অসাধারণ ফুটবল খেলেও শেষ মুহূর্তে গোল খেয়ে জয় হাতছাড়া করল এটিকে মোহনবাগান। শনিবার চলতি হিরো আইএসএলের দ্বিতীয় সেমিফাইনালের প্রথম লেগে নর্থইস্ট ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে ১-১ ড্র করল। প্রথম লেগে এই ড্রয়ের জেরে দ্বিতীয় লেগের ম্যাচে দুই দলেরই ফাইনালে ওঠার সম্ভাবনা পুরোপুরি রইল।

বাম্বোলিমের জিএমসি স্টেডিয়ামে দুই বঙ্গ অধিনায়ক প্রীতম কোটাল ও শুভাশিস রায়ের নেতৃত্বাধীন দুই দলের মধ্যে এ দিন কলকাতার দলের দাপটই ছিল বেশি। বল দখলের লড়াইয়ে এটিকে মোহনবাগান কিছুটা পিছিয়ে (নীচে পরিসংখ্যান দেখুন) থাকলেও আক্রমণ ও গোলের সুযোগ তৈরি এবং রক্ষণের দিক থেকে গত দশ ম্যাচে অপরাজিত নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি-কে পিছনেই ফেলে দেয়।

৩৪তম মিনিটে রয় কৃষ্ণার পাস থেকে ডেভিড উইলিয়ামস যে দর্শনীয় গোল করে দলকে এগিয়ে দেন, সেই গোলেই ম্যাচ শেষ হওয়ার তিন মিনিট আগে পর্যন্ত এগিয়ে ছিল সবুজ-মেরুন বাহিনী। সারা ম্যাচে যে রক্ষণ প্রায় দুর্ভেদ্য দেওয়াল তুলে রেখেছিল, সেই এটিকে মোহনবাগান রক্ষণের শেষ মুহূর্তের অসাবধানতায় গোল খেয়ে প্রায় নিশ্চিত জয় হাতছাড়া করতে হয় তাদের। নর্থইস্টের পক্ষে হেডে এই গোলটি করেন গিনির ফরোয়ার্ড ইদ্রিসা সিলা।  

  • ২৪ মিনিট: মাঝমাঠ থেকে হাভির লম্বা ভলি বক্সের মধ্যে ব্যাক হিল করে নিজের সামনে এনে গোলে শট নিলেও তা সাইড নেটে জড়িয়ে যায়।
  • ৩৪ মিনিট: ১-০। বক্সের মধ্যে একটি লম্বা পাস রিসিভ করে রয় পাস দেন ডেভিডকে। বিপক্ষের ডিফেন্ডারদের পরাস্ত করে মাটি ঘেঁষা গোলমুখী শট নেন ডেভিড, যা জালে জড়িয়ে যায়।
  • ৪৩ মিনিট: গালেগোর নিখুঁত ফ্রি কিকে হেড করে বল গোলের দিকে ঠেলেন আশুতোষ মেহতা। কিন্তু তা ক্রসবারে লেগে বেরিয়ে যায়।
  • ৫০ মিনিট: মাঝমাঠ থেকে বল নিয়ে বিপক্ষের বক্সের দিকে দৌড়ন লুই মাচাডো। বক্সের বাইরে বেরিয়ে এসে তাঁকে বাধা না দিলে হয়তো গোল করেই দিতেন পর্তুগীজ তারকা।
  • ৯৩ মিনিট: ১-১। বক্সের ডান দিক থেকে লুই মাচাডো বক্সের মধ্যে সিলার উদ্দেশ্যে ক্রস করলে তিনি তা হেড করে গোলে পাঠিয়ে দেন।

শনিবার চোটের জন্য মাঠে নামতে পারেননি এটিকে মোহনবাগানের নির্ভরযোগ্য ডিফেন্ডার সন্দেশ ঝিঙ্গন। তাঁর সতীর্থ ডিফেন্ডার তিরিকেও প্রথম এগারোয় দেখা যায়নি। তিনি ছিলেন ডাগ আউটে। তবে নামেননি। দুই সাইড ব্যাক হিসেবে প্রবীর দাস ও শুভাশিস বসুকে রেখে কার্ল ম্যাকহিউ ও অধিনায়ক প্রীতম কোটাল সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার হিসেবে শুরু করেন। সামনে মাঝখানে রয় কৃষ্ণাকে রেখে তাঁর দুপাশে ডেভিড উইলিয়ামস ও মনবীর সিং ছিলেন।

অন্য দিকে, নর্থইস্ট ইউনাইটেড এ দিন তাদের অন্যতম নির্ভরযোগ্য স্কোরার দেশর্ন ব্রাউনকে স্কোয়াডের বাইরে রাখে। সম্ভবত চোটের জন্য তাঁকে এ দিন পায়নি খালিদ জামিলের দল। এটিকে মোহনবাগানের মতো তারাও ৪-৩-৩-এ দল সাজায়।

দুই দলই এ দিন শুরুটা করে কিছুটা সাবধানতা অবলম্বন করে। মাঝে মাঝে তারা আক্রমণ তৈরি করার চেষ্টা করে ঠিকই, কিন্তু কেউই ওপেন চান্স তৈরি করতে পারেনি। দুই দলই যে নিজেদের রক্ষণকে জমাটবদ্ধ করে আক্রমণে ওঠার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছিল, তা তাদের পারফরম্যান্স দেখেই বোঝা যায়। অযথা ঝুঁকি নিতে যায়নি কোনও পক্ষই। এ দিন প্রথম আধ ঘণ্টায় কোনও দলের গোলকিপারকেই কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়নি।

দশ মিনিটের মাথায় বক্সের মাথা থেকে নেওয়া হাভিয়ে হার্নান্ডেজের দূরপাল্লার শট গোলের অনেক ওপর দিয়ে চলে যায়। ২০ মিনিটে ডেভিড উইলিয়ামসের বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া শট লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। তবে ২৪ মিনিটের মাথায় রয় কৃষ্ণা যে ভাবে বক্সের মধ্যে বল রিসিভ করে গোলের উদ্দেশ্যে শট নেন, তা প্রশংসা করার মতো। মাঝমাঠ থেকে হাভির লম্বা ভলি বক্সের মধ্যে ব্যাক হিল করে নিজের সামনে এনে গোলে শট নিলে তা সাইড নেটে জড়িয়ে যায়। ৩২ মিনিটের মাথায় ডান উইং দিয়ে উঠে বক্সে ঢুকে শট নেন মনবীর, যা ক্রসবারের ওপর দিয়ে উড়ে যায়।

সবুজ-মেরুন বাহিনীর আকাঙ্খিত মুহূর্তটি আসে ৩৪তম মিনিটে যখন গোল করে দলকে এগিয়ে দেন সেই রয়-ডেভিড জুটি। বক্সের মধ্যে একটি লম্বা পাস ডান পায়ে রিসিভ করে প্রায় ৯০ ডিগ্রি ঘুরে রয় বাঁ পায়ে পাস দেন মাঝবরাবর বক্সের দিকে দৌড়ে আসা ডেভিডকে।  ডেভিড বিপক্ষের ডিফেন্ডার নিম দোরজিকে ড্রিবল করে ডিলান ফক্সের পায়ের ফাঁক দিয়ে মাটি ঘেঁষা গোলমুখী শট নেন এবং তা জালে জড়িয়ে যায়।

প্রথমার্ধের স্টপেজ টাইমে গোল শোধ করার এক দুরন্ত সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল নর্থইস্ট। ফেদরিকো গালেগোর নিখুঁত ফ্রি কিকে হেড করে বল গোলের দিকে ঠেলেন আশুতোষ মেহতা। কিন্তু তা ক্রসবারে লেগে বেরিয়ে যায়। প্রথমার্ধে নর্থইস্টের আক্রমণে সবচেয়ে বেশি তৎপর ছিলেন আশুতোষই। ডান দিকের উইং দিয়ে বারবার তাঁকে কেন্দ্র করেই আক্রমণ তৈরি করতে দেখা যায় খালিদ জামিলের দলকে। কিন্তু প্রবীর ও প্রীতমের তৎপরতায় বারবার সেই আক্রমণগুলি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে সমতা আনার চেষ্টা বাড়াতে থাকে নর্থইস্ট ইউনাইটেড। কিন্তু দেশর্ন ব্রাউনের অভাব তাদের ভোগায়। ৫০ মিনিটের মাথায় বল নিয়ে বিপক্ষের বক্সের দিকে দৌড়ন লুই মাচাডো। বক্সের বাইরে বেরিয়ে এসে তাঁকে বাধা না দিলে হয়তো গোল করে দিতেন পর্তুগীজ তারকা।

বিপক্ষের আক্রমণের এই ধার বাড়ার জেরে নিজেদের রক্ষণকে আঁটোসাটো করতে শুরু করে দেয় এটিকে মোহনবাগান। বিপক্ষকে নিজেদের এলাকায় টেনে নিয়ে এসে পাল্টা আক্রমণে ওঠার প্রবণতা দেখা যায় তাঁদের খেলায়। ক্রমশ বল পজেশন বাড়িয়ে ম্যাচ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টাও দেখা যায় তাদের মধ্যে। তাদের জমাট রক্ষণের দেওয়ালে চিড় ধরানো প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে নর্থইস্টের পক্ষে।

নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার নমিনিট আগে প্রণয় হালদারকে মাঠে নামানো হয় মার্সেলিনহোর জায়গায়। উদ্দেশ্যটা অবশ্যই রক্ষণকে আরও শক্তিশালী করা। শেষ দশ মিনিটে যে চাপ বাড়াবে ও গোল শোধ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে নর্থইস্ট, সেটা ভেবে নিয়েই এই পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত। এই অনুমান যে ঠিকই ছিল, তা বোঝা যায় নর্থইস্টের মরিয়া চেষ্টা দেখে। ৮৫ মিনিটের মাথায় গালেগোর ফ্রি কিক থেকে বক্সের মধ্যে গোলের দিকে হেড করেছিলেন ডিলান ফক্স। কিন্তু গোলকিপারের সামনে থাকা প্রণয় তা ক্লিয়ার করে দেন। ৮৭ মিনিটের মাথায় লালেঙমাউইয়ার পাস থেকে ইদ্রিসা সিলা শট নেন, যা গোলের ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়।  

 ক্রমশ চাপ বাড়াতে থাকা নর্থইস্ট ইউনাইটেড শেষ পর্যন্ত সমতা এনে ফেলে ছমিনিটের স্টপেজ টাইমে। সারা ম্যাচে এটিকে মোহনবাগান ডিফেন্সের একমাত্র ভুলটা হয় তখনই। গোলের সামনে একই জায়গায় চলে এসেছিলেন প্রবীর ও প্রণয় এবং কেউই বক্সের থাকা বিপক্ষের স্কোরারকে মার্ক করেননি। বিপক্ষের রক্ষণের সেই একমাত্র ভুলকে কাজে লাগিয়েই গোলটি করে ফেলেন ইদ্রিসা সিলা। ডান দিক থেকে লুই মাচাডো বক্সের মধ্যে সিলার উদ্দেশ্যে ক্রস বাড়ালে তিনি তা হেড করে গোলে পাঠিয়ে দেন। এর পরে আর ব্যবধান বাড়ানোর কোনও সময়ই ছিল না এটিকে মোহনবাগানের হাতে।

এটিকে মোহনবাগান দল: অরিন্দম ভট্টাচার্য (গোল), প্রবীর দাস, প্রীতম কোটাল, শুভাশিস বসু, কার্ল ম্যাকহিউ, লেনি রড্রিগেজ, হাভিয়ে হার্নান্ডেজ, মার্সেলো পেরেইরা (প্রণয় হালদার), মনবীর সিং, রয় কৃষ্ণা, ডেভিড উইলিয়ামস।

পরিসংখ্যানের যুদ্ধ

বল পজেশন: এটিকে মোহনবাগান ৪৭% - নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি ৫৩%

সফল পাস: ২৫৬/৪০৮ (৬৩%) - ৩৪৮/৫১৬ (৬৭%)

গোলে শট: ২-৪

ফাউল: ১৬-১০

ইন্টারসেপশন: ২৫-১১

কর্নার: ৪-২

হলুদ কার্ড: ১-১

ম্যাচের হিরো: গুরজিন্দর কুমার