এক সপ্তাহ আগে জয় দিয়ে এ বারের হিরো আইএসএল শুরু করে এটিকে মোহনবাগান। সেই জয়ের ধারা তারা অব্যহত রাখল কলকাতা ডার্বিতে ২-০ গোলে জিতে। দেশের সেরা লিগে অভিষেক স্মরণীয় করে রাখতে পারল না এসসি ইস্টবেঙ্গল। ৪৯ মিনিটে রয় কৃষ্ণা ও ৮৫ মিনিটে মনবীর সিংয়ের দুর্দান্ত দুই গোলে চিরপ্রতিদ্বন্দীদের হারাল সবুজ-মেরুন শিবির।

প্রথম ম্যাচে শুরুর দিকে যে সমস্যা হয়েছিল আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের দলের, সাত-আট মাস পরে ম্যাচে নেমে সেই সমস্যায় এ দিন পড়তে হয় এসসি ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলারদেরও। কিন্তু সেই জড়তা কাটিয়ে উঠে যে ভাবে জয়ে ফিরতে পেরেছিল এটিকে মোহনবাগান, তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দী ক্লাব কিন্তু এ দিন তা করতে পারেনি। বিপক্ষের কড়া ডিফেন্সের দুর্ভেদ্য দেওয়াল ভেঙে গোল করার সে রকম সুযোগ তৈরি করতে পারেনি তারা। ৫৮ শতাংশ বল পজেশন থাকলেও ম্যাচের দখল নিতে পারেনি তারা। 

এ দিন এসসি ইস্টবেঙ্গলের হোম ম্যাচ ছিল বলে সাদা জার্সি গায়ে নামতে হয়েছিল এটিকে মোহনবাগানকে। জার্সি বদলালেও তাদের দর্শনীয় ফুটবলে কোনও পরিবর্তন দেখা যায়নি। প্রথমার্ধে দুই দল একে অপরকে পরখ করে নেওয়ার পরে দ্বিতীয়ার্ধে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে ম্যাচ জিতে নেয় এটিকে মোহনবাগান। কিন্তু পাল্টা জবাব দিতে পারেনি লাল-হলুদ শিবির।

  • ৩৬ মিনিট: বাঁ দিক থেকে হাভিয়ে হার্নান্ডেজের গোলমুখী শট দুর্দান্ত ভাবে ডাইভ দিয়ে বাঁচিয়ে দেন এসসি ইস্টবেঙ্গল গোলকিপার দেবজিৎ।
  • ৩৭ মিনিট: সুরচন্দ্রের ক্রস থেকে বক্সের মধ্যে সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলেন বলওয়ন্ত। কিন্তু ঠিকমতো পা ছোঁয়াতে পারেননি তিনি।
  • প্রথমার্ধে বল পজেশন এসসি ইস্টবেঙ্গল ৫৮%, এটিকে মোহনবাগান ৪২%
  • ৪৯ মিনিট: বাঁদিকের উইং দিয়ে ওঠা জয়েশ রানে থেকে হার্নান্ডেজ হয়ে বল যায় রয় কৃষ্ণার কাছে এবং বক্সের মাথা থেকে দূরপাল্লার শটে গোল করেন তিনি।
  • ৮৫ মিনিট: অসাধারণ একটি গোল করেন মনবীর সিং। ডান দিকের উইং দিয়ে উঠে নিজেই গোল তৈরি করে কোনাকুনি শটে দর্শনীয় গোলটি করেন মনবীর।

এটিকে মোহনবাগান এদিন মাঠে দল সাজিয়েছিল আগের দিনের মতোই ৩-৫-২-এ। চোট পেয়ে লিগ থেকে প্রায় ছিটকে যাওয়া মাইকেল সুসাইরাজের জায়গায় জয়েশ রানেকে মাঝমাঠে রেখে এবং আক্রমণে রয় কৃষ্ণার সঙ্গে ডেভিড উইলিয়ামসকে রেখে। অন্য দিকে, এসসি ইস্টবেঙ্গলের কোচ রবি ফাউলার তাঁর দল সাজান ৪-২-৩-১-এ। গোলে অভিজ্ঞ দেবজিৎ, রক্ষণে দুই কঠিন বিদেশি প্রহরী স্কট নেভিল ও ড্যানিয়েল ফক্সকে রেখে। পাঁচ মিডফিল্ডারের মধ্যে অ্যান্থনি পিলকিংটন ও জাক মাঘোমা আক্রমণাত্মক ভূমিকায় ও সঙ্গে ফরোয়ার্ড বলওয়ন্ত।

প্রথম ২০ মিনিটে লাল বেশির ভাগ সময় হলুদ শিবিরের দখলেই ছিল বল (৬০-৪০)। ডানদিকের উইং দিয়ে নবাগত সুরচন্দ্র সিং বল নিয়ে ওঠার চেষ্টা করছিলেন বারবার। ১২ মিনিটের মাথায় গত পাঁচ মরশুমে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলে আসা মাঘোমার ক্রস থেকে বক্সের মধ্যে থেকে বল পেয়ে গিয়েছিলেন ৩২ বছর বয়সি আইরিশ পিলকিংটন। কিন্তু স্লাইডিং ট্যাকল করে সে যাত্রা বাঁচিয়ে দেন প্রীতম।

শুরুর দিকে আক্রমণের প্রবণতা বেশির ভাগই দেখা যায় এসসি ইস্টবেঙ্গলের মধ্যে। ওই সময়ে হয়তো বিপক্ষকে পরখ করে নিচ্ছিলেন আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের দলের ছেলেরা। ২৫ মিনিটের পর থেকে আক্রমণে ওঠার চেষ্টা শুরু করে সবুজ মেরুন শিবির। ডান দিকের উইং দিয়ে ওঠা প্রবীর দাস ২৬ মিনিটের মাথায় গোলের সামনে একটা লো ক্রস পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ফক্স তা ক্লিয়ার করে দেন।

এই সময় থেকেই নিজেদের গোলের মুখ বন্ধ রেখে আক্রমণে ওঠার পরিকল্পনা দেখা যায়  দুই দলের মধ্যেই। অর্থাৎ কৌশলের আসল লড়াই দেখা যায় প্রথমার্ধের মাঝামাঝি সময়ের পর থেকেই। ৩৬ মিনিটে থ্রো ইনে পাওয়া বলে বক্সের বাঁ দিক থেকে নেওয়া হাভিয়ে হার্নান্ডেজের গোলমুখী শট দুর্দান্ত ভাবে ডাইভ দিয়ে বাঁচান এসসি ইস্টবেঙ্গল গোলকিপার দেবজিৎ। দেবজিৎ তৎপর না হলে হয়তো তখনই এক গোলে এগিয়ে যেত সবুজ-মেরুন বাহিনী।

পরের মিনিটেই সুরচন্দ্রের ক্রস থেকে বক্সের মধ্যে সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলেন বলওয়ন্ত। কিন্তু ঠিকমতো পা ছোঁয়াতে পারেননি তিনি। দুই দলেরই রক্ষণ এ দিন বিপক্ষের আক্রমণকারীদের রোখার জন্য যথেষ্ট তৎপর ছিল। বারবার গোলের সামনে গিয়ে দু’পক্ষের ফরোয়ার্ডরা হয় ব্যর্থ হন বা তাঁদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেন ডিফেন্ডাররা। তাই প্রথমার্ধের খেলা শেষ হয় গোলশূন্য অবস্থাতেই।

প্রথম ৪৫ মিনিটে এটিকে মোহনবাগানের তারকা স্ট্রাইকার জুটি রয় কৃষ্ণা ও ডেভিড উইলিয়ামসকে দেখে কিন্তু একবারও মনে হয়নি তাঁরা স্বচ্ছন্দে ছিলেন। তবে দ্বিতীযার্ধের শুরুতেই খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসেন ফিজির তারকা এবং ৪৯ মিনিটের মাথায় বক্সের মাথা থেকে দুর্দান্ত শটে গোল করে এগিয়ে দেন দলকে।

বাঁদিকের উইং দিয়ে জয়েশ রানে আক্রমণটি তৈরি করে প্রথমে দেন ফাঁকায় থাকা হার্নান্ডেজকে। তিনি বিপক্ষের এক ডিফেন্ডারকে বোকা বানিয়ে পাস দেন রয়কে এবং নিখুঁত ভাবে কাজটা শেষ করেন তিনি। ড্যানিয়েল ফক্স তাঁকে আটকানোর চেষ্টা করেও পারেননি। তাঁর পায়ের তলা দিয়েই রয় দূরপাল্লার শটে ঝড়ের গতিতে বল পাঠান সোজা গোলে, যা বাঁ দিকে ঝাঁপিয়ে পড়েও আটকাতে পারেননি দেবজিৎ।

গোলের পরেই রক্ষণে জমাট বাঁধা শুরু করে দেয় এটিকে মোহনবাগান। ৬০ মিনিটের পরে ডেভিড উইলিয়ামসকেও তুলে নেন হাবাস। একই সঙ্গে রানের জায়গায় নামান প্রণয় হালদারকে। অন্যদিকে রানা ঘরামির জায়গায় প্রথমে অভিষেক অম্বেকরকে নামান ফাউলার এবং বলওয়ন্তকে তুলে নিয়ে নামান মহম্মদ রফিককে, যিনি প্রথম হিরো আইএসএলের ফাইনালে গোল করে খেতাব এনে দিয়েছিলেন এটিকে এফসি-কে। সব ক’টি পরিবর্তনই দুই কোচ করেন দ্বিতীয়ার্ধে।

এ বারের হিরো আইএসএলে অন্যতম সেরা রক্ষণ এটিকে মোহনবাগানের। সেটা এ দিন প্রমাণ করে দেন সবুজ-মেরুন ডিফেন্ডাররা। তাঁদের তৎপরতায় গোলকিপার অরিন্দম ভট্টাচার্যকে ৭০ মিনিট পর্যন্ত মাত্র একটি বল সেভ করতে হয়। অন্য দিকে, দেবজিৎকে কিন্তু এ দিন অনেক বেশি পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয় এবং মাত্র একবার ছাড়া তিন প্রতিবারই পাশ করে যান।

গোল পেয়ে যাওয়ার পরে যে ভাবে নিজেদের সামনে দেওয়াল তুলে দেয় এটিকে মোহনবাগান, তাতে এসসি ইস্টবেঙ্গেলের পক্ষে বিপক্ষের গোলমুখ খোলা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। পিলকিংটন, মাঘোমারা বারবার বল নিয়ে উঠেও সফল হননি। তবে ৮২ মিনিটে যে শটটি নিয়েছিলেন পিলকিংটন, তা বাঁচিয়ে ইস্টবেঙ্গলকে সমতা আনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেন।

এসসি ইস্টবেঙ্গলের হতাশা বাড়িয়ে তুলতে ৮৫ মিনিটে অসাধারণ একটি গোল করেন মনবীর সিং। ডান দিকের উইং দিয়ে উঠে নিজেই গোল তৈরি করে কোনাকুনি শটে দর্শনীয় গোলটি করেন মনবীর। নিজেই বল নিয়ে এগিয়ে নিজেই জায়গা তৈরি করতে কী ভাবে দেওয়া হল তাঁকে, এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

এটিকে মোহনবাগানের রক্ষণে শক্তি আরও বাড়াতে প্রবীরকে তুলে নিয়ে সুমিত রাঠিকে একেবারে শেষ মিনিটে নামান হাবাস। সঙ্গে রয়কেও তুলে নিয়ে তিনি নামান ব্র্যাড ইনম্যানকে। শেষ পর্যন্ত লিড ধরে রাখার উদ্দেশ্যে তিনি পুরোপুরিই সফল হন।       

এটিকে মোহনবাগান দল: অরিন্দম ভট্টাচার্য (গোল), প্রীতম কোটাল, তিরি, সন্দেশ ঝিঙ্গন, প্রবীর দাস (সুমিত রাঠি), শুভাশিস বসু, হাভিয়ে হার্নান্ডেজ (গ্লেন মার্টিন্স), কার্ল ম্যাকহিউ, জয়েশ রানে (প্রণয় হালদার), রয় কৃষ্ণা (ব্র্যাড ইনম্যান), ডেভিড উইলিয়ামস (মনবীর সিং)

এসসি ইস্টবেঙ্গল দল: দেবজিৎ মজুমদার (গোল), স্কট নেভিল, রানা ঘরামি (অভিষেক অম্বেকর), ড্যানিয়েল ফক্স, নারায়ণ দাস, ম্যাটি স্টাইনমান, লোকেন মেতেই (ওয়াহেংবাম লুয়াং) , সুরচন্দ্র সিং, অ্যান্থনি পিলকিংটন, জাক মাঘোমা, বলওয়ন্ত সিং।