লিগ টেবলের দশ ও এগারো নম্বর দলের মধ্যে ম্যাচ হলেও মঙ্গলবার যে খেলা দেখল তিলক ময়দান, তা আগে থেকে না বলে দিলে বিশ্বাস করা কঠিন ছিল। এ বারের হিরো আইএসএলে ঝাঁকে ঝাঁকে গোল হওয়ার ধারা অব্যহত রেখে সারা ম্যাচে সাত-সাতটি গোল হল। তবে এই ম্যাচেও পয়েন্ট অর্জন করতে ব্যর্থ হল এসসি ইস্টবেঙ্গল। ৪-৩-এ জিতে চলতি মরশুমের প্রথম জয় ও প্রথম পয়েন্ট অর্জন করে লিগ টেবলে জায়গা অদল-বদল করে নিল এফসি গোয়া। এসসি ইস্টবেঙ্গল নামল এগারো নম্বরে ও গোয়ার দল এক ধাপ উঠে এল দশে।

মঙ্গলবার ভাস্কোয় দুই দলেরই দুর্বল রক্ষণকে কাজে লাগিয়ে একের পর এক গোল করেন অ্যাটাকাররা। তিনবার পিছিয়ে গিয়ে সমতা আনে এসসি ইস্টবেঙ্গল। কিন্তু ম্যাচের ৭৯তম মিনিটে জয়সূচক গোল পাওয়ার পরে বাকি সময়ে বিপক্ষের পায়ে কার্যত বল যেতেই দেয়নি এফসি গোয়া। লাল-হলুদ শিবিরের ক্রোয়েশিয়ান স্ট্রাইকার আন্তোনিও পেরোসেভিচ ও গোয়ার স্প্যানিশ স্ট্রাইকার আলবার্তো নগুয়েরা জোড়া গোল করেন। কিন্তু নগুয়েরার আনন্দই ছিল বেশি। 

এ দিন প্রথমার্ধে ২৬ মিনিটের মধ্যে নগুয়েরা ও পেরোসেভিচের গোলে ১-১ হওয়ার পরে ১২ মিনিটের মধ্যে তিনটি গোল করেন যথাক্রমে গোয়ার জর্জ ওর্টিজ (পেনাল্টি), এসসি ইস্টবেঙ্গলের আমির দার্ভিসেভিচ ও পেরোসেভিচ (নিজগোল)। দ্বিতীয়ার্ধের শেষে এফসি গোয়া ৩-২-এ এগিয়ে ছিল।  ৫৯ মিনিটে ফের গোল করে দলকে সমতা এনে দেন পেরোসেভিচ। কিন্তু ৭৯ মিনিটে নগুয়েরার দ্বিতীয় গোলে জয় পায় গোয়ার দল।   

  • ১৪ মিনিট: ১-০। আলবার্তো নগুয়েরার নিখুঁত দূরপাল্লার শট এসসি ইস্টবেঙ্গলের জালে জড়িয়ে যায়। ওর্টিজের পাসে বক্সের সামনে ডান দিক থেকে সোজা গোলে শট নেন নগুয়েরা।
  • ২৬ মিনিট: ১-১। বক্সের সামনে থেকে নেওয়া ফ্রিকিক ওয়ালে এডু বেদিয়ার মুখে লেগে তাঁর কাছে ফিরে এলে পেরোসেভিচ ফের শট নেন ও তা সোজা গোলে।
  • ৩২ মিনিট: গোয়া ২-১। গোলমুখী সেরিটন ফার্নান্ডেজ বল নিয়ে বক্সের মধ্যে ঢুকতেই সৌরভ দাস তাঁর পায়ে আঘাত করায় রেফারি শ্রীকৃষ্ণ পেনাল্টি দেন এবং সেই পেনাল্টি থেকে গোল পান ওর্টিজ।
  • ৩৭ মিনিট: ২-২। ডান দিকের উইং থেকে নেওয়া দার্ভিসেভিচের লম্বা ফ্রিকিক সোজা গোলে ঢুকে পড়ে বাঁ দিকের ওপরের কোণ দিয়ে।
  • ৪৪ মিনিট: এফসি গোয়া ৩-২। কর্নারে উড়ে আসা বলে দেবেন্দ্র মুরগাওকর মাথা ছোঁয়ালে বল গোলের সামনে থাকা পেরোসেভিচের গায়ে লেগে গোলে ঢুকে যায়।
  • ৫৯ মিনিট: ৩-৩। মাঝমাঠে গ্ল্যান মার্টিন্সের ভুল ব্যাক পাস থেকে বল পেয়ে অনেকটা দৌড়ে দুই ডিফেন্ডারকে ডজ করে বক্সের ডানদিক দিয়ে ঢুকে কোণাকুণি শটে গোল করেন পেরোসেভিচ।
  • ৭৮ মিনিট: ফের সুবর্ণ সুযোগ পান পেরোসেভিচ। চিমার পাস থেকে বল পেয়ে ডান দিক দিয়ে বক্সে ঢুকে তিনি সোজা গোলকিপারের গায়ে শট মারেন ও ফিরতি বলে শট নেন চিমা, যা বারের ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়।
  • ৭৯ মিনিট: এফসি গোয়া ৪-৩। ডানদিক দিয়ে ওঠা ওর্টিজ গোলের সামনে ক্রস দেন, যেখানে নোঙদোম্বা নাওরেম একটা ডামি দেন ও তার পরেই নগুয়েরা নিখুঁত শটে বল গোলে ঠেলে দেন।

গত ম্যাচের দলে পাঁচটি পরিবর্তন করে পেরোসেভিচ ও নাওরেম মহেশকে সামনে রেখে এ দিন ৪-৪-২-এ দল সাজান এসসি ইস্টবেঙ্গলের কোচ। রাজু, পর্চে, জায়রু, সৌরভ দাস, পেরোসেভিচ প্রথম এগারোয় আসেন। চিমাকে এ দিন রিজার্ভ বেঞ্চে দেখা গেলেও সিডোল এ দিন স্কোয়াডে ছিলেন না। এফসি গোয়া দলেও এ দিন চারটি পরিবর্তন আসে। ডিলান ফক্স ছিলেন রিজার্ভ বেঞ্চে। কোচ হুয়ান ফেরান্দো তাঁর দল নামান ৪-২-৩-১-এ, সামনে তাদের ৯ নম্বর খেলোয়াড় ওর্টিজকে সামনে রেখে।

শুরু থেকেই এ দিন বিপক্ষকে চাপে রাখে এফসি গোয়া। এসসি ইস্টবেঙ্গলও রক্ষণাত্মক ফুটবল দিয়ে শুরু করে। গত তিন ম্যাচে গোয়ার দলের ব্যর্থতার সুযোগ নিয়ে যে তারা নিজেদের খেলায় ফিরিয়ে আনবে, এমন প্রত্যাশা থাকলেও হয় ঠিক উল্টোটা। হুয়ান ফেরান্দোর দলের দাপটই বেশি ছিল শুরু থেকে এবং তারাই প্রথম গোল করে এগিয়ে যায়।

স্প্যানিশ অ্যটাাকিং মিডফিল্ডার আলবার্তো নগুয়েরার নিখুঁত দূরপাল্লার শট এসসি ইস্টবেঙ্গলের জালে জড়িয়ে যায় ১৪ মিনিটের মাথায়। ওর্টিজের পাসে বক্সের সামনে ডানদিক থেকে সোজা গোলে শট নেন নগুয়েরা এবং তা গোলের বাঁ দিকের ওপরের কোণ দিয়ে জালে জড়িয়ে যায়। তাঁর সামনে লাল-হলুদ জার্সির দুই ডিফেন্ডার থাকলেও তাঁরা কিছু করতে পারেননি।

আগোছালো এসসি ইস্টবেঙ্গল খেলায় ফেরার চেষ্টা করতে থাকলেও বিপক্ষের পাল্টা আক্রমণে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ১৭ মিনিটের মাথায় ওর্টিজ সিটার মিস করেন নগুয়েরার পাস থেকে। ১৯ মিনিটের মাথায় ওয়ান টু ওয়ান পরিস্থিতিতে এফসি গোয়ার গোলকিপার ধীরজকে পরাস্ত করতে পারেননি জাইরু।

গোল খাওয়ার ১২ মিনিট পরেই গোল শোধ করে এসসি ইস্টবেঙ্গল। সেট পিসে এ বার আধিপত্য দেখাচ্ছে লাল-হলুদ শিবির। এ বারেও সেই সেট পিস থেকেই গোল পান পেরোসেভিচ। বক্সের সামনে থেকে নেওয়া ফ্রিকিক ওয়ালে এডু বেদিয়ার মুখে লেগে তাঁর কাছে ফিরে এলে ফের শট নেন ও তা সোজা গোলে পাঠান পেরোসেভিচ।   

কিন্তু এই সমতা বেশিক্ষণ রাখতে পারেনি এসসি ইস্টবেঙ্গল এবং মাত্র ছ’মিনিট পরেই ফের গোল খায় তারা। ৩২ মিনিটের মাথায় পেনাল্টি থেকে গোল করে ফের এগিয়ে যায় এফসি গোয়া। গোলমুখী সেরিটন ফার্নান্ডেজ বল নিয়ে বক্সের মধ্যে ঢুকতেই সৌরভ দাস তাঁর পায়ে আঘাত করায় রেফারি শ্রীকৃষ্ণ পেনাল্টি দেন এবং সেই পেনাল্টি থেকে গোল পান ওর্টিজ। এই গোলের তিন মিনিট আগে ব্যবধান বাড়ানোর সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যান দেবেন্দ্র মুরগাওকর। কিন্তু গোলের সামনে নেওয়া তাঁর শট আটকে দেন শুভম। 

পেনাল্টি থেকে পাওয়া গোলের পাঁচ মিনিট পরে (৩৭) ফের সমতা (২-২) আনে কলকাতার দল। এ বার ডান দিকের উইং থেকে নেওয়া দার্ভিসেভিচের লম্বা ফ্রিকিক সোজা গোলে ঢুকে পড়ে বাঁ দিকের ওপরের কোণ দিয়ে। অসাধারণ এই গোলের পরে এসসি ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলারদের খেলায় আত্মবিশ্বাসের ছাপ দেখা যেতে শুরু করে।

কিন্তু বিরতির এক মিনিট আগে নিজেদের ভুলেই ফের পিছিয়ে পড়ে কলকাতার দল। যে পেরোসেভিচ গোল করে সমতা এনেছিলেন, সেই পেরোসেভিচের নিজ-গোলেই ২-৩-এ পিছিয়ে পড়ে তারা। কর্নারে উড়ে আসা বলে দেবেন্দ্র মুরগাওকর  মাথা ছুঁইয়ে ফ্লিক করলে বল গোলের সামনে থাকা পেরোসেভিচের গায়ে লেগে জালে জড়িয়ে যায়। আচমকা বলের গতি পরিবর্তনে হতচকিত গোলকিপার শুভমের কিছুই করার ছিল না। 

দ্বিতীয়ার্ধে দু’টি পরিবর্তন করেন মানুয়েল দিয়াজ। আদিল খান ও ড্যানিয়েল চিমা নামেন যথাক্রমে অমরজিৎ ও মর্চেলার জায়গায়। তাঁরা আসার পরে কাউন্টার অ্যাটাক বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিল লাল-হলুদ বাহিনী।  এ রকমই এক কাউন্টার থেকে গোল করে ফের সমতা আনেন পেরোসেভিচ। এ বার ৫৯তম মিনিটে মাঝমাঠে গ্ল্যান মার্টিন্সের ভুল ব্যাক পাস থেকে বল পেয়ে অনেকটা দৌড়ে দুই ডিফেন্ডারকে ডজ করে বক্সের ডানদিক দিয়ে ঢুকে কোণাকুণি শটে গোল করেন পেরোসেভিচ।

৬৬ ও ৬৭ মিনিটের অবধারিত একটি করে গোলের সুযোগ নষ্ট করে দুই দলই। প্রথমে বক্সের সামনে থেকে এডু বেদিয়ার ফ্রিকিক সোজা গোলে ঢোকার মুখে শুভম বাঁ হাত দিয়ে বল বার করে দেন। পরের মিনিটেই মাঝ মাঠ থেকে শুরু হওয়া কাউন্টার অ্যাটাকে বক্সের ডানদিক থেকে আসা লো ক্রসে পা লাগাতে পারলে অবধারিত গোল করতে পারতেন চিমা। কিন্তু পিছন থেকে আসা ইভান গঞ্জালেসের স্লাইডিং ট্যাকলের ফলে তিনি সেই বলে পা লাগাতে পারেননি। ৭৮ মিনিটের মাথায় ফের সুবর্ণ সুযোগ পান পেরোসেভিচ। চিমার পাস থেকে বল পেয়ে ডান দিক দিয়ে বক্সে ঢুকে তিনি সোজা গোলকিপারের গায়ে শট মারেন ও ফিরতি বলে শট নেন চিমা, যা বারের ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়।

এই ভুলের মাশুল তাদের দিতে হয় পরের মিনিটেই ফের পিছিয়ে পড়ে। ডানদিক দিয়ে ওঠা ওর্টিজ গোলের সামনে ক্রস দেন, যেখানে নোঙদোম্বা নাওরেম একটা ডামি দেন ও তার পরেই বাঁ দিক থেকে আসা নগুয়েরা নিখুঁত শটে বল গোলে ঠেলে দেন। নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার সাত মিনিট আগে একসঙ্গে তিন খেলোয়াড় পরিবর্তন করেন হুয়ান ফেরান্দো, যাঁদের মধ্যে ছিলেন ডিলান ফক্সও। কিন্তু তাঁদের কাজ ছিল শেষের কয়েক মিনিট বিপক্ষের ফুটবলারদের পায়ে বল যেতে না দেওয়া এবং এই কাজটাই সফল ভাবে করে তারা।

এসসি ইস্টবেঙ্গল এর পরে কেরালা ব্লাস্টার্সের মুখোমুখি হবে আগামী রবিবার। এফসি গোয়া তার আগের দিন নামবে বেঙ্গালুরু এফসি-র বিরুদ্ধে।   

এসসি ইস্টবেঙ্গল দল: শুভম সেন (গোল), টমিস্লাভ মর্সেলা (অধি) (ড্যানিয়েল চিমা), হীরা মন্ডল, রাজু গায়কোয়াড় (জয়নার লরেঙ্কো), ফ্রানিও পর্চে, সৌরভ দাস, আমির দার্ভিসেভিচ, অমরজিৎ সিং কিয়াম (আদিল খান), বিকাশ জাইরু (লালরিনলিয়ানা হামতে), আন্তোনিও পেরোসেভিচ, নাওরেম মহেশ (সেম্বয় হাওকিপ)।  

পরিসংখ্যানে ম্যাচ

বল পজেশন: এসসি ইস্টবেঙ্গল ৩৫% - এফসি গোয়া ৬৫% 

সফল পাস: ১১৩/১৭৯ (৬৩%) - ৪৫৮/৫৫১ (৮৩%), গোলে শট: ৪-৫, ফাউল: ১৯-১০, ইন্টারসেপশন: ১৮-১৪, কর্নার: ২-৬, হলুদ কার্ড: ২-২, ম্যাচের সেরা: আলবার্তো নগুয়েরা