সুনীল ছেত্রীর পর ভাল মানের ভারতীয় ফরোয়ার্ড কোথায়? এই প্রশ্নে যখন সরগরম দেশের ফুটবলমহল, তখন হিরো আইএসএল ২০২০-২১-এ দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়ে সেই প্রশ্নের জবাব দেন এটিকে মোহনবাগানের পঞ্জাবী ফরোয়ার্ড মনবীর সিং। গত হিরো আইএসএলে একাধিক অসাধারণ ও গুরুত্বপূর্ণ গোল করে নিজেকে সবুজ-মেরুন শিবিরের অন্যতম নির্ভরযোগ্য সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি।

ভারতীয় ফুটবলারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গোল ছিল সুনীলের। আর সেই তালিকায় তার পরেই ছিল মনবীরের  নাম। ছ’টি গোল করে ও তিনটিতে সহায়তা দিয়ে তিনি গত মরশুমে দেশের এক নম্বর ফুটবল লিগের অন্যতম সেরা তারকা হয়ে ওঠেন। তাঁর এই উন্নতি এটিকে মোহনবাগানে আসার পর থেকেই। এফসি গোয়ার হয়ে তিন মরশুমে তিনি যতক্ষণ (১২৯৪ মিনিট) মাঠে থাকার সুযোগ পেয়েছেন, তার চেয়ে অনেক বেশিক্ষণ (১৪৮৬ মিনিট) খেলেছেন কলকাতার ক্লাবের হয়ে এই এক মরশুমে।   

আপাতত সুনীল ছেত্রীর পরে সেরা ভারতীয় ফরোয়ার্ড ২৫ বছর বয়সি এই তারকাই। কিন্তু কতটা তৈরি তিনি? সত্যিই কি পারবেন সুনীলের মতো গোলমেশিন হয়ে উঠতে? এখন আবার মনবীরকে নিয়ে এই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

হিরো আইএসএলে তাঁর অনবদ্য পারফরম্যান্সের জন্য ভারতীয় দলে মনবীর ছিলেন জাতীয় কোচ ইগর স্টিমাচের কাছে ‘অটোমেটিক চয়েস’। দোহায় চলতি বিশ্বকাপ ও এশিয়ান কাপ বাছাই পর্বের দুই ম্যাচেই তিনি প্রথম এগারোয় ছিলেন সুনীলের সঙ্গে। তবে যতটা ভাল পারফরম্যান্স তাঁর কাছ থেকে আশা করা হয়েছিল, ততটা দিতে পারেননি তিনি।

প্রথম ম্যাচে কাতারের বিরুদ্ধে প্রথমার্ধে বল নিয়ে বিপক্ষের বক্সে ঢুকে পড়েছিলেন মনবীর। কিন্তু কাতারি মিডিফিল্ডার বুয়ালেমের বাধায় শেষ পর্যন্ত সেই বল চলে যায় গোলকিপার সাদের হাতে। দ্বিতীয় ম্যাচে শুরুর দিকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গোলের ভাল সুযোগ পেয়েছিলেন মনবীর। বাঁদিকের উইং দিয়ে বিপক্ষের বক্সে ঢুকে ৪৫ ডিগ্রি কোণ থেকে বল নিজে গোলে না রেখে ক্রস করেন ব্রেন্ডন ফার্নান্ডেজের উদ্দেশ্যে। কিন্তু ব্রেন্ডনের কাছে বল পৌঁছনোর আগেই তা এক বাংলাদেশী ডিফেন্ডারের পায়ে আটকে যায়।

হিরো আইএসএলেও এমন একাধিক সুযোগ নষ্ট করেছেন তিনি এবং এই সুযোগ পেয়েও তা হাতছাড়া করাটাকেই নিজের অন্যতম প্রধান দুর্বলতা বলে মনে করেন মনবীর সিং। সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা স্বীকার করে বলেন, “ফরোয়ার্ডদের কাছে বারবার সুযোগ আসে না। কোনও কোনও ম্যাচে হয়তো সব মিলিয়ে একটা সুযোগ পাওয়া গেল। কোনও ম্যাচে আবার একটা হাফ চান্স পাওয়া যায়। সেই একটা সীমিত সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে তবেই নিজের দক্ষতার প্রমাণ দেওয়া যায়”।

সুনীল ছেত্রীর পাশে খেলে নিজের ভুলগুলো শোধরানোর চেষ্টা করছেন বলে জানান মনবীর। বলেন, “ভাল স্ট্রাইকারদের পাশে খেললে নিজের কাজটা অনেক সোজা হয়ে যায়। এই যে সুনীল-ভাইয়ের পাশে খেলছি, তাতে ওকে অনুসরণ করার চেষ্টা করছি। বিশেষ করে গোলের সামনে মাথা ঠাণ্ডা রাখার ব্যাপারে। অবশেষে ওই ঠাণ্ডা মাথাটাই তো ফারাক গড়ে দেয়। আর এটাই আমার কাছে বড় শিক্ষা। একটা ম্যাচে একজন ফরোয়ার্ডের কয়েক লক্ষ সুযোগ জোটে না। এই ব্যাপারে আরও একজনকে অনুসরণ করি আমি, রয় কৃষ্ণা। এই দু’জনই আমার হিরো”।

শুধু স্ট্রাইকার হিসেবে নয়, মনবীর উইঙ্গার হিসেবে খেলতেও অভ্যস্ত। এই জায়গাটা তাঁকে স্ট্রাইকার হিসেবে উন্নতি করতে সাহায্য করেছে বলে জানান তিনি। বলেন, “ডান ও বাঁ—দুই উইংয়েই খেলেছি আমি। এর ফলে আক্রমণের ধরন ও দর্শন বুঝতে অনেক সুবিধা হয়েছে আমার। যে কোনও খেলোয়াড়ের কাছেই এটা একটা প্লাস পয়েন্ট”।

মনবীরের বাবা কুলদীপ সিংও ফুটবলার ছিলেন ও তিনিও এক সময়ে সুনীল ছেত্রীর বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছেন। তাই বাবার কাছ থেকেও সুনীলকে অনুসরণ করার পরামর্শ পেয়েছেন তিনি। নিজেই এ কথা জানিয়ে মনবীর এই সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমার বাবা পিএসইবি-র হয়ে খেলতেন স্ট্রাইকার হিসেবে। সুনীল-ভাইয়ের বিরুদ্ধেও খেলেছেন এক সময়। বাবাই বলেন, সুনীল-ভাইয়ের কাছ থেকে শেখা উচিত, কী করে এত দিন ধরে ফুটবল খেলতে হয়। বাবার পরামর্শ হল, ‘সুনীলকে যখন এত কাছ থেকে অনুসরণ করার সুযোগ পাচ্ছিস, তখন ওর কাছ থেকে যতটা পারিস শিখে নে। এত দিন ধরে খেলে যাওয়াটাই ওর বিশেষত্ব। এটা কঠিন পরিশ্রম ছাড়া সম্ভব নয়’। আমি সেই চেষ্টা শুরু করে দিয়েছি। বাকিটা আমার ওপর”।

মনবীর মনে করেন, একজন স্ট্রাইকারের কাছে তাঁর আত্মবিশ্বাসই প্রধান সম্বল এবং যত বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ পায় সে, তত বেশি আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে পারে সে। তাই নিজেকে উন্নত করে তুলতে যথাসম্ভব ম্যাচ খেলতে চান তিনি।