রাত পেরোলেই চলতি আইএসএলের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষায় নামছেন তাঁরা। সে জ্ন্য প্রস্তুত তিনি ও তাঁর সতীর্থরা। এই পরীক্ষায় উতরে গেলে তাঁদের হাতে উঠবে লিগের সেরার শিরোপা, তার পরে প্লে অফের লড়াই। তবে প্লে-অফ নিয়ে আপাতত ভাবনা মুলতুবি রেখেছে সবুজ-মেরুন শিবির। জনি কাউকোদের পাখির চোখে এখন একটাই ম্যাচ, সোমবার মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে ঘরের মাঠে লিগের শেষ ম্যাচ। যা জিতলে প্রথমবার লিগশিল্ড অর্জন করবে তারা।

তবে সহজে যে আসবে না এই খেতাব, সে জন্য প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে এবং মাথা ঠাণ্ডা রেখে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হবে তাঁদের, তা খুব ভাল করেই জানেন কাউকো। কঠিন এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেই ম্যাচের আগের দিন সাংবাদিকদের কাউকো বলেন, “ওদের দল যেমন ভাল, যেমন ভাল ভাল খেলোয়াড় আছে, আমাদেরও তাই। কাল একটা কঠিন ম্যাচ খেলতে চলেছি আমরা। শিল্ড জেতার জন্য লিগের সেরা দুই দল মুখোমুখি হতে চলেছে কাল। আগেও বলেছি আমরা এই ম্যাচ নিয়ে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী এবং উত্তেজিত। ভাল ম্যাচ হবে”।

প্রতিপক্ষ যেহেতু যথেষ্ট শক্তিশালী, তাই শুরু থেকেই আগ্রাসী ফুটবল খেলতে রাজি নয় মোহনবাগান। সতর্ক থেকে আক্রমণে উঠবেন বলে জানিয়ে রাখলেন দলের অন্যতম নির্ভরযোগ্য বিদেশী তারকা। বলেন, “শুরু থেকেই আমরা অল আউট যাওয়ার ভুল করব না, কারণ, তাতে আমাদের সমস্যায় পড়তে হতে পারে। আমাদের মাথা ঠাণ্ডা রেখে, ধৈর্য্য সহকারে ম্যাচটা খেলতে হবে। প্রত্যেককেই যার যার নিজস্ব খেলা খেলতে হবে। আমি আত্মবিশ্বাসী। এর আগেও অনেক গোল করেছি আমরা। গোল করার অনেক লোকও আছে আমাদের। যদি নিজেদের দূর্গ অক্ষত রাখতে পারি, তা হলে ম্যাচটা জেতা সম্ভব”।

দলে একাধিক তরুণ খেলোয়াড় রয়েছেন, যাঁরা এত চাপ নিতে পারবেন কি না, তা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন রয়েছে। তাঁদের জন্য ১৬ বছর ধরে আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলা কাউকোর পরামর্শ, “দলের তরুণ ফুটবলারদের মানসিক শক্তি বজায় রাখতে হবে। মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে, বেশি ভেবে মাথায় বেশি চাপ না নেওয়াই ভাল। বিশেষ করে এমন এক কঠিন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে, যেখানে দুজনেই খেতাবের লক্ষ্যে লড়াই করছে। বেশি আবেগপ্রবণ না হওয়াই ভাল, তাতে ক্ষতি হয়। এই ধরনের টানটান ম্যাচে বেশি ভুল করা চলবে না। ছোটখাটো ভুলই বড় ক্ষতি করে দিতে পারে”।

তিনি নিজেও এই ম্যাচ নিয়ে বেশি ভাবনা-চিন্তা করতে রাজি নন। জানিয়ে দিলেন যা হবে, মাঠেই বুঝে নেবেন, “নিঃসন্দেহে এটা একটা বড় ম্যাচ। কিন্তু যদি সবসময়ই ম্যাচে কী হবে না হবে, এ সব নিয়ে ভাবতে থাকি, তা হলে চাপে পড়ে যেতে হবে। আমি আমার ফুটবল জীবনে শিখেছি, কোনও কিছু নিয়ে বেশি ভাবা ভাল নয়। মাঠে নেমে যেটা করা দরকার, সেটা করতে পারলেই ভাল ফল পাওয়া যাবে”, বলেন ফিনল্যান্ডের হয়ে ইউরো কাপে খেলা তারকা।

গত ডিসেম্বরে এই দুই দলের মধ্যে মুম্বই ফুটবল এরিনায় যে রকম চড়া মেজাজের ম্যাচ হয়েছিল, তার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়, সেটাই চান কাউকো। সে দিন রেফারি রাহুল গুপ্তার পকেট থেকে সাতবার হলুদ কার্ড ও সাতবার লাল কার্ড বেরিয়েছিল, যা আইএসএলে নজির। সেই ম্যাচে মুম্বই সিটি এফসি-র চারজন ও মোহনবাগান এসজি-র তিনজন ফুটবলার লাল কার্ড দেখেন। সে দিন ১-২-এ হারে মোহনবাগান এসজি।  

সেই ম্যাচের প্রসঙ্গ উঠলে কাউকো বলেন, “গত ম্যাচে আমি ছিলাম না। তবে ম্যাচটা টিভিতে দেখেছি। অদ্ভূত সব ঘটনা ঘটেছে সেই ম্যাচে। গত ম্যাচটার মতো ম্যাচ আমি জীবনে কখনও দেখিনি। ১৪-১৫টা কার্ড দেখিয়েছিলেন রেফারি। আশা করি, এই ম্যাচে সে রকম কিছু হবে না। তবে অনেক ডুয়াল, লড়াই বোধহয় এই ম্যাচে দেখা যাবে। দুটো দলই যেখানে শিল্ড জয়ের জন্য লড়াই করছে, তখন মাঝে মাঝে হয়তো পরিস্থিতি উত্তপ্তও হয়ে উঠবে। মাঠের মধ্যে মাথা ঠাণ্ডা রাখাটা খুবই জরুরি”।

তবে গত ম্যাচের ফলের প্রভাব এই ম্যাচে পড়বে না বলেই মনে করেন ফিনল্যান্ডের তারকা। বলেন, “গত ম্যাচে যা হয়েছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেই সময় দল একেবারে অন্যরকম ছিল। এখন পরিবেশ-পরিস্থিতি, দলের অবস্থা সম্পুর্ণ অন্যরকম। একটা ম্যাচেই ফয়সালা হয়ে যাবে। অতীতে কী হয়েছে, তার প্রভাব এই ম্যাচে সে ভাবে পড়বে বলে মনে হয় না। ৯০ মিনিটের খেলা। আশা করি আমরা ভাল খেলব। বিশেষ করে যখন আমরা ঘরের মাঠে খেলছি। আমরা আত্মবিশ্বাসী”।

আজ পর্যন্ত আইএসএলে মুম্বই সিটি এফসি-কে কখনও হারাতে পারেনি মোহনবাগান, যে পরিসংখ্যানকে খুব একটা গুরুত্ব দিতে রাজি নন দলের সহকারী কোচ মানুয়েল কাসকালানা। সোমবারের ম্যাচ নিয়ে তিনি বেশ সিরিয়াস। বলেন, “ফুটবলে চাপ, টেনশন এসব থাকবেই। আমরা কোনও দিন ওদের বিরুদ্ধে জিততে পারিনি, এটা শুধুই একটা পরিসংখ্যান। তার মানে এই নয় কোনও দিনই হারাতে পারব না। সে সব নিয়ে আমরা ভাবছিই না। ডুরান্ড কাপের সময় এখানে আমি ছিলাম না। তখন মোহনবাগান কিন্তু মুম্বইকে হারিয়েছিল এবং চ্যাম্পিয়নও হয়েছিল। এটা সে রকমই আর একটা ম্যাচ। পরিসংখ্যান নিয়ে ভাবছি না”।

ঘরের মাঠে গ্যালারি ভর্তি সমর্থখদের সামনে খেলার সুযোগটাকে বড় করে দেখছেন তিনি। বলেন, “কাল ভরা গ্যালারি থাকবে, আমাদের সমর্থকেরা থাকবেন, এটা আমাদের একটা বড় সুবিধা। আমাদের সমর্থকদের সামনে খেলব আমরা। আশা করি, পরিবেশ আমাদের পক্ষেই থাকবে। তাই কাল এই ম্যাচটা খেলতে পেরে আমরা খুশি। এই ম্যাচে আমাদের স্মার্ট ফুটবল খেলতে হবে। আমরা কাল ৯০ মিনিটই লড়াই করব। গত ম্যাচে বেঙ্গালুরুর বিরুদ্ধে রক্ষণ ফাঁকা করে দিয়ে আক্রমণে ওঠার কোনও পরিকল্পনা নেই। কারণ, কাল আমাদের শুধু জয় চাই। হারলে বা ড্র করলে চলবে না”।

হেড কোচ আন্তোনিও হাবাস গত দু’দিন ধরে দলের অনুশীলনে থাকলেও তিনি দৌড়ঝাঁপ করেননি। মাঠের পাশে বসে শুধু অনুশীলন দেখেছেন ও খেলোয়াড়দের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সোমবারের ম্যাচে তিনি ডাগ আউটে থাকতে পারবেন কি না জানতে চাইলে মানুয়েল বলেন, “কোচ এখনও পুরো সেরে ওঠেননি। দেখা যাক, কাল উনি রিজার্ভ বেঞ্চে থাকতে পারেন কি না। তবে আগের চেয়ে ভাল আছেন। ওঁর অনুপস্থিতি অবশ্যই টের পাই। উনি সত্যিই সুপার ব্রেনের অধিকারী। ফুটবল সম্পর্কে ওঁর জ্ঞান, আবেগ, যে ভাবে উনি এগুলো খেলোয়ারড়দের মধ্যেও ছড়িয়ে দেন, খেলোয়াড়দের যে রকম আস্থা আছে ওঁর ওপর, সবই অগাধ। গত তিন ম্যাচে আমরা ওঁর অভাব খুবই অনুভব করেছি। লিগের শেষ ম্যাচ খেলতে নামছি কাল আমরা। মোহনবাগান সমর্থকদের জন্য এই ম্যাচটা জিততে হবে আমাদের”।

প্রতিপক্ষ সম্পর্কে হাবাসের সহকারী বলেন, “মুম্বইয়ের দল সত্যিই খুব ভাল। খুব ভাল ভাল খেলোয়াড় আছে ওদের দলে। গত দশটা ম্যাচে অপরাজিত রয়েছে ওরা। খুবই কঠিন প্রতিপক্ষ। ওরা অনেকদিন ধরেই এক-দুই নম্বরে রয়েছে। আমাদের প্রমাণ করতে হবে ওদের বিরুদ্ধে আমরা কত ভাল খেলতে পারি। ওরা লিগশিল্ড জয়ের ক্ষেত্রে ফেভারিট হতে পারে, কিন্তু আমরা যেহেতু ষাট হাজার সমর্থকের সামনে খেলার সুযোগ পাচ্ছি, তাই সম্ভাবনাটা সমান সমান”।

প্রতিপক্ষের তরুণ ভারতীয় উইঙ্গারদের নিয়েও যে যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করেছেন তাঁরা, তাও বোঝা গেল মানুয়েলের কথায়। যখন বলেন, “ছাঙতে, বিপিন, পেরেইরা, নগুয়েরা, আপুইয়া ওদের প্রত্যেকেই ভাল ফুটবলার। ওরা এই ম্যাচের জন্য ভাল প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদের যেমন ওদের আটকাতে হবে, তেমনই ওদেরও আটকাতে হবে আমাদের। বিপিন ও ছাঙতে সত্যিই দুই উইংয়ে খুব গতিময় খেলোয়াড়। সেজন্যই ওরা জাতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগ পায়। ওদের আটকাতে আমাদের ডিফেন্সে কাল তিনজন কেন, চার, পাঁচ এমনকী সাতজন খেলোয়াড়কেও দেখতে পারেন। কিন্তু আমাদের উইংয়েও লিস্টন, মনবীর, কিয়ানের মতো ফুটবলার আছে”।  

মরশুমের মাঝখানে জনি কাউকে দলে পাওয়ায় যে তাদের বিরাট সুবিধা হয়েছে, তা স্বীকার করে নিয়ে মানুয়েল বলেন, “জনিকে পাওয়াটা তো অবশ্যই সুবিধার। জনি যথেষ্ট অভিজ্ঞ, এই ধরনের ম্যাচ ও ওর ফুটবল জীবনে অনেক খেলেছে। বড় দলের হয়ে বড় দলের বিরুদ্ধে হাজার হাজার সমর্থকের সামনে খেলেছে ও। ওর সেই অভিজ্ঞতা আমাদের কাজে লাগবে”।

কাউকো নিজেও তাঁর অভিজ্ঞতা সতীর্থদের সঙ্গে ভাগাভাগি করার কথা বলেন। দলের দুঃসময়ে নিজের ভূমিকা নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, দুঃসময়ে আমি দলকে আমার অভিজ্ঞতা, আমার দক্ষতা, গুণ, যা কিছু আমার কাছে আছে, সে সব দিয়েই সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। সতীর্থরা এই ব্যাপারে আরও ভাল বলতে পারবে। চোট সারিয়ে ফিরে আসার পরে যতটুকু খেলতে পেরেছি, সে জন্য সমর্থকদের কাছ থেকে প্রচুর ভালবাসা পেয়েছি। ফিরে আসার পর নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি, যাতে সমর্থকেরা খুশি হন। কাজটা কঠিন ছিল। তখন আমাদের সময়টা ভাল ছিল না। তবু আমরা খেলায় উন্নতি করেছি ও ঘুরে দাঁড়িয়েছি। ভাল ভাল কয়েকটা ম্যাচ জিতেছি। সমর্থকদের ধন্যবাদ, আমার পাশে থাকার জন্য। তবে এখানে দলই সব। কোনও একজন বা দুজন আলাদা করে গুরুত্বপূর্ণ নয়। এবং সবাই মিলে শেষ ম্যাচটা জিততে হবে আমাদের”।

এই ঘরের মাঠেই গত ম্যাচে চেন্নাইন এফসি-র কাছে হারের কথা মনে করিয়ে দিলে কাউকো বলেন, “চেন্নাইনের বিরুদ্ধে আমরা হেরেছিলাম বটে, কিন্তু আমরা আমাদের চারিত্রিক দৃঢ়তা দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছি। পাঞ্জাবের বিরুদ্ধেও যে সেরা ছন্দে ছিলাম, তা নয়। অনেক গোল করতে পারতাম সে দিন। কিন্তু পারিনি। তবে যেটা সবচেয়ে জরুরি, সেই তিন পয়েন্ট পেয়েছিলাম। বেঙ্গালুরুর বিরুদ্ধে দুটো গোল হয়ে যাওয়ার পর আমরা আরও ওপেন খেলতে শুরু করি। দলের সবাই ছন্দে ছিল সে দিন। সে দিন আমরা গোলের সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পেরেছি। তবে ফুটবলে এ রকমই হয়। কখনও ১-০, কখনও ৪-০। তবে জয় ও পয়েন্ট পাওয়াটাই সবচেয়ে জরুরি”।