অসময়ে তাঁর ফুটবল জীবনে ত্রাতা হয়ে উঠেছিল মোহনবাগান। সবুজ-মেরুন জার্সি গায়ে মাঠে নেমেই নিজের ফুটবল সত্ত্বা ফিরে পেয়েছিলেন। চরম দুঃসময় কাটিয়ে গত মরশুমে এটিকে-র জার্সিতেই ঘুরে দাঁড়িয়ে জীবনের সেরা মুহূর্তগুলো খুঁজে পান বাংলার তারকা উইং ব্যাক প্রবীর দাস। এই দুই ক্লাবের সংযুক্তিতে তাই তাঁর চেয়ে বেশি কেউ খুশি হননি বোধহয়। এটিকে ও মোহনবাগান হাত মেলানোর পরেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন, এই নতুন ক্লাবেই খেলবেন, ফের সবুজ-মেরুন জার্সি পরে আরও ভাল ফুটবল খেলতে চান। তবু আক্ষেপ একটা রয়েই গিয়েছে প্রবীরের। আইএসএলে ইস্টবেঙ্গলের মুখোমুখি হতে চান তিনি। 

“অসময়ে মোহনবাগান আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল। সে জন্য তাদের অনেক ধন্যবাদ। ২০১৫-য় মোহনবাগানে যোগ দেওয়ার পর থেকে লোকে আমাকে চিনেছে। এটিকে-র হয়ে জীবনের সেরা ফুটবল খেলায় এখন আমাকে আরও চিনেছে সবাই। মোহনবাগান আমাকে পরিচিতি দিয়েছে আর এটিকে-তে সেরা সময় কাটাচ্ছি। এ বার আমার অতীত ও বর্তমান মিলে গিয়েছে। দুই ক্লাব এক হয়ে যাওয়ায় এ বার আমি আরও ভাল খেলতে চাই। মাঠে নামার জন্য মুখিয়ে রয়েছি। কবে নামতে পারব, সেই দিকে তাকিয়ে আছি”, হিরো আইএসএলের ইনস্টাগ্রাম চ্যাটে কথাগুলি বলেন প্রবীর।    

তিনি চান কলকাতার আর এক প্রধানও আইএসএলে নামুক। বলেন, “হিরো আইএসএল ভারতের সেরা ফুটবল লিগ। এই লিগে কলকাতার দুই সেরা ক্লাবের মধ্যে একটা এসে যাওয়ায় আমি খুব খুশি। দুই ক্লাবের সমর্থকদের মধ্যে মাঠে রেষারেষি থাকলেও মাঠের বাইরে কিন্তু একে অপরের বন্ধু। আশা করি ইস্টবেঙ্গলও খেলবে আইএসএলে। দুই দল মাঠে আবার মুখোমুখি হবে। সেই দিনটার অপেক্ষায় রয়েছি আমি”।

ছোটবেলা থেকে আর্থিক অনটন, অসুস্থতা, চোট-আঘাতের বহু বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে প্রবীর এখন নিজেকে ফুটবল তারকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ভারতীয় দলের দোরগোড়ায় রয়েছেন তিনি। একাধিক কিংবদন্তি ফুটবলারের সান্নিধ্য পেয়েছেন প্রবীর। সেই প্রসঙ্গে ড্যানি আলভেজের এই ভক্ত বলেন, “জিকো, রবার্ট পিরেস, আন্দ্রে স্যান্টোসের সঙ্গে একই ড্রেসিং রুমে থাকার অভিজ্ঞতাটা দারুণ ছিল। আমার মতো খেলোয়াড়র কাছে স্বপ্নের মতো ছিল। পিরেস খুব ভাল, এখনও মেসেজ আদান-প্রদান হয়। জিকো স্যরও আমার প্রশংসা করেছিলেন। রবার্তো কার্লোসের সঙ্গে থেকে অনেক শিখেছি। অনেক সুযোগ পেয়েও শিখতে পারিনি। জিকো স্যর যে দিন আমাকে প্রথম খেলার সুযোগ দেন, তার আগের রাতে ঘুমোতেই পারিনি। পরের দিন মাঠে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। পরে আর সুযোগ পাইনি। পিরেস বলেছিল, তোমার সুযোগ আসবে। কিন্তু আমি হতাশায় ভুগতে শুরু করি। আসলে আগে অত পরিণত ছিলাম না। এখন অভিজ্ঞতা থেকে অনেক পরিণত হয়েছি”।

হিরো আইএসএলে চ্যাম্পিয়ন এটিকে দলে তাঁর দু’বার থাকার সৌভাগ্য হয়েছে। গত বার ও ২০১৬-র মরশুমে। তবে প্রথম বারের লিগ জয়ের চেয়ে দ্বিতীয় বারের সাফল্যই তাঁর কাছে বেশি স্মরণীয়। যে ভাবে ব্যর্থতা কাটিয়ে সাফল্যে ফিরে এসেছিলেন এবং সেই ঘুরে দাঁড়ানোয় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলেই এ বারের লিগ জয় তাঁর কাছে বেশি স্মরণীয় হয়ে উঠেছে। প্রবীর বলেন, “কলকাতায় দ্বিতীয় সেমিফাইনালে বেঙ্গালুরু যখন এগ্রিগেটে ২-০ এগিয়ে যায় তখন আমরা ঠিক করে নিই গোল খাওয়া তো যাবেই না, উপরন্তু ওদের চেয়ে বেশি গোল দিতেও হবে। ওই দিন যুবভারতীর গ্যালারিতে ৫০ হাজার সমর্থক ছিল। ওদের জন্যই ঘুরে দাঁড়ানোর মোটিভেশন পেয়ে যাই আমরা এবং ওদের জন্যই আমরা ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি পাই। আমার ক্রসে ডেভিড উইলিয়ামস অসাধারণ গোল করে ম্যাচটা জিতিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু ধন্যবাদ দিতে হবে সমর্থকদেরই। ওরা না থাকলে হয়তো সে দিন ও ভাবে জিতে ফাইনালে উঠতে পারতাম না আমরা”।

এ বার মোহনবাগান সমর্থকেরা তাঁদের পাশে থাকবেন ভেবে আরও বেশি রোমাঞ্চিত প্রবীর। বলেন, “এটিকে মোহনবাগান সমর্থকদের কাছ থেকে এ বার আরও বেশি সমর্থক পাব ভেবে খুব ভাল লাগছে। তবে এ বছর হয়তো গ্যালারিতে তাদের পাব না, পরের বছর থেকে আশা করি পাব। কিন্তু মাঠে না থাকলেও দূর থেকে তো সমর্থন করবেনই ওঁরা। সেটাও কম বড় মোটিভেশন নয়”।

 তবে গত বার সেমিফাইনাল ও ফাইনালে জয়ের চেয়ে প্রথম ম্যাচটা তাঁর কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে জানান ২৬ বছরের প্রবীর।  তাঁর মতে, “আইএসএল সেমিফাইনাল ও ফাইনাল সেরা মুহূর্ত ঠিকই। তবে অপারেশনের পরে চোট সারিয়ে ফিরে প্রথম ম্যাচটা ছিল আরও স্মরণীয়। কেরল ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচটার কথা বলছি। ৯০ মিনিট খেলতে পারব কি না, সেই ব্যাপারেই নিশ্চিত ছিলাম না। আমরা সে দিন হেরে গিয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু নিজেকে ফিরে পেয়ে খুবই ভাল লেগেছিল। পুরো এক বছর মাঠের বাইরে থাকার পরে ফিরে এসে টানা ৯০ মিনিট খেলাটা সহজ ছিল না। কিন্তু সেটা আমি পেরেছিলাম বলেই চিরকাল আরও মনে থাকবে”।

দু’বছর আগে পায়ে মারাত্মক চোট নিয়ে যখন রিহ্যাব শুরু করেন প্রবীর, তখন তাঁর ফুটবল জীবন ছিল অনিশ্চয়তায় ভরা। সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন তিনি। বলেন, “খুব খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল তখন। তবে জানতাম আমাকে ফিরতেই হবে, পরিবারকে দেখতে হবে। বেঙ্গালুরুতে গিয়ে বুঝলাম, কলকাতায় থেকে নিজেকে সারিয়ে তুলতে পারব না। কারণ, কলকাতায় থাকলে আরও হতাশ হয়ে যেতাম। সবার শুভেচ্ছা, আশীর্বাদ ছিল বলে ফিরে আসতে পেরেছি। পরিশ্রমও করতে হয়েছে তার জন্য। কিন্তু এটা আমার কাছে বিরাট একটা চ্যালেঞ্জ ছিল”।

এটিকে-র সংসারে তাঁর কাছের বন্ধুদেরও প্রশংসা করেছেন প্রবীর। গোলকিপার অরিন্দমের সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য, “প্রথম সেমিফাইনালে অরিন্দমের গ্রিপ থেকে বল পিছলে গিয়ে গোল হয়ে গিয়েছিল, আমারও একটা ভুল হয়েছিল। তাই ম্যাচের পরে ড্রেসিং রুমে আমরা হতাশ হয়ে বসেছিলাম। অরিন্দম কিন্তু ভেঙে পড়েনি। প্রত্যেকের কাছে এসে বলতে শুরু করল, ‘কোনও ব্যাপার না। পরের ম্যাচে আমি দেখে নেব, ওদের হারাবই’। ওর আত্মবিশ্বাস অসাধারণ, ওর সঙ্গে রুম শেয়ার করেছি, অনেক কিছু শিখেছি। দ্বিতীয় সেমিফাইনালে জেতার জন্য ওর অবদান যথেষ্ট ছিল, অনেক অবধারিত গোল বাঁচিয়েছিল সে দিন”।   

আর দলের দুই সেরা তারকা রয় কৃষ্ণা ও ডেভিড উইলিয়ামসের সঙ্গে বন্ধুত্ব নিয়ে প্রবীর বলেন, “দু’জনেই দারুণ স্ট্রাইকার, আমি আগে থেকেই ঠিক করে নিয়েছিলাম, ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতেই হবে। কিন্তু এমনিই হয়ে যায়। আমি জানি আমার পায়ে বল থাকলে রয়, ডেভিড কোথায় মুভ করবে। ওদের দুজনকেই ধন্যবাদ, এডু গার্সিয়াকেও। এ বার রয় যে দিন সই করে, তার আগেই আমাকে জানিয়েছিল। কিন্তু ও আমাকে খবরটা কাউকে জানাতে বারণ করেছিল, আমি কাউকে বলিনি। কারণ, আমরা দু’জনই খুব ভাল বন্ধু। বিশ্বাসটা তো বজায় রাখতেই হবে”।  

সবার মতোই প্রবীরেরও স্বপ্ন জাতীয় সিনিয়র দলের হয়ে খেলা। এই নিয়ে তাঁর মন্তব্য, “অবশ্যই এটা আমার স্বপ্ন। আমার আশা আমি এক দিন না একদিন ভারতীয় দলে ডাক পাব। তবে এখনই সেই নিয়ে বেশি ভাবছি না। যখন (ইগর) স্টিমাচ স্যর আমাকে ডাকবেন, তখন এই নিয়ে চিন্তা ভাবনা করব। ওখানে গেলে আমাকে অন্য লড়াই লড়তে হবে। তবে যাই হোক না কেন, সব সময়ই নিজেকে ফিট রাখতে হবে। এটাই শেষ কথা”।