শুধু জেতা নয়, অন্তত দুই গোলের ব্যবধানে জেতা— সোমবার চলতি হিরো আইএসএলে লিগ পর্বের শেষ ম্যাচে এই লক্ষ্য নিয়েই নামতে হবে গতবারের রানার্স আপ এটিকে মোহনবাগানকে। বিপক্ষে টানা ছয় ম্যাচ জিতে আসা জামশেদপুর এফসি। কাজটা যে কঠিন নয়, বেশ কঠিন তা বোঝাই যাচ্ছে। সে জন্যই তো এই ম্যাচকেই ফাইনাল ভেবে সোমবার মাঠে নামবেন সবুজ-মেরুন শিবিরের ফুটবলাররা।

ইস্পাতনগরীর দল যদি এক গোল করে, তা হলে রয় কৃষ্ণাদের তিন গোল দিতে হবে। ড্যানিয়েল চিমারা যদি দু’গোল দেয়, ডেভিড উইলিয়ামসদের চার গোল করতে হবে। তা হলেই লিগ টেবলের শীর্ষে উঠে আগামী বছর এশিয়ার সেরা ক্লাব লিগ এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গ্রুপ পর্বে সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে এটিকে মোহনবাগান। না হলে এই খেতাব ও সন্মান জামশেদপুরের কপালে নাচছে বলা যায়।

নয়া নজিরের দোরগোড়ায় দুপক্ষই

টানা ১৫ ম্যাচে অপরাজিত থেকে এটিকে মোহনবাগান যেমন হিরো আইএসএলের ইতিহাসে নতুন নজিরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে, তেমনই টানা সাতটি ম্যাচ জিতলেও নতুন নজির সৃষ্টি করবে জামশেদপুর এফসি। কিন্তু কোনও দলের কাছেই এখন সেটা বড় কথা নয়। ম্যাচের ফলটাই সবচেয়ে জরুরি।

জামশেদপুর ১৯ ম্যাচে ৪০ পয়েন্ট পেয়ে এখন লিগ শীর্ষে। হায়দরাবাদ ২০ ম্যাচে ৩৮ পেয়ে দুই নম্বরে। এটিকে মোহনবাগান ১৯ ম্যাচে ৩৭ পেয়ে তিনে ও কেরালা ব্লাস্টার্স ২০ ম্যাচে ৩৪ পেয়ে চার নম্বরে। সোমবার ফতোরদার ম্যাচ ড্র হলে লিগ শিল্ড জামশেদপুরের। হারলেও তারাই সেই খেতাব পেতে পারে, যদি না দু’গোল বা তার বেশি ব্যবধানে হারে। আর ড্র হলেও লিগ সেরা জামশেদপুরই হবে। সেক্ষেত্রে দুই দলের মধ্যে গোলপার্থক্যের বিচারে হায়দরাবাদ এফসি-কে তিনে নামিয়ে এটিকে মোহনবাগান উঠে যাবে দু’নম্বরে। অঙ্কটা এ রকমই। কিন্তু এটিকে মোহনবাগান শিবির এখন দুই বা ততোধিক গোলে জেতা ছাড়া আর কোনও অঙ্কের হিসাবেই যেতে চায় না।

বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, কাজটা বেশ কঠিন। প্রতিবেশী রাজ্যের দল যে ছন্দে রয়েছে, তাতে তাদের রোখা এখন কার্যত অসম্ভব। গত দশটি ম্যাচের মধ্যে ন’টিতেই জিতেছে তারা। একটিতে তারা অপ্রত্যাশিত ভাবে হারে বেঙ্গালুরু এফসি-র কাছে, যারা ছ’নম্বরে থেকে এ বারের লিগের অভিযান শেষ করেছে। এমন ধারাবাহিকতা যাদের, তাদের দু’গোলে হারিয়ে সেরার শিরোপা জেতার গর্বই যে আলাদা, তা খুব ভাল করেই জানেন সবুজ মেরুন শিবিরের তারকারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই অসাধ্য সাধন করতে পারবে কি না তারা, তা কেউই জানে না।

যদিও এ বারের হিরো আইএসএল প্রচুর অঘটনের সাক্ষী থেকেছে। কিন্তু যে দল গত ছয় ম্যাচে ২১ গোল দিয়ে ছ’টি গোল খেয়েছে, তাদের দু’গোলে হারানো সত্যিই কঠিন। যদিও সবুজ-মেরুন কোচ হুয়ান ফেরান্দো সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, দলের ফুটবলারদের ওপর পূর্ণ আস্থা রয়েছে তাঁর। কিন্তু তাঁর দলের ফুটবলাররা এখন যে অবস্থায় রয়েছেন, তাতে এমন কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারবে কি না, সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

আত্মবিশ্বাসী অপরাজিত এটিকে মোহনবাগান

গত ১৫টি ম্যাচে তারা অপরাজিত রয়েছে, এই পরিসংখ্যানটি মনে ছাপ ফেলার মতো ঠিকই। কিন্তু আর একটু গভীরে গেলে দেখা যাবে এই ১৫টির মধ্যে আটটি ম্যাচে জয় পেয়েছে তারা। বাকি সাতটিতে ড্র। এই ১৫ ম্যাচে এটিকে মোহনবাগান যেমন ২৮টি গোল দিয়েছে, তেমনই ১৬টি গোল খেয়েছেও তারা। ‘ক্লিন শিট’, অর্থাৎ একটিও গোল খায়নি মাত্র চারটি ম্যাচে। পরিসংখ্যান হিসেবে বোধহয় দারুন কিছু নয়।

যে ভাবে দলের নির্ভরযোগ্য তারকারা দিনের পর দিন কোভিডে আক্রান্ত হয়ে হোটেলের ঘরে বসে কাটিয়েছেন, তার পরে মাঠে ফেরার প্রক্রিয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই চোট পেয়েছেন এবং এখনও যার জের চলছে, তাতে তাদের ১৫ ম্যাচে অপরাজিত থাকাটা বেশ অপ্রত্যাশিতই ছিল।

একটা সময়ে দলের চার নির্ভরযোগ্য বিদেশিই অসুস্থ হয়ে মাঠের বাইরে ছিলেন। তা সত্ত্বেও হার তো মানেইনি, ম্যাচ জিতেছেও গতবারের রানার্স-আপরা। গোলে অমরিন্দর সিং ও রক্ষণে প্রীতম কোটাল, শুভাশিস বোস, তিরিরা যেমন অতন্দ্র প্রহরীর মতো সমানে দূর্গ সামলেছেন, তেমনই আক্রমণে লিস্টন কোলাসো, মনবীর সিংরা কোনও কোনও ম্যাচে বিদেশিদের অভাবও বুঝতে দেননি।  

এখনও ফরাসি মিডফিল্ডার হুগো বুমৌস চোট পেয়ে দলের বাইরে। সেমিফাইনালে তাঁর ফেরার সম্ভাবনা কতটা, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। ডেভিড উইলিয়ামস গত দু’টি ম্যাচে খেলতে পারেননি। বরং রয় কৃষ্ণা ম্যাচে ও গোলে ফেরায় আশ্বস্ত হয়েছেন সমর্থকেরা। কিন্তু সোমবার জামশেদপুরের ইস্পাতকঠিন রক্ষণ ফিজিয়ান ফরোয়ার্ডকে অক্ষত থাকতে দেবে কি না, সেই আশঙ্কাও রয়েছে।

তবে কৌশলী কোচ ফেরান্দো রয়কে কী ভাবে খেলান, সেটাই দেখার। গত ম্যাচে যেমন তাঁকে মাঝখানে না রেখে ডানদিক দিয়ে খেলিয়েছিলেন এবং সেই ডানদিক দিয়ে বক্সে ঢুকেই ম্যাচের একমাত্র গোলটি করে আসেন রয়। এই ম্যাচে ডেভিড উইলিয়ামসের খেলার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এ রকম একটা ম্যাচে, যেখানে শুরু থেকেই নিজেদের গোলের মুখ কার্যত ‘সিল’ করে দিয়ে আক্রমণের ঝড় তুলতে হবে এবং ৯০ মিনিট সমান তীব্রতায় কঠিন প্রতিপক্ষকে চাপে রাখতে হবে, সেখানে রয়-ডেভিড জুটি শুরু থেকেই খেলবেন, এমন প্রত্যাশা করা যেতেই পারে। লিস্টন, মনবীরদের গতিবিধিও এই ম্যাচে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জামশেদপুরের দুর্ভেদ্য রক্ষণকে পরাস্ত করে তাদের গোলের জালে দু-দু’বার বল জড়ানো একেবারেই সোজা কাজ হবে না।

চিমার আগমনে দুরন্ত জামশেদপুর

জামশেদপুরের রক্ষণে যেখানে পিটার হার্টলে, এলি সাবিয়ার মতো মতো কড়া ধাতের ডিফেন্ডার রয়েছেন, সেখানে বিপক্ষের ফরোয়ার্ডদের কাজ বেশ কঠিন হয়ে ওঠে। এ পর্যন্ত মোট ছ’টি ম্যাচে ‘ক্লিন শিট’ রাখতে পেরেছে তারা। ৪১টি গোল দিয়ে ২১টি খেয়েছে।

এই মরসুমে তাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি নাইজেরিয়ান ফরোয়ার্ড ড্যানিয়েল চিমা, যিনি এসসি ইস্টবেঙ্গলের জার্সি গায়ে প্রায় ফ্লপ করার পরে ইস্পাতনগরীর ছোঁয়ায় ইস্পাতকঠিন হয়ে ওঠেন। এসসি ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরা জানলে অবাক হতে পারেন যে, এ পর্যন্ত মোট ন’টি গোল করেছেন ড্যানিয়েল চিমা। তার মধ্যে সাতটিই জামশেদপুরের হয়ে। প্রায় প্রতি ম্যাচেই স্কোরশিটে তাঁর নাম থাকছে। গত ম্যাচে দলের ৫-১ জয়ে জোড়া গোল ছিল তাঁর। চিমা যোগ দেওয়ার পরে জামশেদপুর দলের আর কোনও ফুটবলার এতগুলি গোল করেননি। দলের আর এক ফরোয়ার্ড গ্রেগ স্টিউয়ার্টের সঙ্গে জুটি বেঁধে বেশ ধারালো হয়ে উঠেছেন চিমা। ফলে সোমবার তাঁকে আটকানোও প্রীতম কোটালদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে।

সোমবারের কঠিন পরীক্ষা নিয়ে সবুজ-মেরুন অধিনায়ক প্রীতম কোটালের বক্তব্য, “বল পজেশন থেকে পাসিং ফুটবল, সব ক্ষেত্রেই আমাদের উন্নতি হয়েছে। এর ফলে পুরো দলের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। চেন্নাইন ম্যাচে কৌশলের অঙ্গ হিসেবে আমরা কিছু বিপজ্জনক পাস খেলেছি। তাতে সাফল্য এসেছে। রক্ষণ আগের চেয়ে এখন অনেক গোছানো। জামশেদপুর ম্যাচ আমরা অন্য কৌশলে খেলব। ওরা লং বল বেশি খেলে। ওদের বাঁ দিকটা খুব ভাল। কাউন্টারে ও সেট পিসে গোল তুলে নেয়। এটা মাথায় রাখতে হবে আমাদের। দলে রয় ফিরেছে, এটা খুবই ভাল খবর। ও থাকা মানে বিপক্ষের রক্ষণ চাপে থাকবে”। প্রসঙ্গত, প্রথম লেগে জামশেদপুরের ম্যাচে গোল করেছিলেন প্রীতম।

ফিরে দেখা প্রথম লেগ

বাম্বোলিমের অ্যাথলেটিক্স স্টেডিয়ামে জামশেদপুর এফসি ২-১-এ হারায় আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের এটিকে মোহনবাগানকে। হিরো আইএসএলে সবুজ-মেরুন শিবিরের বিরুদ্ধে এটাই ইস্পাতনগরীর দলের প্রথম জয়। ৩৭ মিনিটের মাথায় গোল করে দলকে এগিয়ে দেন জামশেদপুরের তরুণ মিডফিল্ডার সেমিনলেন দুঙ্গেল। এটিকে মোহনবাগান গোলশোধ করার একাধিক সুযোগ পেলেও তা কাজে লাগাতে পারেনি। ৮৪ মিনিটের মাথায় পরিবর্ত হিসেবে নেমেই মিডফিল্ডার আলেকজান্দার লিমা দলের ব্যবধান বাড়িয়ে দেন। ম্যাচের একেবারে শেষ দিকে জেএফসি গোলকিপার রেহনিশের ভুল কাজে লাগিয়ে একটি গোল শোধ করেন প্রীতম কোটাল। তার পরেও আরও সাত মিনিট সময় পেলেও তা কাজে লাগাতে পারেননি সবুজ-মেরুন ফুটবলাররা।

এটিকে মোহনবাগান স্কোয়াড

গোলকিপার: অমরিন্দর সিং, অভিলাষ পাল, সুব্রত পাল, অর্শ আনোয়ার শেখ;

ডিফেন্ডার: তিরি, আশুতোষ মেহতা, সুমিত রাঠি, শুভাশিস বোস, প্রীতম কোটাল, প্রবীর দাস, মাইকেল সুসাইরাজ, দীপক টাঙরি, গুরসিমরত গিল, জোস আরোয়ো, রবি রাণা, রিকি সাবং;

মিডফিল্ডার: জনি কাউকো, কার্ল ম্যাকহিউ, হুগো বুমৌস, বিদ্যানন্দ সিং, শেখ সাহিল, অভিষেক সূর্যবংশী, লেনি রড্রিগেজ, ইঙ্গসন সিং;

ফরোয়ার্ড: রয় কৃষ্ণা, ডেভিড উইলিয়ামস, লিস্টন কোলাসো, মনবীর সিং, কিয়ান নাসিরি।

ম্যাচের খুঁটিনাটি

মুখোমুখি: এটিকে মোহনবাগান বনাম জামশেদপুর এফসি

তারিখ ও সময়: ৭ মার্চ, সন্ধ্যা ৭.৩০

ভেনু: পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়াম, ফতোরদা

সম্প্রচার: স্টার স্পোর্টস ২, স্টার স্পোর্টস ২ এইচডি, স্টার স্পোর্টস ৩, স্টার স্পোর্টস ১ হিন্দি, স্টার স্পোর্টস ১ হিন্দি এইচডি, স্টার স্পোর্টস ১ বাংলা

অনলাইন স্ট্রিমিং: ডিজনি+হটস্টার ও জিও টিভি