শেষ বেলায় হঠাৎ জ্বলে ওঠা? নাকি নিছকই এক ম্যাচের চমক? বুধবার ঘরের মাঠে তৃতীয় ম্যাচ জিতে এই প্রশ্নের উত্তর আংশিক ভাবে দিতে পারে ইস্টবেঙ্গল এফসি। গত ম্যাচে লিগ টেবলের তিন নম্বরে থাকা কেরালা ব্লাস্টার্সকে হারিয়ে নিজেদের আসল খেলা ঠিক কেমন, তা প্রমাণ করেছেন ক্লেটন সিলভা, নাওরেম মহেশরা। বুধবার দুর্বল নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি-কে হারাতে পারলে শেষ বেলায় নিজেদের পায়ের তলার আরও কিছুটা মাটি শক্ত করতে পারবে লাল-হলুদ বাহিনী। এটাই ফের এক উজ্জীবিত ফুটবল উপহার দেওয়ার সবচেয়ে বড় প্রেরণা।  

এই ম্যাচে যারা ইভান গঞ্জালেসদের প্রতিপক্ষ, সেই নর্থইস্ট ইউনাইটেড এ বারের মতো এত খারাপ পারফরম্যান্স আর কোনও বার করেনি। ১৭ ম্যাচে মাত্র একটি জয় ও একটি ড্র-কে সম্বল করে তারা এখন লিগ টেবলের একেবারে নীচে। ১৩ গোল দিয়ে খেয়েছে ৪৫ গোল। এত কম গোল এ বার আর কোনও দলই দেয়নি। এই ব্যাপারে তাদের চেয়ে অন্য সব দলই এগিয়ে। আর যে তিনটি ম্যাচ বাকি রয়েছে তাদের, সেই তিন ম্যাাচে অন্তত পাঁচ পয়েন্ট না পেলে এক মরশুমে সবচেয়ে কম পয়েন্ট সংগ্রহের নতুন নজির গড়বে অসমের দলটি। এই অসন্মান থেকে বাঁচার জন্য তারা শেষ বেলায় সর্বস্ব উজাড় করে দিতে পারে কি না, সেটাই দেখার।   

ক্ষীণ আশার আলো লাল-হলুজ শিবিরে

নর্থইস্টের যেমন সেরা ছয়ে যাওয়ার আর ছিটেফোঁটা সম্ভাবনাও বেঁচে নেই, ইস্টবেঙ্গলের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কিন্তু সে রকম নয়। শেষ চার ম্যাচ থেকে যদি তারা ১২ পয়েন্ট অর্জন করতে পারে, তা হলে তাদের সেরা ছয়ে পৌঁছনোর একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা অবশ্যই থাকছে। অঙ্কের হিসেব অন্তত সে রকমই বলছে। এখন যদি লাল-হলুদ বাহিনী তাদের বাকি সব ম্যাচে জেতে (হবে ২৭ পয়েন্ট), যদি বেঙ্গালুরু এফসি তাদের বাকি তিনটি ম্যাচে হেরে যায় (হবে ২৫), ওড়িশা এফসি যদি তাদের শেষ তিন ম্যাচেই হেরে যায় (হবে ২৪) এবং চেন্নাইন এফসি যদি আরও তিনটি ম্যাচে হেরে যায় (হবে ১৯ বা ২১), তা হলে কিন্তু ছ’নম্বর দল হিসেবে ইস্টবেঙ্গল প্লে-অফে খেলার সুযোগ পাবে। একাধিক অলৌকিক কাণ্ডের দিকে তাকিয়ে থাকাটা যদিও বাড়াবাড়ি, তবু ক্ষীণতম আশা তো আছে লাল-হলুদ বাহিনীর সামনে। অন্ধকারের মধ্যে সরু সুতোর মতো সেই ক্ষীণ আশার আলোর দিকে তাকিয়ে এখন এগোতে পারে তারা।  

কিন্তু নর্থইস্ট ইউনাইটেডের পর তাদের মুখোমুখি হতে হবে চেন্নাইন এফসি, মুম্বই সিটি এফসি ও সবার শেষে এটিকে মোহনবাগানের। তাদের অতি বড় সমর্থকের পক্ষেও এই সব ম্যাচে প্রিয় দলের জয়ের কথা ভাবা সম্ভব ছিল না, যদি না কেরালা ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে রীতিমতো দাপুটে জয় পেত তারা। শেষ ম্যাচগুলিতে চাপমুক্ত লাল-হলুদ বাহিনী যদি ফের এ রকম দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দিতে পারে, তা হবে বিশাল অঘটন। সে রকমই অঘটনের আশায় হয়তো আছে লাল-হলুদ জনতা।

জার্ভিসে চনমনে শিবির

দলের নতুন ব্রিটিশ ফরোয়ার্ড জেক জার্ভিস, যিনি এর আগে ফিনল্যান্ডের ক্লাব এসজেকে-র হয়ে খেলতেন, একসময় বার্মিংহাম সিটির হয়েও খেলেছেন যিনি, তাঁকে লাল-হলুদ জার্সি গায়ে প্রথম ম্যাচে তেমন আহামরি না লাগলেও তাঁর উপস্থিতিতে কিন্তু দলের আক্রমণ বিভাগ অনেকটাই চনমনে হয়ে গিয়েছে। কেরালা ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে দুটি গোলের সুযোগ পেয়ে হাতছাড়া করেন তিনি। জার্ভিস প্রতিপক্ষের গোল এরিয়ায় সমানে দৌড়ে বেড়ানোয় শিবিরের মূল অস্ত্র ব্রাজিলীয় তারকা ক্লেটন সিলভা অনেকটা হাল্কা হয়ে খেলতে পারছেন। যার ফলে তিনি যেমন গোল করছেন, তেমনই গোলের সুযোগও তৈরি করছেন।

গত শুক্রবার, ৩৭-এ পা দেওয়ার দিনে ক্লেটন সিলভা তাঁর ৭৭ মিনিটের গোলে দলকে ১-০-য় জিতিয়ে ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে প্রথম লিগে হারের বদলা নিয়ে নেয়। সম্ভবত এটাই ছিল এ বারের লিগে ইস্টবেঙ্গল এফসি-র সেরা পারফরম্যান্স। সেই ম্যাচেই চলতি বছরের প্রথম জয়, ঘরের মাঠে দ্বিতীয় জয় ও টানা চারটি ম্যাচে হারার পরে প্রথম ও দুঃসাহসিক জয় পায় লাল-হলুদ ব্রিগেড। ব্লাস্টার্সের মতো দলকে যদি হারাতে পারে তারা, তা হলে নর্থইস্টের মতো দুর্বল দলের বিরুদ্ধে জয় না পাওয়ার কোনও কারণ নেই।

তবে এর মধ্যেই একটা খারাপ খবর, বুধবারের ম্যাচে ভিপি সুহের ও মোবাশির রহমান কার্ড সমস্যার জন্য খেলতে পারবেন না। দু’জনেই দলের আক্রমণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু এই দুই সদস্যের অনুপস্থিতি দল কী ভাবে সামলায় সেটাই দেখার। এ ছাড়া ডিপেন্ডার অঙ্কিত মুখার্জি মাঠে অসংযত আচরণ করায় ক্লাবের পক্ষ থেকে তাঁকে শো-কজ নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তিনিও সম্ভবত এই ম্যাচে খেলতে পারবেন না। গত ম্যাচে তাঁর জায়গায় নেমে মহম্মদ রকিপ ভাল খেলেন। ফলে এই জায়গায় হয়তো তাঁকেই দেখা যাবে। সুহেরের জায়গায় সেম্বয় হাওকিপ ও মোবাশিরের জায়গায় সুমিত পাসিকে হয়তো দেখা যেতে পারে প্রথম এগারোয়।  

সংখ্যা যা বলছে

ইস্টবেঙ্গল আটটির মধ্যে দু’টি হোম জিতেছে। নর্থইস্ট ইউনাইটেড বাইরে গিয়ে এখনও একটিও ম্যাচ জিততে পারেনি। এ বারের লিগে এই দুই দলই ৩০ বা তার বেশি গোল হজম করেছে। ইস্টবেঙ্গল ৩১ ও নর্থইস্ট ৪৫। এ রকম আরও দুটি দল চলতি লিগে ৩০ বা তার বেশি গোল খেয়েছে, চেন্নাইন এফসি (৩১) ও জামশেদপুর এফসি (৩০)।

হিরো আইএসএলে যোগ দেওয়ার পর থেকে ইস্টবেঙ্গল এফসি এ মরশুমে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ম্যাচ জিতলেও (৫) পয়েন্টের দিক থেকে কিন্তু এখনও তাদের সর্বোচ্চ সংগ্রহকে ছুঁতে পারেনি। সে জন্য দরকার আরও দুই পয়েন্ট। ২০২০-২১ মরশুমে ১৭ পয়েন্ট পেয়ে লিগ শেষ করেছিল লাল-হলুদ শিবির। এ বার তাদের অর্জিত পয়েন্ট এখন ১৫। বুধবার জিতলে এই সর্বোচ্চ পয়েন্টের সীমাও পেরিয়ে যাবে তারা। হারলেও সবচেয়ে বেশি হারের নয়া মাইলফলক প্রতিষ্ঠা করবে। ২০-২১ মরশুমে ১১টি ম্যাচ হেরেছিল তারা। এ বারও এখন পর্যন্ত ১১টি ম্যাচ হেরেছে। 

নর্থইস্ট ইউনাইটেড এ পর্যন্ত ১৫টি ম্যাচ হেরেছে, যা এক নতুন নজির। হিরো আইএসএলের এক মরশুমে এত ম্যাচ এর আগে কেউ হারেনি। এই মরশুমে তারা সবচেয়ে কম গোল করেছে, ১৩টি এবং সবচেয়ে বেশি গোল খেয়েছে। এর আগে কোনও দল আইএসএলের এক মরশুমে ৪৫ গোল খায়নি। গত তিন ম্যাচে তারা কোনও গোল করতে পারেনি। শেষ ছ’ম্যাচে তারা জয়হীন, যার মধ্যে পাঁচটিতেই হেরেছে তারা। যে হারে গোল খেয়েছে তারা, সেই হারেই গোল খেতে থাকলে লিগের শেষে ৫০ গোল খাওয়ার নয়া নজির গড়তে পারে তারা।   

দ্বৈরথের ইতিহাস

হিরো ইন্ডিয়ান সুপার লিগে দুই দল মুখোমুখি হয়েছে পাঁচবার। ইস্টবেঙ্গল প্রতিবেশি রাজ্যের দলটিকে হারিয়েছে মাত্র একবার, তাও চলতি মরসুমের প্রথম লিগে। নর্থইস্ট জিতেছে তিনবার। একটি ম্যাচ ড্র হয়েছে। ২০২০-২১ মরশুমে প্রথম লেগে নর্থইস্ট জেতে ২-০-য়। সেবার দ্বিতীয় লেগে ফের ইস্টবেঙ্গল হারে ১-২-এ। গত মরশুমে প্রথম লেগে নর্থইস্ট ২-০-য় জেতে এবং ফিরতি লেগে ১-১ ড্র হয়। গত অক্টোবরে চলতি লিগের প্রথম ম্যাচে ৩-১ জয় পায় কলকাতার দল। সেই ম্যাচে ১১ মিনিটের মধ্যেই দলকে এগিয়ে দেন ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড ক্লেটন সিলভা। দ্বিতীয় গোল আসে ম্যাচের সেরা চ্যারিস কিরিয়াকুর পা থেকে। জয় সুনিশ্চিত করেন অস্ট্রেলিয়ান মিডফিল্ডার জর্ডন ও’ডোহার্টি। নর্থইস্টের পক্ষে বাড়তি সময়ে একটি গোল শোধ করেন ম্যাট ডার্বিশায়ার।

ইস্টবেঙ্গল স্কোয়াড: গোলকিপার- পবন কুমার, কমলজিৎ সিং; ডিফেন্ডার- সার্থক গলুই, মহম্মদ রফিক, ইভান গঞ্জালেজ, চারালাম্বোস কিরিয়াকু, অঙ্কিত মুখার্জি, লালচুঙনুঙ্গা, জেরি লালরিনজুয়ালা, প্রীতম কুমার সিং, নবি হুসেন খান; মিডফিল্ডার- অমরজিৎ সিং কিয়াম, তুহীন দাস, আঙ্গুসানা ওয়াহেংবাম, অ্যালেক্স লিমা, শৌভিক চক্রবর্তী, জর্ডান ও’ডোহার্টি, মহেশ সিং নাওরেম, মোবাশির রহমান, সুমিত পাসি, হিমাংশু জাঙরা; ফরোয়ার্ড- জেক জার্ভিস, ক্লেটন সিলভা, সেম্বয় হাওকিপ, ভিপি সুহের।  

কিক অফ- ৮ ফেব্রুয়ারি, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়, কলকাতার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে

সম্প্রচার- স্টার স্পোর্টস নেটওয়ার্ক, হটস্টার ও জিও টিভিতে।