দুই গোলে জিতে লিগসেরা হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে যে ম্যাচে নেমেছিল তারা, সেই ম্যাচে ০-১ হেরে মাঠ ছাড়তে হল এটিকে মোহনবাগানকে। মঙ্গলবার ফতোরদার জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে মোহনবাগান অ্যাকাডেমি থেকে উঠে আসা এক বঙ্গসন্তানের গোলেই এই হার মানতে হল সবুজ-মেরুন বাহিনীকে এবং জামশেদপুর এফসি যোগ্য দল হিসেবেই জিতে নিল এ বছরের লিগ শিল্ড। অর্থাৎ, আগামী মরশুমে এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করবে বাংলার প্রতিবেশী রাজ্যের এই দল।

সোমবার অসাধারণ ও মাপা ফুটবল খেলে টানা সাতটি ম্যাচ জিতে লিগ টেবলের এক নম্বর জায়গাটা সুরক্ষিত রাখে ইস্পাতনগরীর দল। ৫৭ মিনিটের মাথায় বঙ্গসন্তান ঋত্বিক দাসের অসাধারণ গোলে ম্যাচটা ১-০ গোলে জেতে তারা। ২০ ম্যাচে ৪৩ পয়েন্ট পেয়ে এ বারের লিগ শিল্ড জিতে নিল তারা। হিরো আইএসএলে এই প্রথম কোনও দল ৪৩ পয়েন্ট পেয়ে এক নম্বরে থেকে লিগ শেষ করল। এ ছাড়াও টানা সবচেয়ে বেশি ম্যাচ জেতার নজিরও গড়ল আওয়েন কোইলের দল। এই টানা সাতটি ম্যাচে জিতল তারা। চ্যাম্পিয়ন হলে এই সংখ্যাটা দাঁড়াবে দশ। সোমবার সেই দিকেই ইঙ্গিত করল তাদের পারফরম্যান্স।

টানা ১৫ ম্যাচে অপরাজিত থাকার পরে ১৬ নম্বর ম্যাচে এই হার লিগ টেবলের তিন নম্বরে পাঠিয়ে দিল এটিকে মোহনবাগানকে এবং সেমিফাইনালে তারা দুইয়ে থাকা হায়দরাবাদ এফসি-র মুখোমুখি হবে। অপর সেমিফাইনালে জামশেদপুর এফসি-র মুখোমুখি হবে কেরালা ব্লাস্টার্স। অর্থাৎ ভারতের সেরা ফুটবল লিগের অন্তিম পর্বের লড়াইটা হতে চলেছে দেশের দক্ষিণ ও পূর্বের চার দলের মধ্যে। 

লিগ শিল্ড জিততে হলে এ দিন এটিকে মোহনবাগানকে অন্তত দু’গোলের ব্যবধানে জিততে হত। তাই প্রত্যাশা অনুযায়ীই ৪-৪-২-এ দল সাজান এটিকে মোহনবাগান কোচ হুয়ান ফেরান্দো। ড্র করলেই যারা লিগ সেরার খেতাব অর্জন করতে পারতেন, সেই জামশেদপুরের কোচ আওয়েন কোইল ৪-২-৩-১ ছকে শুরু করেন। প্রথম মিনিট থেকেই এটিকে মোহনবাগানের খেলোয়াড়দের মধ্যে বিপক্ষকে চাপে রাখার প্রবণতা দেখা যায়।

জনি কাউকো এ দিন একটু এগিয়ে আক্রমণ বিভাগে খেলা শুরু করেন। সঙ্গী ছিলেন রয় কৃষ্ণা। দুই উইং দিয়ে আক্রমণের জন্য বরাবরের মতোই ছিলেন লিস্টন কোলাসো ও মনবীর সিং। মাঝখান দিয়েও যেমন আক্রমণে উঠছিলেন সবুজ-মেরুন ফুটবলাররা, তেমনই উইং দিয়েও আক্রমণে ওঠেন তাঁরা।

প্রথম ১৫ মিনিটের মধ্যেই দু’টি গোলের সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করেন শুভাশিস বোস ও জনি কাউকো। বক্সের বাইরে থেকে শুভাশিসের শট পোস্টের সামান্য বাইরে দিয়ে চলে যায়। বক্সের মাথা থেকে নেওয়া কাউকোর গোলমুখী শট জামশেদপুর ডিফেন্ডার পিটার হার্টলের মাথা ছুঁয়ে বারের ওপর দিয়ে উড়ে যায়।

প্রথমার্ধে এটিকে মোহনবাগানের আগ্রাসন আটকাতে হিমশিম খেয়ে যায় জামশেদপুর এফসি। ৪-৪-২-এ শুরু করলেও আক্রমণের সময় কখনও ৩-৪-৩, কখনও ৩-৩-৪ হয়ে যাচ্ছিল সবুজ-মেরুন বাহিনী। নিজেদের ঘর বাঁচাতে গিয়ে মেজাজ হারাতে দেখা যায় প্রণয় হালদার, ড্যানিয়েল চিমাকে। প্রথম ১৫ মিনিটের মধ্যেই হলুদ কার্ড দেখে ফেলেন এই দু’জন। ৩৮ মিনিটের মাথায় জনি কাউকোকে অফ দ্য বল ধাক্কা মেরে হলুদ কার্ড দেখেন গ্রেগ স্টুয়ার্টও।

চাপ সামলাতে অবশ্য ইস্পাতনগরীর খেলোয়াড়রাও মাঝে মাঝে প্রতি আক্রমণে ওঠেন। ১৯ মিনিটের মাথায় লালদিনলিয়ানার উড়ে আসা ক্রসে হেড করে গোলের চেষ্টা করেন চিমা। কিন্তু সতর্ক অমরিন্দর তা সেভ করেন। ৪১ মিনিটের মাথায় বাঁ দিক দিয়ে বল নিয়ে বিপক্ষের বক্সে ঢুকে পড়েন জামশেদপুরের বাঙালি মিডফিল্ডার ঋত্বিক দাস। বক্সের মধ্যে তাঁর ক্রসে ঠিকমতো নাগাল পেলে বিপদ ঘটাতে পারতেন চিমা।

সেরা অস্ত্র গ্রেগ স্টুয়ার্টকে এ দিন কড়া পাহাড়ায় রেখেছিলেন তিরি, সন্দেশরা। ফলে প্রথমার্ধে তাঁকে বেশি নড়াচড়া করতে দেখা যায়নি। অন্য দিকে লিস্টন কোলাসোকেও কড়া পাহাড়ায় রাখেন জামশেদপুরের ডিফেন্ডাররা। উইং দিয়ে বল নিয়ে উঠলেও লিস্টনকে ভিতরে ঢুকতে বা গোলে শট নিতে দিচ্ছিলেন না তাঁরা।

লিস্টনকে বিপক্ষ আটকে রাখলেও ডান দিক দিয়ে মনবীর সিংয়ের যতটা তৎপর হওয়া উচিত ছিল, ততটা তৎপর হতে দেখা যায়নি তাঁকে। প্রথমার্ধের বাড়তি সময়ে তিরি বক্সের বাইরে বাঁ দিক থেকে যে জোরালো দূরপাল্লার শটটি নিয়েছিলেন, সেটি কয়েক ইঞ্চির জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট না হলে গোলকিপারের কিছু করার থাকত না।

বিরতিতে গোলশূন্য অবস্থাতেই বিশ্রামে যান দু’পক্ষের খেলোয়াড়রা। প্রথমার্ধে এটিকে মোহনবাগানের বল পজেশন ছিল ৫৯ শতাংশ, যা ম্যাচের শেষ পর্যন্তও বজায় থাকে এবং সারা ম্যাচে বিপক্ষের চেয়ে দ্বিগুন (৪৮১-২৩৬) পাস খেলেন সবুজ-মেরুন তারকারা। তবে তিনটির বেশি শট গোলে রাখতে পারেনি কোনও দলই (নীচে পরিসংখ্যান দেখুন)।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই বক্সের সামনে পাওয়া ফ্রিকিক নিখুঁত ভাবে গোলে রাখেন গ্রেগ স্টুয়ার্ট। কিন্তু বাঁ দিকে ডাইভ দিয়ে তা সেভ করেন অমরিন্দর। তবে এই ফ্রি কিকের পর থেকে ফের চাপ বাড়াতে শুরু করে এটিকে মোহনবাগান। ৫৩ মিনিটের মাথায় কার্ল ম্যাকহিউকে তুলে ডেভিড উইলিয়ামসকে নামান ফেরান্দো। উদ্দেশ্য ছিল আক্রমণের ধার বাড়ানো। কিন্তু এই সিদ্ধান্তেরই মাশুল দিতে হয় প্রীতম কোটালদের।  

তাঁদের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেন ঋত্বিক দাস। ৫৬ মিনিটের মাথায় তাঁর গোলেই এগিয়ে যায় জামশেদপুর এফসি। বক্সের বাইরে স্টুয়ার্টের পাস পেয়ে বক্সের মাথা থেকে সোজা গোলে শট নেন মোহনবাগান অ্যাকাডেমি থেকে উঠে আসা আসানসোলের ঋত্বিক, যা ডানদিকে ডাইভ দিয়েও আটকাতে পারেননি অমরিন্দর।

৬৩ মিনিটের মাথায় লেনির জায়গায় আশুতোষ মেহতা ও প্রীতমের জায়গায় প্রবীরকে নামান ফেরান্দো। সম্ভবত ডানদিকের উইং দিয়ে আক্রমণ আরও বাড়ানোর উদ্দেশ্যে এই সিদ্ধান্ত নেন সবুজ-মেরুন কোচ। ৬৬ মিনিটের মাথায় বক্সের সামনে থেকে তিরির পাসে সোজা গোলে শট নেন ডেভিড উইলিয়ামস, যা সোজা রেহনেশের হাতে আটকে যায়।

গোল পাওয়ার পর থেকে বিপক্ষকে পাল্টা চাপে ফেলা শুরু করে জামশেদপুর। এটিকে মোহনবাগানের অ্যাটাকারদের বক্সে ঢুকতে দেননি তাদের ডিফেন্ডাররা। এমনিতেই লিস্টন ও রয় কৃষ্ণাকে কড়া পাহাড়ায় রাখেন তাঁরা। তার ওপর মনবীর সিং এ দিন কার্যত নিষ্প্রভ ছিলেন। ফেরান্দোর পরিবর্তনগুলোও সে ভাবে কার্যকর হয়নি। কার্ল ম্যাকহিউকে তিনি তুলে নেওয়ায় মাঝমাঠের শক্তি বেশ কিছুটা কমে যায়। যার জেরে আক্রমণ ও রক্ষণ, দুই বিভাগই চাপে পড়ে যায়। শেষ মিনিটে বক্সের বাঁ দিক থেকে লেনির হাল্কা টোকা থেকে বল পেয়ে গোলে শট নিয়েও ব্যর্থ হন কাউকো। এটাই ছিল তাদের ম্যাচে ফেরার শেষ সুযোগ। কিন্তু গতবারের মতো এ বারও সাফল্য তাদের ভাগ্যে ছিল না।

সেমিফাইনাল লাইন-আপ

১১ ও ১৫ মার্চ: জামশেদপুর এফসি বনাম কেরালা ব্লাস্টার্স

১২ ও ১৬ মার্চ: হায়দরাবাদ এফসি বনাম এটিকে মোহনবাগান

এটিকে মোহনবাগান দল: অমরিন্দর সিং (গোল), প্রীতম কোটাল (অধি) (প্রবীর দাস), সন্দেশ ঝিঙ্গন, তিরি, শুভাশিস বোস (কিয়ান নাসিরি), মনবীর সিং, লেনি রড্রিগেজ (আশুতোষ মেহতা), কার্ল ম্যাকহিউ (ডেভিড উইলিয়ামস), লিস্টন কোলাসো, জনি কাউকো, রয় কৃষ্ণা।

পরিসংখ্যানে ম্যাচ        

বল পজেশন: এটিকে মোহনবাগান ৫৯% - জামশেদপুর এফসি ৪১%

সফল পাস: ৩৩৫/৪৮১ (৭০%) - ১১৭/২৩৬ (৫০%), গোলে শট: ৩-৩, ফাউল: ১১-১৭, সেভ: ২-৩, ইন্টারসেপশন: ৫-২২, কর্নার: ৬-২, হলুদ কার্ড: ১-৪, ম্যাচের সেরা: পিটার হার্টলে