এক বছরেরও বেশি সময়ের অপেক্ষার পর ভারতীয় ফুটবল দলকে মাঠে দেখা যাবে বৃহস্পতিবার, দুবাইয়ের মাকতুম বিন রশিদ মাকতুম স্টেডিয়ামে। এশিয়ার অন্যতম সেরা দল ওমানের বিরুদ্ধে ফ্রেন্ডলি ম্যাচে নামছে তারা। বিশ্বজোড়া কোভিড সন্ত্রাস শুরুর আগে ২০১৯-এর নভেম্বরে নীল জার্সির ফুটবলারদের শেষ মাঠে দেখা গিয়েছিল।

এক বছরেরও বেশি সময় পর মাঠে নামলেও খুব একটা অচেনা প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হচ্ছে না ভারতীয় দল। তারা যে প্রতিপক্ষ হিসেবে বেশ কঠিন, তা জেনেশুনেই বৃহস্পতিবার দুবাইয়ে দর্শকহীন ম্যাচে খেলতে নামবেন প্রীতম কোটাল, সন্দেশ ঝিঙ্গন, অনিরুদ্ধ থাপা, মনবীর সিং, ইশান পন্ডিতারা। ২০১৯-এ দু’বার তারা মুখোমুখি হয়েছিল বিশ্বের ৮১ নম্বর দলের। ঘরের মাঠে ভারত হেরেছিল ১-২ ব্যবধানে ও ওমানে গিয়েও হারতে হয়েছিল ০-১-এ। এই দুই ম্যাচ থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাই বৃহস্পতিবারের ম্যাচে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে ভারতীয় দল।

এক ঝাঁক নতুন মুখের চ্যালেঞ্জ

সদ্যসমাপ্ত হিরো আইএসএলের আসর থেকে সফল ভাবে উঠে আসা এক ঝাঁক মুখ দেখা যাবে দুবাইয়ের মাঠেও। হিরো আইএসএলের মতো বিশ্বমানের টুর্নামেন্টে সাফল্যের পরে আন্তর্জাতিক স্তরের ফুটবলের সঙ্গে তাঁরা কী ভাবে মানিয়ে নিতে পারেন, সেটাই দেখার বিষয় হতে চলেছে ভারতীয় দলের এই দুবাই সফরে, যেখানে তারা আরও একটি ম্যাচ খেলবে সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর বিরুদ্ধে।

ক্রোয়েশিয়ার প্রাক্তন বিশ্বকাপর ইগর স্টিমাচ ভারতীয় দলের কোচ হয়ে আসার পর থেকে ভারতীয় দল পাসিং ফুটবল ও পজেশনাল ফুটবলের দিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। সম্ভবত সেই একই ফুটবল দর্শনেই এই দলকেও ওমানের বিরুদ্ধে খেলাবেন তিনি। হিরো আইএসএলের নতুন চ্যাম্পিয়ন মুম্বই সিটি এফসি-র দুই মিডফিল্ডার রাওলিন বোর্জেস ও রেইনিয়ে ফার্নান্ডেজের ওপর তাই তাঁকে অনেকটাই নির্ভর করতে হতে পারে। কারণ, ওই দলেও এই ধরণের ফুটবলই খেলে এসেছেন এই দুই ফুটবলার।

চেন্নাইন এফসি-র অনিরুদ্ধ থাপাও মাঝমাঠে মনে ছাপ ফেলার মতো পারফরম্যান্স দেখানোর জন্য তৈরি। তাঁরই ক্লাবদলের সতীর্থ লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতে ওমানের রক্ষণের দুই প্রান্তে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারেন। আক্রমণ বিভাগে অসুস্থ সুনীল ছেত্রীর অনুপস্থিতিতে কতটা ধারালো হয়ে উঠতে পারেন মনবীর, পন্ডিতা, লিস্টন কোলাসোরা, সেটাও আকর্ষণীয় বিষয়। হিরো আইএসএলে মনবীর ও পন্ডিতা যে রকম স্মরণীয় সাফল্য পেয়েছেন, তাতে তাঁদের ওপরই নজর থাকবে বেশি।

স্টিমাচের প্রথম দলে সম্ভবত সন্দেশ ঝিঙ্গন (এটিকে মোহনবাগান) ও আদিল খানকে (এফসি গোয়া) সেন্টার ফরোয়ার্ডের ভূমিকায় দেখা যাবে। সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে দল বাছলে ঝিঙ্গনের ক্লাব সতীর্থ প্রীতম কোটালেরও প্রথম এগারোয় থাকা উচিত রাইট ব্যাক হিসেবে। এ বারের হিরো আইএসএলের অন্যতম সেরা আবিষ্কার ১৯ বছর বয়সি আকাশ মিশ্রকেও শুরু থেকে প্রীতমের বিপরীত প্রান্তে দেখা যেতে পারে।

তারুণ্যে ঠাসা নীল-বাহিনী

শেষবার মাঠে নামা ভারতীয় দলের সঙ্গে এ বারের দলের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হল গড় বয়সের। ভারতীয় দলের ফুটবলারদের গড় বয়স ২৪ থেকে ২৫-এর মধ্যে। মোট ২৭ জনের মধ্যে ১৩ জনেরই বয়স ২৫-এর কম। এর মধ্যে দু’জন আবার ১৯ বছরের। এত কমবয়সের ফুটবলারদের নিয়ে বোধহয় এর আগে মাঠে নামেননি কোনও ভারতীয় কোচ। আকাশ মিশ্রর কথা তো আগেই জানানো হয়েছে। তাঁর সমবয়সি জিকসন সিংও রয়েছেন এই দলে। দু’জনেই দেশের সিনিয়র দলের জার্সি গায়ে মাঠে নামার জন্য মরিয়া। সুযোগ পেলে তা কাজে লাগাবেনই, জানিয়েছেন এআইএফএফ মিডিয়াকে।

হিরো আইএসএলের সেরা উঠতি তারকার খেতাব পাওয়া ২০ বছরের লালেঙমাউইয়া, যাঁকে সবাই আপুইয়া বলেই চেনেন, তিনিও আত্মবিশ্বাসে টগবগ করে ফুটছেন। বলেছেন, “সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারলে সাফল্য পাব না কেন?” অনুশীলনে কয়েক দিন ধরে এই তরুণের দলকে দেখার পরে ভারতীয় কোচ স্টিমাচের বক্তব্য, “প্রত্যেকটা ছেলেই খুব ভাল এবং যথেষ্ট প্রতিভাবান। কারও মধ্যেই কোনও ভয় নেই। নির্ভুল পাস করে ওরা। আমার কাজ ওদের সঠিক দিশা দেখানো, যাতে ভারতীয় ফুটবলকে ওরা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে”।

মিডফিল্ডার সুরেশ সিংয়ের বয়সও আপুইয়ার মতোই, ২০। মাঝমাঠের আর এক প্রহরী ইয়াসির মহম্মদ, ফরোয়ার্ড লিস্টন কোলাসো ও ইশান পন্ডিতা, গোলকিপার ধীরজ সিং, এঁদের সবার বয়স ২২। তাই শিবিরে অনিরুদ্ধ থাপা, ছাঙতে, যাঁরা ২৩-এর, তাঁরাই এখন ‘দাদা’। তাই ভারতীয় ফুটবল দলের সংসারে একাত্মতা ব্যাপারটা আগের চেয়ে এ বার অনেক ভালমতোই থাকবে বলে আশা করা যায়।

তৃতীয় জয়ের লক্ষ্যে মরিয়া

গত দু’বারের জয়ের পরে ওমান এ বার ভারতের বিরুদ্ধে তৃতীয় জয় তুলে নেওয়ার ব্যাপারে মরিয়া হয়েই যে মাঠে নামবে, এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ফ্রেন্ডলি ম্যাচ হলেও এতে বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব দেখানোর ব্যাপারে তারা বিন্দুমাত্র উৎসাহী হবে বলে মনে হয় না। ফিফার বিশ্ব ক্রমতালিকায় ভারতের চেয়ে ২৩ ধাপ ওপরে থাকা ওমান ২০১৯-এ এএফসি এশিয়ান কাপের সেরা ১৬-র রাউন্ডে পৌঁছয়। এটাই এখন পর্যন্ত তাদের সেরা পারফরম্যান্স।

তাদের দুই ফরোয়ার্ড আব্দুল আজিজ আল মুকবলি ও মুহসেন আল ঘাসানিদের আটকানো ভারতীয় ডিফেন্ডারদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে আল মুকবলি বেশি বিপজ্জনক। তাঁকে গোল এরিয়ায় অল্প জায়গা ছাড়া মানেই বিপদ ডেকে আনা। বিপক্ষের যে কোনও রকম ভুলকেই কাজে লাগানোর ব্যাপারে এঁরা দু’জনেই ওস্তাদ।

ডিফেন্ডার সাদ সুহেল আল মুখাইনি রক্ষণে বড় ভরসা। আল নাসেরের প্রাক্তন ফুল ব্যাক এমনিতে যে কোনও জায়গাতেই খেলতে পারেন। তবে সাধারণত রাইট ব্যাকের জায়গায় খেলতেই পছন্দ করেন তিনি। মিডফিল্ডার আহমেদ মোবারক কানো দলের মাঝমাঠের সবচেয়ে বড় ভরসা। মাঝমাঠের লড়াইয়ে তিনি দলকে এগিয়ে রাখতে পারেন একাই। ২০০৬ বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ারে কোচিতে ভারতের বিরুদ্ধে ওমানের ৫-১ জয়ে জোড়া গোল করেছিলেন এই কানো। তখন তিনি উঠতি তারকা ছিলেন। এখন প্রতিষ্ঠিত ও অনেক অভিজ্ঞ। এখন তাঁকে আটকানো মোটেই সোজা নয়।   

অতিমারির পরে তাদের নতুন কোচ ব্রাঙ্কো ইভানকোভিচের প্রশিক্ষণে গত শুক্রবার জর্ডানের বিরুদ্ধে তারা প্রথম মাঠে নামে ও গোলশূন্য ড্র করে। গত দু’বার ভারতকে হারানোর আগে এই আমিরশাহীর মাঠেই ভারতের বিরুদ্ধে গোলশূন্য ড্র করেছিল তারা। সব মিলিয়ে ওমানের বিরুদ্ধে মোট ন’টি ম্যাচ খেলেছে ভারত। এখন পর্যন্ত একবারও জয় পায়নি তারা। ড্র হয়েছে দু’বার। ওমান জিতেছে সাতবার। ভারতকে এ পর্যন্ত ২২ গোল দিয়েছে তারা। ভারত দিয়েছে পাঁচ গোল। এ বার ওমানের বিরুদ্ধে প্রথম জয়ের মুখ দেখতে পারে কি না ভারত, সেটাই দেখার। কারণ, ইগর স্টিমাচ প্রায়ই বলে থাকেন, “ভারতীয় দলকে হারানো মোটেই সোজা নয়”।

ভারতীয় দল:

গোলকিপার – গুরপ্রীত সিং সান্ধু, অমরিন্দর সিং, শুভাশিস রায়চৌধুরী, ধীরজ সিং,

ডিফেন্ডার – আশুতোষ মেহতা, আকাশ মিশ্র, প্রীতম কোটাল, সন্দেশ ঝিঙ্গন, চিঙলেনসানা সিং, আদিল খান, মন্দার রাও দেশাই, মাশুর শেরিফ,

মিডফিল্ডার – রাওলিন বোর্জেস, লালেঙমাওউইয়া, জিকসন সিং, রেইনিয়ে ফার্নান্ডেজ, অনিরুদ্ধ থাপা, বিপিন সিং, ইয়াসির মহম্মদ, সুরেশ সিং, হালিচরণ নার্জারি, লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতে, আশিক কুরুনিয়েন,

ফরোয়ার্ড – মনবীর সিং, ইশান পন্ডিতা, হিতেশ শর্মা, লিস্টন কোলাসো।

ম্যাচ: ভারত বনাম ওমান (ফ্রেন্ডলি)

স্থান: মাকতুম বিন রশিদ মাকতুম স্টেডিয়াম, দুবাই

তারিখ: ২৪ মার্চ, ২০২১

কিক-অফ: সন্ধ্যা ৭.১৫ (ভারতীয় সময়)