ঠিক সাত বছর আগের ঘটনা। সাইক্লোন ‘হুদহুদ’-এর আতঙ্ক কাটিয়ে কলকাতা তখন মজেছে ফুটবলের নতুন উৎসবে। বাঙালির সেরা উৎসব দূর্গাপুজো সে বার একটু তাড়াতাড়িই মিটে গিয়েছিল। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহেই। কিন্তু উৎসবের রেশ কাটেনি। যেখানে গানই আছে, ‘সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল’, সেখানে এমন এক ফুটবল উৎসবের আগমনীতে তো বাঙালি মাতবেই। তাই শারদোৎসব চলে গেলেও বাংলার ফুটবলপ্রেমীদের মন থেকে উৎসবের রেশ কাটেনি।

এই ১২ অক্টোবরই ছিল সেই দিন, যেদিন কলকাতার গর্ব যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে শুরু হয় ভারতের সেরা ফুটবল উৎসব হিরো ইন্ডিয়ান সুপার লিগ। এই দিনেই হিরো আইএসএলের পথ চলা শুরু আতলেটিকো দ্য কলকাতা (এটিকে) বনাম মুম্বই সিটি এফসি ম্যাচ দিয়ে। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহমেডান স্পোর্টিংয়ের পর কলকাতার ফুটবলের আর এক বড় দল এটিকে যখন প্রথম মাঠে নামে স্প্যানিশ ফুটবলের সুগন্ধ নিয়ে, তখন সারা বাংলার ফুটবলপ্রেমীরা সে দিন তাদের প্রিয় দলের জন্য গলা ফাটিয়েছিল। মানুষের ঢল নামে যুবভারতীর গ্যালারিতে।

সেই গ্যালারিতে শুধু যে ৭০ হাজার ফুটবলপ্রেমী ছিলেন, তা নয়, ছিলেন মুকেশ অম্বানি, অমিতাভ বচ্চন, শচীন তেন্ডুলকর, প্রিয়ঙ্কা চোপড়া, রণবীর কপুর, জন আব্রাহাম, অভিষেক বচ্চন-সহ শিল্প ও বিনোদন জগতের নামী ব্যক্তিরাও। উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও।

প্রথম মরশুমেই সবাইকে চমকে দিয়েছিল স্প্যানিশ কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের তত্ত্বাবধানে থাকা কলকাতার দলটি। সে বার তারাই চ্যাম্পিয়ন হয় ফাইনালে কেরালা ব্লাস্টার্সকে হারিয়ে। মুম্বই সিটি এফসি-কে ৩-০ গোলে হারিয়ে সেই ঘটনার ইঙ্গিত কিন্তু প্রথম ম্যাচেই দিয়ে রেখেছিল হাবাস-বাহিনী।

লিগ শুরুর আগে স্পেনে প্রায় এক মাস প্রস্তুতি শিবির করেছিল তারা। দলের সমস্ত ফুটবলারকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে স্প্যানিশ প্রথায় ফুটবলের তালিম দেওয়া হয়েছিল তাঁদের। সেই শিবিরেরই প্রতিফলন দেখা গিয়েছিল সারা লিগের পারফরম্যান্সে। যদিও ১৪ ম্যাচে চারটি জিতে ও সাতটি ড্র করে লিগ তালিকায় তিন নম্বরে থেকে প্লে অফে পৌঁছয় কলকাতার দল। কিন্তু ফাইনালে কেরালা ব্লাস্টার্সকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নের ট্রফিটা জিতে নেয় তারাই।

ফিরে আসা যাক সেই ঐতিহাসিক দিনে। ১২ অক্টোবর, ২০১৪। হিরো আইএসএলের সর্বপ্রথম ম্যাচে। সে দিন রীতিমতো দাপটের সঙ্গে ৩-০ গোলে মুম্বই সিটি এফসি-কে হারিয়ে দেয় কলকাতার তারকারা। যেমন ঝাঁ চচকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল হিরো আইএসএল, তেমনই ঝাঁ চকচকে ফুটবল সে দিন দেখিয়েছিল তারা। ২৭ মিনিটে ফিকরু তেফেরা অনবদ্য গোল করে দলকে এগিয়ে দেন। ৬৯ মিনিটের মাথায় গোলের প্রায় ২৫ গজ দূর থেকে বোরহা ফার্নান্ডেজের দর্শনীয় ভলি এটিকে-কে এনে দেয় দ্বিতীয় গোল। পরিবর্ত খেলোয়াড় আর্নাল লিবার্ট ম্যাচের একেবারে শেষে স্টপেজ টাইমে ফিকরুর মাপা ক্রসে ট্যাপ করে গোল দিয়ে দলের আনন্দ তিনগুন বাড়িয়ে তোলেন।

গ্যালারিতে বসে বা টিভিতে প্রথম ম্যাচেই উচ্চ মানের ফুটবল দেখে দেশের আপামর ভারতীয় ফুটবলপ্রেমী বুঝে নেন এ বার থেকে এ দেশের গ্যালারিতে বসেই ইউরোপ বা লাতিন আমেরিকার মানের ফুটবল স্বচক্ষে দেখার সাধ পূর্ণ হতে চলেছে তাঁদের। সে দিন ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে অনেক কিছুই ঘটেছিল প্রথম বারের জন্য। তার মধ্যে অন্যতম ছিল সারা মাঠ জুড়ে ১৭টি জায়ান্ট স্ক্রিনে ম্যাচের বিভিন্ন মুহূর্তের রিপ্লে দেখার সুযোগ, যে অভিজ্ঞতা দেশের ফুটবলপ্রেমী জনতার কখনও হয়নি।

কলকাতার মার্কি প্লেয়ার প্রাক্তন লিভারপুল তারকা লুই গার্সিয়ার লম্বা পাস পান ২৮ বছর বয়সি ইথিওপিয়ান ফরোয়ার্ড ফিকরু। মুম্বইয়ের দলের জার্মান ডিফেন্ডার মানুয়েল ফ্রেদরিখ ইন্টারসেপ্ট করার আগেই চিপ করে গোলকিপার সুব্রত পালের মাথার ওপর দিয়ে জালে বল জড়িয়ে দেন তিনি। হাবাসের দলের ফুটবলারদের ছোট ছোট পাসে খেলা সে দিন স্প্যানিশ ফুটবলের সুগন্ধে ভরিয়ে তুলেছিল যুবভারতী। সারা ম্যাচেই আতলেটিকো মাদ্রিদের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ক্লাবটির আধিপত্য ছিল দেখার মতো। অনেক বেশি সুযোগও তৈরি করে তারা। বলজিৎ সাইনি নিজেই পরপর দুটি সুযোগ পেয়ে তা নষ্ট করেন।

মুম্বই সিটি এফসি-র মার্কি প্লেয়ার ফরাসি তারকা নিকোলাস আনেলকার সেই ম্যাচে খেলার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে খবর এসে পৌঁছয় যে তিনি খেলতে পারবেন না। কারণ, তিনি তখন তিন ম্যাচের সাসপেনশনে ছিলেন। সেই সাসপেনশন হিরো আইএসএলেও প্রযোজ্য কি না, সেটাই আগে জানা যায়নি। সে দিনের ম্যাচের ঠিক আগে ফিফা থেকে জানানো হয়, এই ম্যাচেও সেই সাসপেনশন প্রযোজ্য। তাই তিনি এই ম্যাচে খেলতে পারেননি। যার জেরে মুম্বইয়ের দলের পুরো পরিকল্পনাই প্রায় ভেস্তে যায়।

শুধু আনেলকা নয়, প্রাক্তন আর্সেনাল তারকা সুইডেনের ফ্রেডরিক লিউংবার্গও সেই ম্যাচে খেলতে পারেননি চোটের জন্য। ফলে দুর্বল দল নিয়েই মাঠে নেমেছিল মুম্বই। তাও দ্বিতীয়ার্ধে ইতালিয়ান অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার আন্দ্রে মরিজকে এনে আক্রমণে ধার বাড়ানোর চেষ্টা করেন মুম্বই সিটি এফসি-র কোচ পিটার রিড। কিন্তু তাতে তেমন কাজ হয়নি। বিপক্ষের বক্সের বাইরে বিপজ্জনক জায়গায় ফ্রি কিক পেয়েও সুযোগ হাতছাড়া করে তারা। মুম্বই সিটি এফসি-র ডিফেন্ডার রাজু গায়কোয়াড় সে দিন অল্পের জন্য লাল কার্ড দেখা থেকে বেঁচে যান।

ম্যাচের শেষ দিকে কলকাতার দলের বাঙালি গোলকিপার শুভাশিস রায়চৌধুরির অনবদ্য জোড়া সেভ ক্লিন শিট বজায় রাখতে সাহায্য করে। ৪০ গজ দূর থেকে পাভেল কমোভসের জোরালো শট ও গোলের সামনে থেকে মানুয়েল ফ্রেদরিখের হেড অনবদ্য ভাবে সেভ করেন তিনি।

এর পরে সাত-সাতটা বছর পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু হিরো আইএসএলের প্রথম ম্যাচের সেই রোমাঞ্চকর পরিবেশ পরবর্তীকালে খুব কমই পাওয়া গিয়েছে।