করে যায় তারা। সারা ম্যাচে লাল-হলুদ বাহিনী যেখানে সাতটি ক্রস দেয়, সেখানে চেন্নাইন ২৫টি ক্রস করে গোলের জন্য। কিন্তু লাল-হলুদ রক্ষণ ও গোলকিপারের তৎপরতায় ও নিজেদের ভুলে একটিও গোল করতে পারেননি রহিম আলিরা। গোলের লক্ষ্যে থাকা শটের সংখ্যাতেও এগিয়ে ছিল ওয়েন কোইলের দল। কিন্তু কাজের কাজটি করে নেয় হোম টিমই।

এই জয়ের ফলে নয় থেকে আট নম্বরে উঠে এল ইস্টবেঙ্গল। ১৬ ম্যাচে ১৮ পয়েন্ট তাদের। ছ’নম্বরে থাকা জামশেদপুর এফসি-র (১৭ ম্যাচে ২০) চেয়ে মাত্র দু’পয়েন্ট পিছিয়ে তারা। সাত নম্বরে থাকা নর্থইস্টের (১৬ ম্যাচে ১৯) সঙ্গে মাত্র এক পয়েন্টের ব্যবধান তাদের। অর্থাৎ, এই জয়ের ফলে ছ’নম্বরে পৌঁছনোর দৌড়ে অনেকটাই এগিয়ে গেল লাল-হলুদ বাহিনী।          

এ দিন রক্ষণে আলেকজান্দার প্যানটিচের বদলে লালচুঙনুঙ্গা ও আক্রমণে অজয় ছেত্রীর জায়গায় ফেলিসিও ব্রাউনকে রেখে একই ছকে প্রথম এগারো বাছেন ইস্টবেঙ্গল কোচ কার্লস কুয়াদ্রাত। অন্যদিকে, চেন্নাইন এফসি তাদের অন্যতম সেরা বিদেশী রাফায়েল ক্রিভেলারোকে রিজার্ভ বেঞ্চে রেখে, চারটি পরিবর্তন করে দল সাজায় চেন্নাইন এফসি। ক্রিভেলারোর জায়গায় এ দিন শুরু থেকে খেলেন জর্ডন মারে।

শুরু থেকেই দুই দলই আক্রমণাত্মক ফুটবল খেললেও কোনও পক্ষই একটানা বেশিক্ষণ বল দখলে রাখতে পারেনি। বারবার ভুল পাসের ফলে বলের নিয়ন্ত্রণ হারায় দুই দলই। ফলে আক্রমণ হলেও তা পূর্ণতা পায়নি। ফলে প্রথম আধঘণ্টার খেলায় ইস্টবেঙ্গল একটির বেশি শট গোলে রাখতে পারেনি এবং দু’টি শট গোলে রাখে চেন্নাইন।

চেন্নাইন এফসি-র ডিফেন্ডার আকাশ সাঙ্গওয়ানের কর্নার কিক হাওয়ায় বাঁক খেয়ে গোলে ঢোকার আগেই তা আটকে দেন ইস্টবেঙ্গল গোলকিপার প্রসুখন গিল। বক্সের মধ্যে থেকে নেওয়া রহিম আলির একটি শটও রোখেন গিল। ক্লেটনের একটি ফ্রিকিক সোজা চেন্নাইন গোলকিপার দেবজিৎ মজুমদারের হাতে জমা হয়ে যায়।

এ ছাড়া আর তেমন কোনও সুবর্ণ সুযোগ, যা থেকে গোল হওয়া অবধারিত ছিল, সে রকম তৈরি করতে পারেনি কোনও পক্ষই। হয় মাঝমাঠে, নয় ফাইনাল থার্ডে বারবার ভুল পাস করে বলের দখল প্রতিপক্ষের পায়ে তুলে দেন ইস্টবেঙ্গল ও চেন্নাইনের ফুটবলাররা। প্রথমার্ধে দু’পক্ষেরই পাসিং অ্যাকিউরেসি ছিল ৭৫ শতাংশেরও কম। ম্যাচের শেষ পর্যন্তও তা একই রকম ছিল। তবে ক্রসের সংখ্যার দিক থেকে প্রথম ৪৫ মিনিটে চেন্নাইন এফসি তাদের প্রতিপক্ষকে অনেক পিছনে (১০-২) ফেলে দেয়। উইং দিয়ে আক্রমণে চেন্নাইন এ দিন ছিল অনেক বেশি তৎপর। কিন্তু আসল গোলটাই তুলে নিতে পারেনি তারা।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই নিশু কুমার, মহম্মদ রকিপ ও ফেলিসিও ব্রাউনকে তুলে নিয়ে মন্দার রাও দেশাই, আলেজান্দার প্যানটিচ ও পিভি বিষ্ণু-কে নামান কুয়াদ্রাত। বিষ্ণু নামায় লাল-হলুদ বাহিনীর আক্রমণে তীব্রতা আরও কিছুটা বাড়ে।

প্রথম মিনিটেই ভিক্টর ভাজকেজের পাস পেয়ে বক্সের ডানদিক থেকে গোলে শট নেন নন্দকুমার, যা ব্লক করা হয়।  এর পর একাধিক গোলের সুযোগ তৈরির চেষ্টা করেন চেন্নাইনের জর্ডন মারে, ফারুখ চৌধুরিরা। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হন তাঁরা। ভিনসি ব্যারেটোর ক্রসে গোলে হেড করেন ছ’গজের বক্সের মধ্যে থাকা মারে, যা আটকে দেন গিল। ৬৫ মিনিটের মাথায় বক্সের মধ্যে থেকে নেওয়া ক্লেটন সিলভার শটও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।

শেষ পর্যন্ত লকগেট খোলে নন্দকুমার শেখরের চেষ্টায় ও তরুণ ডিফেন্ডার বিকাশ ইউমনামের ভুলে। ৬৫ মিনিটের মাথায় কর্নার থেকে দূরের পোস্টের সামনে বল পান নন্দকুমার এবং তিনি প্রায় ৪৫ ডিগ্রি কোণ থেকে গোলে শট নেন। এই শটই ব্লক বা ক্লিয়ার করতে যান বিকাশ, যা তাঁরে পায়ে লেগে বারের নীচ দিয়ে গোলের ওপরের নেটে জড়িয়ে যায় (১-০)।

এই গোলের পরেই চেন্নাইনের অন্যতম সেরা তারকা রাফায়েল ক্রিভেলারো মাঠে আসেন ও শুরুতেই ইস্টবেঙ্গলের গোলের লক্ষ্যে দূরপাল্লার শট নেন, যা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ৭০ মিনিটের মাথায় বক্সের মাথা থেকে ফের হাওয়ায় বাঁক খাওয়ানো শট নেন ক্রিভেলারো, যা গিল না আটকালে বিপদ হত তাঁর দলের। ৮৪ মিনিটের মাথায় নিনথইয়ের ক্রসে ঠিকমতো হেড করতে পারলে হয়তো গোল পেতেন রহিম আলি। কিন্তু বল বারের ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়।

নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার পাঁচ মিনিট আগে ইস্টবেঙ্গল ব্যবধান বাড়ানোর সুবর্ণ সুযোগ পায়, যখন ডানদিক দিয়ে ওঠা বিষ্ণু বিপক্ষের এক ডিফেন্ডারকে ড্রিবল করে অসাধারণ এক থ্রু পাঠান ক্লেটন সিলভার কাছে। কিন্তু ক্লেটনের গোলমুখী শট ব্লক করে দেন ইস্টবেঙ্গলের প্রাক্তনী সার্থক গলুই।

ম্যাচের শেষ দিকে ম্যাচের রাশ নিজেদের হাতে নিয়ে চলে আসে ইস্টবেঙ্গল। জামশেদপুর এফসি-র কাছে হার থেকে শিক্ষা নিয়ে ব্যবধান বাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করে তারা। কিন্তু মিসপাসের ধারাবাহিকতা বজায় ছিল তাদের। এই সুযোগে চেষ্টা চালিয়ে যান ক্রিভেলারোরা। ৯০ মিনিটের মাথায় নিনথইয়ের ক্রস থেকে গোল করার অনবদ্য সুযোগ পান ইরফান। কিন্তু গোলে শট নিতে গিয়ে বল তাঁর হাতে লাগে।

সাত মিনিটের বাড়তি সময় দেন রেফারি। এই সময়ে চেন্নাইনকে সমতা আনতে না দিলেও একটি ক্ষতি আটকাতে পারেনি ইস্টবেঙ্গল। হিজাজি মাহের এই সময়ে হলুদ কার্ড দেখেন, যার ফলে পরের ম্যাচে তাঁকে পাবে না ইস্টবেঙ্গল এফসি।

ইস্টবেঙ্গল এফসি দল (৪-২-৩-১): প্রভসুখন গিল (গোল), মহম্মদ রকিপ (পিভি বিষ্ণু-৪৫), লালচুঙনুঙ্গা, হিজাজি মাহের, নিশু কুমার (মন্দার রাও দেশাই-৪৫), ভিক্টর ভাজকেজ (ভিপি সুহের-৯৩), শৌভিক চক্রবর্তী, নাওরেম মহেশ সিং (অজয় ছেত্রী-৭৫), ক্লেটন সিলভা, নন্দকুমার শেখর, ফেলিসিও ব্রাউন (আলেকজান্দার প্যানটিচ -৪৫)।

পরিসংখ্যানে ম্যাচ         

বল পজেশন: ইস্টবেঙ্গল এফসি ৫২.৫% - চেন্নাইন এফসি ৪৭.৫% , সফল পাসের হার: ৭২%-৭৭%, গোলে শট: ২-৪, ফাউল: ১৬-১৩, ইন্টারসেপশন: ৪-১০, ক্রস: ৭-২৫, কর্নার: ২-৫, হলুদ কার্ড: ৪-২।

ম্যাচের সেরা: নন্দকুমার শেখর (ইস্টবেঙ্গল এফসি)