দেশের এক নম্বর ফুটবল লিগ হিরো আইএসএলে অভিষেকেই খেতাবের দোরগোড়ায় এটিকে মোহনবাগান। যা তাদের গর্বের বিষয় হয়ে উঠতেই পারে। আর চ্যাম্পিয়ন হলে তো কথাই নেই। ক্লাবের ইতিহাসে এই কীর্তি এক মাইলফলক হয়ে রয়ে যাবে।

সেমিফাইনালের দুই লেগে নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি-কে সব মিলিয়ে ৩-২-এ হারিয়ে ফাইনালে মুম্বই সিটি এফসি-র দল। অর্থাৎ গঙ্গাপাড়ের দল ও সাগরপাড়ের দল একে অপরের মুখোমুখি হতে চলেছে হিরো আইএসএল ৭-এর চ্যাম্পিয়নের খেতাব জিততে।

কারা জিততে পারে, কারা এগিয়ে, কারা পিছিয়ে তা নিয়ে এখন জল্পনা চলছে। চলবে আগামী শনিবার সন্ধ্যা ফাইনাল শুরুর আগে পর্যন্ত। কিন্তু যে ভাবে ধাপে ধাপে চ্যাম্পিয়নশিপের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে কলকাতার দল, তা নিয়েও অনেক আলোচনা হতে পারে।

এ বারের হিরো আইএসএল এমন একটা পরিস্থিতিতে হচ্ছে, যাকে আর যাই হোক স্বাভাবিক পরিস্থিতি বলা যায় না। মারণ ভাইরাস কোভিড-১৯-এর থাবা যখন প্রায় সারা বিশ্বকে গ্রাস করে নিতে চাইছিল, তখন সবার আগে খেলার দুনিয়াই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে জেহাদ ঘোষণা করে। বিশেষ করে ফুটবল বিশ্ব।

ইউরোপে বিভিন্ন ফুটবল লিগ শুরু হয় করোনাবিধি মেনে। জৈব সুরক্ষা বলয় তৈরি করে বেশিরভাগ ম্যাচ এক বা দু’টি ভেনুতে করে অপূর্ণ লিগগুলোকে এক এক করে শেষ করা হয়। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের এক মরশুম শেষ হয়ে আবার শুরুও হয়ে যায় এর মধ্যেই। একই ভাবে ইংল্যান্ডে শুরু হয়ে যায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটও।

তাদের পথ অনুসরণ করেই ভারতেও শুরু করা হয় হিরো ইন্ডিয়ান সুপার লিগের সপ্তম মরশুম। গোয়াকে বেছে নেওয়া হয় লিগের একমাত্র কেন্দ্র হিসেবে। একাধিক দেশ থেকে চার্টার্ড বিমানে উড়িয়ে আনা হয় বিভিন্ন দলের বিদেশি ফুটবলারদের। তাদের প্রত্যেককে ১৪ দিনের কোয়ারান্টাইনে রাখা হয়। তার পর শুরু হয় প্রস্তুতি।

সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে এটিকে মোহনবাগান ফুটবলারদের গোয়ায় আগমন শুরু হয় এবং অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে তাদের অনুশীলন শুরু হয়। প্রায় এক মাসের অনুশীলনের পরে হিরো আইএসএলের অভিযান শুরু করে এটিকে মোহনবাগান।

গত বারের চ্যাম্পিয়ন এটিকে এফসি-র প্রথম দলের ১৩ জন ফুটবলারকে এই দলে রাখেন স্প্যানিশ কোচ হাবাস। তাঁর সঙ্গে এই ১৩ জনের যে বোঝাপড়া গড়ে উঠেছিল গতবার, সেই বোঝাপড়া এ বারেও দারুন ভাবে দলের সাফল্যে কাজে লাগে। এ ছাড়াও ডিফেন্ডার সন্দেশ ঝিঙ্গন, তিরি ও শুভাশিস বসুকে নিয়ে আসা হয় রক্ষণের শক্তি বাড়ানোর জন্য। তরুণ মিডফিল্ডার শেখ সাহিল ও অভিজ্ঞ ফরোয়ার্ড মনবীর সিংকেও আনা হয় আক্রমণে ধার বাড়ানোর জন্য। 

কিন্তু এই ১৩ জনের মধ্যে একজন প্রথম ম্যাচেই চোট পেয়ে ছিটকে যান। কেরালা ব্লাস্টার্সের এক ফুটবলারের সঙ্গে মারাত্মক সংঘর্ষে এতটাই গুরুতর চোট লাগে মাইকেল সুসাইরাজের, যে পুরো লিগ থেকেই ছিটকে যান সুসাইরাজ। প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ট সময় না পাওয়ায় ও কম সময়ের মধ্যে অনেক ম্যাচ খেলতে হওয়ায় এ বার সারা মরশুমেই দলের ফুটবলারদের চোটসমস্যা নিয়ে দফায় দফায় ভুগতে দেখা গিয়েছে প্রায় সব দলকেই। এটিকে মোহনবাগানও সেই সমস্যা থেকে রেহাই পায়নি।

এডু গার্সিয়া, হাভিয়ে হার্নান্ডেজ, ডেভিড উইলিয়ামস, কার্ল ম্যাকহিউরা প্রত্যেকেই চোট পেয়ে কোনও না কোনও সময় টানা ম্যাচ খেলতে পারেননি। তবু বাধা সত্বেও লিগে তিন ম্যাচ বাকি থাকতেই সেরা চারে জায়গা পাকা করে নেয় এটিকে মোহনবাগান।

কলকাতা ডার্বির দুই লেগেই তারা চিরপ্রতিদ্বন্দী এসসি ইস্টবেঙ্গলকে হারায়। ওডিশা এফসি-কে ৪-১ গোলের ব্যবধানে হারায় তারা এবং গত মরশুমে মোহনবাগানকে আইলিগ জেতানো কোচ কিবু ভিকুনার প্রশিক্ষণাধীন কেরালা ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে পিছিয়ে গিয়েও শেষ পর্যন্ত ৩-২ জয় পায় সবুজ-মেরুন ব্রিগেড। এক নম্বরে থেকে শেষ করতে পারলে তা হত সোনায় সোহাগা। কিন্তু তাদের দুর্ভাগ্য শেষ দুই ম্যাচে ঠিক সময়ে জ্বলে উঠতে পারল না তারা। তার আগের পাঁচ ম্যাচে জেতার পরেও শেষ দুই ম্যাচে না জিততে পারায় দুই নম্বরেই থেকে যেতে হয় তাদের।

সেমিফাইনালেও প্রথমে হোঁচট। প্রথম লেগে নর্থইস্ট ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এক গোলে এগিয়ে থাকার পরেও গোল খেয়ে প্রায় হাতের মুঠোয় আসা জয় হাতছাড়া হয় তাদের। তবে মঙ্গলবার দ্বিতীয় লেগের ম্যাচে সামলে নেয় হাবাসের দল। এ বারের লিগের অন্যতম সেরা পারফরম্যান্স দিয়ে ম্যাচটা ২-১ গোলে জিতে নেয় তারা।

দু’বার দলকে আইএসএল ফাইনালে তুলে সফল হয়েছেন যিনি, সেই স্প্যানিশ কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের ফুটবল মস্তিষ্ককে সমীহ করেন সবাই। কোন সময়ে কোন কৌশল অবলম্বন করতে হবে, তা তাঁর মতো ভাল খুব কম কোচই বোঝেন। তা ছাড়া, কোন খেলোয়াড়কে কী ভাবে ব্যবহার করলে তার কাছ থেকে সেরাটা বার করে নেওয়া যাবে, তাও খুবই ভাল বোঝেন প্রাক্তন বলিভিয়া কোচ।

এ বারেই এটিকে মোহনবাগানে যোগ দেওয়া পঞ্জাবি ফরোয়ার্ড মনবীর সিং যেমন হিরো আইএসএলের ওয়েবসাইটকে বলেছেন, “আমার কাছে হাবাস স্যরই সেরা কোচ। ওঁর পরিকল্পনা একেবারে নিখুঁত হয়। উনি খুব ভাল করে জানেন, কখন আক্রমণ করা উচিত বা কী ভাবে ডিফেন্ড করা দরকার। যে খেলোয়াড়রা বেঞ্চে বসে থাকে, তাদের কী ভাবে খুশি রাখতে হয়, সেও উনি খুব ভাল করে জানেন। উনিই সেরা কোচ”।

গত তিন মরশুমে মনবীর ছিলেন এফসি গোয়ায়। ৪৭টি ম্যাচে খেলেন তিনি। এর মধ্যে মাত্র সাতটি ম্যাচে প্রথম দলে ছিলেন তিনি। রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে মাঠে নেমে একাধিক গোল করেছেন মনবীর। কিন্তু গোয়ার দলের নিয়মিত খেলোয়াড় হিসেবে কোনও দিন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। এটিকে মোহনবাগানে এসে তাঁর সেই স্বপ্নই পূরণ করেন হাবাস।

মনবীর এখন দলের অন্যতম সেরা নির্ভরযোগ্য ফরোয়ার্ড, যিনি ছটি গোল করেছেন ও তিনটি করিয়েছেন। হাবাসের হাতে পড়েই তিনি নিজের সেরাটা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন বলে মনে করেন মনবীর। তিনি বলেন, “এটাই আমার সেরা মরশুম। গোল করেছি, করিয়েছি। মিনার্ভা পঞ্জাবের (এখন রাউন্ডগ্লাস মিনার্ভা) হয়ে খেলাটা এই মরশুমে আমাকে খুবই সাহায্য করেছে। প্রতিটি ট্রেনিং সেশনে আমি একশো শতাংশ দিই। সেটা ম্যাচেই নিশ্চয়ই বুঝতে পারে সবাই”।

প্রাক্তন ফুটবল তারকা সুব্রত ভট্টাচার্য বুধবার হাবাসের কৌশলের প্রশংসা করে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-য় নিজের কলামে লিখেছেন, “হাবাস জানতেন, প্রথম বারের মতো দ্বিতীয় সেমিফাইনালেও রয় কৃষ্ণাকে ফাঁকা জায়গা দেবে না বিপক্ষ। তাই ৪-৪-২ ছকে নামলেও আসলে হাবাস খেলালেন ৪-৪-১-১ ছকে, যাতে ডেভিড উইলিয়ামসের একটু পিছন দিক থেকে খেলতে পারে কৃষ্ণা। ফলে ডিলান ফক্সরা আগের দিনের মতো কৃষ্ণাকে ধরতে পারেনি। এটিকে মোহনবাগানের দুই গোলেরই মূল্যবান পাস বাড়ায় এই কৃষ্ণা। মাঠের মধ্যে পঞ্চাশ শতাংশ ফারাক গড়ে দেয় এই ফরোয়ার্ড। বাকি পঞ্চাশ শতাংশ ফারাক গড়লেন হাবাস”।

মুম্বই সিটি এফসি-র ক্ষুরধার মস্তিষ্কের কোচ সের্খিও লোবেরার সঙ্গে কৌশলের লড়াই হাবাসের। সেই লড়াইয়ে তিনি কী ভাবে বাজিমাত করবেন, এটা যতটা না দেখার বিষয়, তার চেয়েও বড় আকর্ষণীয় ব্যাপার হল, চার মাসের মরশুমের শেষে ফাইনালে তাঁর দলের ক্লান্ত খেলোয়াড়দের সেরাটা বার করে নেওয়ার জন্য তিনি কী কী করবেন।