সমস্ত জল্পনার অবসান ঘটিয়ে এক ছাতার তলায় আসছে এটিকে এফসি ও ঐতিহ্যবাহী মোহনবাগান এসি। আগামী বছর থেকে দুই দল একত্রিত হয়ে হিরো ইন্ডিয়ান সুপার লিগে অংশগ্রহণ করবে। এটিকে এফসি-র মালিক পক্ষ আরপিএসজি হতে চলেছে মোহনবাগান ফুটবল ক্লাব (ইন্ডিয়া) প্রাইভেট লিমিটেডের অধিকাংশ মালিকানার অধিকারী।

দুই সংস্থা মিলিত হয়ে যে ক্লাব গঠিত হবে, তার নামে এটিকে ও মোহনবাগান দুই ব্র্যান্ডই থাকবে। আরপিএসজি গ্রুপের হাতে থাকবে নতুন এই ক্লাবের ৮০ শতাংশ মালিকানা।  মোহনবাগান ফুটবল ক্লাব (ইন্ডিয়া) প্রাইভেট লিমিটেডের কাছে থাকবে বাকি ২০ শতাংশ।

বাংলার দুই সেরা ফুটবলখেলিয়ে ক্লাবের এই মৈত্রীতে যে এ রাজ্যেক ফুটবলে আরও সাফল্য আসবে, এমনই মনে করছে দেশের ফুটবল মহল। ভারতীয় ফুটবলে যখন উন্নতির জোয়ার আসতে চলেছে, দেশের ফুটবলকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগে যখন সারা দেশের ফুটবল প্রশাসক ও পৃষ্ঠপোষকেরা হাত মিলিয়েছেন, সেই সময়ে এই ঘটনা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ।

এক সময় দশকের পর দশক ভারতীয় ফুটবলের মক্কা কলকাতা দেশের ফুটবলে আধিপত্যে করেছে। আশা করা যায়, বাঙালির ফুটবলের সেই সুদিন আবার ফিরে আসবে এই ঐতিহাসিক চুক্তির ফলে। ভারতীয় ফুটবলকেও আরও সমৃদ্ধ করে তুলবে দুই সফল ক্লাবের এই মৈত্রীচুক্তি।

মোহনবাগানকে পাশে পেয়ে আরপিএসজি গ্রুপের চেয়ারম্যান ডা. সঞ্জীব গোয়েঙ্কা বলেন:

“২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী আরপিএসজি গ্রুপ মোহনবাগানকে আমাদের পরিবারে সসম্মানে, হার্দিক ভাবে ও দুই হাত বাড়িয়ে স্বাগত জানাচ্ছে। ঐতিহ্যের রক্ষণাবেক্ষণ ও বজায় রাখার ব্যাপারে আরপিএসজি-র সুনাম সারা বিশ্বে। যেমন ১২০ বছর পুরনো সিইএসসি, ১৫০ বছর পুরনো স্পেন্সার্স রিটেল এবং একশো বছর বয়সি সারেগামা-র ঐতিহ্য আমরা বহন করে চলেছি। ব্যক্তিগত ভাবে এই মৈত্রীচুক্তি আমার পক্ষেও যথেষ্ট আবেগপূর্ণ। কারণ, আমার বাবা প্রয়াত শ্রী আর পি গোয়েঙ্কা মোহনবাগান ক্লাবের সদস্য ছিলেন”।

দুই ক্লাবের এই মৈত্রীচুক্তিতে অভিভূত মোহনবাগান ফুটবল ক্লাব (ইন্ডিয়া) প্রাইভেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান স্বপনসাধন বোস বলেন:

“মোহনবাগান ক্লাবের জার্সির সবুজ-মেরুন রঙের রোমান্স অমর থাকুক এটা যেমন আমরা চাই, তেমনই ক্লাবের ১৩০ বছরের ঐতিহ্যও বজায় রাখতে হবে আমাদের। এই দুইয়ের জন্যই আমাদের বাস্তবে একজন সঙ্গী অবশ্যই দরকার ছিল। ফুটবলের নতুন যুগে যেমন প্রচুর অর্থের যোগান প্রয়োজন তেমন পেশাদারি দক্ষতাও অবধারিত। এই মুহূর্তে এর চেয়ে বাস্তব ও বড় সত্যি আর কিছু নেই”।

তিনি আরও বলেন, “এই প্রসঙ্গে ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় ও বিখ্যাত শিলল্পপতি ও কলকাতার ঘরের মানুষ সঞ্জীব গোয়েঙ্কাকে অনেক ধন্যবাদ জানাই আরপিএসজি-র মাধ্যমে এই নতুন উদ্যোগে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করার জন্য। ভারতীয় ফুটবল নিয়ে তাঁদের ভাবনা ও আমাদের দর্শন এ বার এক হতে চলেছে। দু’পক্ষের মিলিত শক্তি এই ক্লাবকে নিশ্চয়ই এক নতুন  ও মহান উচ্চতায় নিয়ে যাবে। সে দিক থেকে দেখতে গেলে এই দিনটা এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে এক চিরস্মরণীয় দিন হিসেবে থেকে যাবে”।

এটিকের কর্ণধার ডা. সঞ্জীব গোয়েঙ্কাকে ধন্যবাদ দিয়ে স্বপনসাধনবাবু বলেন, “আমাদের স্বপ্নের ভাগীদার হওয়ার জন্য ডা. গোয়েঙ্কাকে আমার হার্দিক ধন্যবাদ। ওঁর বাবা প্রয়াত আর পি গোয়েঙ্কা আমার ভাল বন্ধু ছিলেন। সফল শিল্পপতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরপিজি-র মোহনবাগানপ্রীতি ছিল অসামান্য এবং তিনি আমাদের সদস্যও ছিলেন। যখনই আমাদের মধ্যে দেখা হত, ব্যবসার কথা ছেড়ে দিয় আমরা ক্লাব নিয়ে আলোচনা করতে বসে যেতাম”।

সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা আপামর সবুজ-মেরুন সমর্থকদের উদ্দেশ্যে মোহনবাগানের প্রধান বলেন, “সারা দুনিয়ার লক্ষ লক্ষ সমর্থকদের নিশ্চয়তা দিচ্ছি, কবিতা লেখা কিন্তু চলবে। কারণ, গদ্যও এখন সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছে”।

মিলিত ভাবে দুই ক্লাবের পথচলা শুরু হবে ২০২০-র ১ জুন থেকে এবং হিরো ইন্ডিয়ান সুপার লিগের ২০২০-২০২১ মরশুম থেকে অংশ নেবে তারা। শুধু আইএসএল-ই নয় ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের অন্যান্য প্রতিযোগিতাতেও অংশ নেবে এই নতুন মিলিত ক্লাব। ক্লাবের হোমম্যাচগুলিতে মোহনবাগান সমর্থকেরা কম মূল্যে টিকিটও পাবেন যথারীতি।

মোহনবাগান অ্যাথলেটিক ক্লাব: প্রতিষ্ঠা ১৮৮৯ সালে। ১৩০ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই ক্লাব একশোরও বেশি খেতাব জয় করেছে। ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে এর চেয়ে বড় ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান আর নেই। ১৯১১-র ২৯ জুলাই ইংল্যান্ডের ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টকে হারিয়ে মোহনবাগানের আইএফএ শিল্ড জয়ের ঘটনা ঐতিহাসিক ভাবে ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এই ঐতিহাসিক ঘটনা তখন ভারতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল। সেই ঘটনার একশো বছর পূর্তি উপলক্ষে ভারত সরকার ১৯৮৯-এ একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে। এর আগে কোনও ক্লাবকে নিয়ে এমন ডাকটিকিট কখনও প্রকাশ করা হয়নি। দেশের জাতীয় ক্লাব হিসেবেও ঘোষণা করা হয়েছে মোহনবাগানকে।

এটিকে ফুটবল ক্লাব: দু’বারের হিরো ইন্ডিয়ান সুপার লিগ চ্যাম্পিয়নদের সামনে এ বারই প্রথম সরাসরি ২০২১-এর এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গ্রুপপর্বে যোগ্যতা অর্জন করার সুযোগ রয়েছে। ২০১৪-র প্রথম হিরো আইএসএলে  ও পরে ২০১৬-তেও চ্যাম্পিয়ন হয় তারা। এ বার তৃতীয়বার এই খেতাব জিতে নতুন নজির গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে তারা।

হিরো ইন্ডিয়ান সুপার লিগ: হিরো আইএসএল ফুটবল স্পোর্টস ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের (এফএসডিএল) উদ্যোগে শুরু হওয়া দেশের এক নম্বর ফুটবল লিগ। ২০১৪-য় রিলায়্যান্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও স্টার ইন্ডিয়ার যৌথ উদ্যোগে গঠিত হয় এই এফএসডিএল। এখন দশটি পেশাদার ক্লাব এই লিগে অংশ নেয়। গত পাঁচ বছরে এটিকে ও চেন্নাইন এফসি দু’বার করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। গত বার লিগের নতুন দল হিসেবে প্রবেশ করে চ্যাম্পিয়ন হয় বেঙ্গালুরু এফসি।