লিগশিল্ড না জিততে পারায় এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলার সুযোগ হাতছাড়া হয়। পরে ফাইনালে হেরে চ্যাম্পিয়নের ট্রফিও হাতে তুলতে পারেননি এটিকে মোহনবাগান শিবিরের ফুটবলাররা। তাই সবাই মনমরা। জোড়া খেতাবের দোরগোড়ায় গিয়েও সেখান থেকে ফিরে আসার যন্ত্রণা এখন নিশ্চয়ই কুরেকুরে খাচ্ছে তাঁদের। এই যন্ত্রণা সামলাতে সময় লাগবে।

কিন্তু সবুজ-মেরুন বাহিনীর একজন সদস্যের সৌভাগ্য, দলের এই হতাশাজনক পারফরম্যান্সের স্মৃতি বয়ে বেড়ানোর সঙ্গে তিনি নিজের অসাধারণ সাফল্যের সুখস্মৃতিকেও একই সঙ্গে মনে জায়গা দিয়ে কিছুটা হলেও স্বস্তি পাচ্ছেন। তিনি আর কেউ নন, রয় কৃষ্ণা। হিরো আইএসএল ৭-এর ‘হিরো’

এটিকে মোহনবাগান সাফল্যের মুকুট জিততে না পারলেও তাদের সেরা তারকা রয় কৃষ্ণা যে খেলা দেখিয়েছেন, তাঁকে অসাধারণ বললেও বোধহয় কম বলা হয়। সারা লিগ জুড়ে যে দাপট ও ক্ষিপ্রতা দেখা গিয়েছিল এই ফিজিয়ান তারকা স্ট্রাইকারের পারফরম্যান্সে, তাতে এটিকে মোহনবাগানের প্রত্যেক প্রতিপক্ষ তাঁকে রীতিমতো সমীহ করে চলেছে। তাঁকে আটকানোর জন্য আলাদা করে বিশেষ পরিকল্পনা করতে হয়েছে প্রত্যেক কোচকে। যাঁদের পরিকল্পনা কার্যকরী হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে রয় হয়তো গোল পাননি, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁকে পুরোপুরি  আটকানোর সাধ্য হয়নি কারও। গোল করিয়ে নিজের কর্তব্য ঠিক পালন করেছেন।  

লিগ পর্বে এটিকে মোহনবাগান যে ক’টি গোল করেছে, তার অর্ধেকই রয়ের করা। তিনি স্ট্রাইকার, গোল করাই যে তাঁর কাজ, তা ঠিকই। কিন্তু রয়ের কাজ যে শুধু গোল করা নয়। তা তিনি বহুবার প্রমাণ করেছেন। আক্রমণ বিভাগে তিনি যেমন সর্বদা তৎপর, তেমনই মাঝমাঠের সঙ্গে আক্রমণের যোগসূত্র স্থাপন করার কাজটাও নিয়মিত করে এসেছেন রয়।

এমনকী, মাঝে মাঝে রক্ষণ বিভাগে নেমে এসে তাঁকে বিপক্ষের আক্রমণকারীদেরও সামলাতে দেখা গিয়েছে। সে ম্যাচের শুরুর দিকেই হোক বা শেষের দিকে। এ রকম একজন ফুটবলার সারা মাঠ দাপিয়ে বেড়ালে তাঁর সতীর্থরাও উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন। তাই যে কোনও কোচের কাছেই প্রিয় ফুটবলার হয়ে উঠতে পারেন রয়।

শুধু যে পায়ে গোল করা, তা নয়, হেডে গোল করতেও তিনি ওস্তাদ। এমন কিছু লম্বা নন ফিজির এই ভারতীয় বংশোদ্ভূত স্ট্রাইকার। যে স্ট্রাইকাররা সাধারণত দীর্ঘেদেহী হন না, তাঁরা উড়ে আসা বলে তেমন বিপজ্জনকও হয়ে ওঠেন না। তবে রয় কৃষ্ণার ক্ষেত্রে সে কথা প্রযোজ্য নয়। তাঁর হেডে গোল দেওয়ার প্রবণতা কিন্তু যথেষ্ট। বেশ কয়েকবার নিজের চেয়েও বেশি উচ্চতার ডিফেন্ডারদের ছাপিয়ে হেডে গোল করার চেষ্টাও করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। এ মরশুমে হেডে গোল দিয়ে দলকে জিতিয়েছেনও তিনি।

তা ছাড়া শুধু এক পায়ে নয়, এই মরশুমে দেখা গিয়েছে, দুই পায়েই তিনি সমান ভাবে বল নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, এমনকী জোরালো শটও নিতে পারেন। এ বারের হিরো আইএসএলের প্রথম কলকাতা ডার্বির কথা মনে করে দেখুন। সেই ম্যাচেও বাঁ পায়ে গোল করেছিলেন তিনি।

বাঁদিকের উইং দিয়ে জয়েশ রানে উঠে এসে ফাঁকায় থাকা হাভি হার্নান্ডেজকে বল দেন। তিনি বিপক্ষের এক ডিফেন্ডারকে বোকা বানিয়ে পাস দেন রয়কে। এসসি ইস্টবেঙ্গলের ডিফেন্ডার ড্যানিয়েল ফক্স তাঁকে আটকানোর চেষ্টা করেও পারেননি। তাঁর পায়ের তলা দিয়েই রয় দূরপাল্লার যে শটে ঝড়ের গতিতে বল পাঠান সোজা গোলে, সেই শট ছিল বাঁ পায়েই।

সব ম্যাচেই যে তিনি গোল পেয়েছেন, তা নয়। লিগে এমনও হয়েছে, টানা তিনটি ম্যাচে গোল পাননি তিনি। নক আউট পর্বেও একই ঘটনা ঘটেছে।  কিন্তু সেই হতাশা কাটিয়ে গোলের চেষ্টার ত্রুটি দেখা যায়নি তাঁর মধ্যে। ছটফট করেছেন গোল পাওয়ার জন্য। গোল না পেয়ে ভেঙেও পড়তে দেখা গিয়েছে তাঁকে। কিন্তু নিজেকে সামলে ফের চাঙ্গা করে পরের ম্যাচেই মাঠে নেমে পড়েছেন স্বমহিমায়। নিজের খারাপ দিনেও তিনি কোনও না কোনও ভাবে দলকে সাহায্য করেই থাকেন।

এটিকে মোহনবাগানের স্প্যানিশ কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাস সাধারণত তাঁর দলের কোনও একজন ফুটবলারকে নিয়ে সাংবাদিকদের সামনে মন্তব্য করেন না। রয়ের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলেও মাঝে মাঝে তিনি এড়িয়ে গিয়েছেন। কিন্তু প্রত্যেকবারেই তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। লিগের শেষ দিকে একবার তিনি বলেন, “গত মরশুমের মতোই রয় এ বারও আমার দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। প্রথম কয়েকটা ম্যাচে ও নিজের সেরাটা দিতে পারেনি। কারণ, ছ’মাস ফুটবলের বাইরে ছিল ও। কিন্তু এখন ও আমার কাছে লিগের সেরা খেলোয়াড়”।

গোল না করেও যে তিনি দলের সাফল্যে অবদান রাখতে পারেন, তার উদাহরণ রয় দেন নক আউট পর্বে। তিনটি ম্যাচে কোনও গোল পাননি তিনি। কিন্তু এই তিন ম্যাচে যে চারটি গোল পেয়েছে সবুজ-মেরুন ব্রিগেড, তার প্রত্যেকটাতেই ‘অ্যাসিস্ট’ করেছেন তিনি। লিগ পর্বেও চারটি খুব গুরুত্বপূর্ণ গোলেও সাহায্য করেন তিনি। ১৪টি গোলের সঙ্গে তাই আটটি ‘অ্যাসিস্ট’-ও জমা হয় তাঁর পারফরম্যান্সের খতিয়ানে। অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছে মোট ৩২টি গোলের মধ্যে সব মিলিয়ে ২২টিতেই তাঁর অবদান ছিলই। সে প্রত্যক্ষভাবেই হোক বা পরোক্ষভাবে।

তবে যারা সত্যিকারের বড় খেলোয়াড় হয়, তারা সবচেয়ে বেশি শিক্ষা নেয় তাদের ভুল থেকে। রয় কৃষ্ণাও নিশ্চয়ই যেটুকু ভুল-ভ্রান্তি করেছেন, তা থেকে শিক্ষা নিয়েই এ বারের চেয়েও আরও উজ্জ্বল হয়ে ফিরে আসবেন পরবর্তী মরশুমে। আশা করা যায়, পরেরবার যে রয়কে দেখা যাবে, তিনিই হবেন সবার দেখা সেরা রয় কৃষ্ণা। হয়তো আগামী বারও তিনি হবেন লিগের ‘হিরো’। সেই খেতাবের সঙ্গে তাঁর হাতে হয়তো থাকবে চ্যাম্পিয়নের ট্রফি বা লিগশিল্ডের মধ্যে যে কোনও একটা, বা হয়তো দুটোই। ভবিষ্যতের কথা কে বলতে পারে?