দু’পা করে এগোয় তো তিন পা করে পিছিয়ে যায়। ধারাবাহিকতার অভাব এমন ভাবে এটিকে মোহনবাগানকে জড়িয়ে ধরেছে যে, তাদের এ রকমই দশা। গত ম্যাচে লিগ টেবলে চার নম্বরে থেকে মাঠে নেমেছিল সবুজ-মেরুন বাহিনী। লক্ষ্য ছিল তিন পয়েন্ট পেয়ে দু’নম্বর হায়দরাবাদ এফসি-র আরও কাছাকাছি পৌঁছনো। কিন্তু ঘরের মাঠে বেঙ্গালুরু এফসি-র কাছে হার তাদের পাঁচ নম্বরে পাঠিয়ে দিয়েছে। 

ফের ওপরে ওঠার লড়াই শুরু করতে হবে গতবারের সেমিফাইনালিস্টদের। আর ওপরে ওঠার সেই রাস্তায় বৃহস্পতিবার তাদের মুখোমুখি জামশেদপুর এফসি, যারা আপাতত লিগ টেবলে দশ নম্বরে। টানা দশ ম্যাচে জয়হীন থাকার পরে যারা সদ্য জয়ের পথে ফিরেছে। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, এই ম্যাচে জিতে ফের লড়াইয়ে ফিরতে পারবে স্প্যানিশ কোচ হুয়ান ফেরান্দোর দল? 

কয়েক দিন আগেই গতবারের চ্যাম্পিয়ন কেরালা ব্লাস্টার্সকে যে ভাবে হারিয়ে দেয় ইস্টবেঙ্গল এফসি, তার পরে আর কোনও ম্যাচের আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করতে চাইছেন না বিশেষজ্ঞরা। কখন যে কী হবে, তার কোনও ঠিক নেই। হিরো ইন্ডিয়ান সুপার লিগ অবশ্য বরাবরই এ রকম, অনিশ্চয়তায় ঠাসা। এই লিগে যে কোনও ম্যাচে যে কোনও দল যে কোনও প্রতিপক্ষকে হারাতে পারে। গত কয়েকটি ম্যাচের ফলে তারই স্পষ্ট প্রতিফলন দেখা গিয়েছে। 

তিন ধাপ ওপরে থাকা এফসি গোয়াকে ১-১-এ রুখে দেয় ওডিশা এফসি। বেঙ্গালুরু এফসি হারায় চেন্নাইন এফসি-কে। ইস্টবেঙ্গল ছাড়াও কেরালা ব্লাস্টার্সকে হারায় এফসি গোয়াও। এমন ফলের কথা আগে থেকে ভাবা বেশ কঠিন। তাই বিভিন্ন দলের কোচেরাও বলেন, এই লিগে কোনও ম্যাচই সহজ নয় এবং কোনও প্রতিপক্ষই দুর্বল নয়। সেরা ছয়ে থাকা দলগুলিকে হারানোর ক্ষমতা রাখে নীচের দিকের সব দলই। 

তাই শুক্রবারের ম্যাচেও যে দশ নম্বরে থাকা জামশেদপুরকে হারাতে পারবেই এটিকে মোহনবাগান, এমন কথা হলফ করে কেউই বলতে পারবে না। সবচেয়ে বড় কথা এটিকে মোহনবাগান গত ম্যাচে হারার পরে এই অ্যাওয়ে ম্যাচে নামছে। জামশেদপুর কিন্তু গত ম্যাচে জিতেছে। গত চারটি ম্যাচের মধ্যে দুটিতেই জিতেছে ইস্পাতনগরীর দল। অথচ তার আগের দশটি ম্যাচের একটিতেও জয় পায়নি তারা। সুতরাং, ক্রমশ নিজেদের সেরা জায়গায় ফিরে আসছে তারা। 

এটিকে মোহনবাগানে সবথেকে বড় সমস্যা ধারাবাহিকতার অভাব। ডিসেম্বরে টানা তিন ম্যাচে জেতার পরে দু’টি ম্যাচের একটিতে ড্র করল তারা একটিতে হারল। দুই ম্যাচে জয়হীন থাকার পরে এফসি গোয়াকে হারাল তারা। তার পরে আবার দুটি ম্যাচ থেকে এক পয়েন্টের বেশি অর্জন করতে পারেনি তারা। কিন্তু ওডিশা এফসি-র বিরুদ্ধে এমন ভাবে ফিরে আসে তারা, যাতে মনে হয়, এটাই তাদের মরশুমের সেরা পারফরম্যান্স। ওডিশার বিরুদ্ধে এত ভাল খেলার পরেও গত ম্যাচে বেঙ্গালুরু এফসি-র বিরুদ্ধে ঘরের মাঠে অবিশ্বাস্য খারাপ ফর্মে দেখা যায় তাদের। 

গত ম্যাচে প্রথমার্ধে টানটান উত্তেজনায় ঠাসা ফুটবলের পর দ্বিতীয়ার্ধে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিতে দেখা যায় বেঙ্গালুরু এফসি-কে। প্রথমার্ধে যে দাপট দেখিয়েছিল সবুজ-মেরুন বাহিনী, দ্বিতীয়ার্ধে তাদের সেই দাপট উধাও। শেষ পর্যন্ত ১-২-এ হারে তারা। দু’দিন আগে কেরালা ব্লাস্টার্সকে ঘরের মাঠে হারিয়ে ইস্টবেঙ্গল এফসি যে সুবিধা করে দিয়েছিল সবুজ-মেরুন বাহিনীকে, সেই সুবিধা তারা কাজে লাগাতে পারেনি মূলত হুগো বুমৌস ও আশিক কুরুনিয়ান খেলতে না পারায় এবং দুই ফরোয়ার্ড লিস্টন কোলাসো ও মনবীর সিং ছন্দে না থাকায়। বৃহস্পতিবার ডেআরডি টাটা স্পোর্টস কমপ্লেক্সে তারা ছন্দে ফিরতে না পারলে ফের সমস্যায় পড়তে পারে তারা। তবে এই ম্যাচে বুমৌসকে পাবেন পেট্রাটসরা, এটা বড় ভরসা। কিন্তু কোলাসো-মনবীরদের ফর্ম কবে ফিরবে, সেই প্রশ্নের উত্তর কারও কাছে নেই। 

ইস্পাতকঠিন নয় ইস্পাতনগরী  

ইস্পাতনগরীর দলের একসময় টানা দশটি ম্যাচে কোনও জয় ছিল না। চেন্নাইনের বিরুদ্ধে ঋত্বিক দাসের জোড়া গোল তাদের বহু আকাঙ্খিত জয়ের দিকে নিয়ে গেলেও শেষে প্রতিপক্ষের ভিঞ্চি ব্যারেটো ও পেটার স্লিসকোভিচের দুটি গোল তাদের জয়ে ফেরার চেষ্টায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। শেষ পর্যন্ত তারা জয়ে ফেরে ইস্টবেঙ্গল এফসি-র বিরুদ্ধে। কিন্তু ফের বেঙ্গালুরু ও মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে হারের মুখ দেখতে হয় তাদের। কিন্তু গত ম্যাচে নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি-র বিরুদ্ধে জয়ে ফিরেছে তারা। 

মুম্বই সিটি এফসি তাদের বিরুদ্ধে ম্যাচের শেষ দিকে দু’টি গোল দিয়ে জেতে। না হলে ৮০ মিনিট পর্যন্ত বেশ চাপে ছিল তারা। ম্যাচের অনেককাংশেই রাশ নিজেদের হাতে রেখে দিয়েছিলেন ড্যানিয়েল চুকুউ চিমা, হ্যারি সয়্যাররা। গত ম্যাচে ঋত্বিক ও চিমার গোলেই জয় পায় রেড মাইনার্স-রা। সেই ম্যাচে রাফায়েল ক্রিভেলারোকে প্রথম থেকে খেলান কোচ এডি বুথরয়েড। সয়্যার ছিলেন রিজার্ভ বেঞ্চে। এটিকে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে ক্রিভেলারোই শুরু থেকে খেলবেন, না সয়্যার নামবেন, সেটাই দেখার। তবে ঋত্বিককে নজরে রাখতেই হবে প্রীতম কোটালদের। তাঁকে ছেড়ে রাখলে বিপদে পড়তে পারে সবুজ-মেরুন বাহিনী।     

বুথরয়েডের দলের রক্ষণ অবশ্য খুব একটা ভাল অবস্থায় নেই। কারণ, গত ১৬টি ম্যাচের মধ্যে মাত্র দু’টিতে ক্লিন শিট রেখে মাঠ ছাড়ে তারা। সবচেয়ে বেশি গোল খেয়েছে যে দলগুলি, সেই তালিকায় তারা (৩০) আপাতত রয়েছে চার নম্বরে, নর্থইস্ট ইউনাইটেড (৪৫), চেন্নাইন এফসি-র (৩৩) ও ইস্টবেঙ্গলের (৩১) পরেই। ইস্পাতনগরীর দল হলেও জামশেদপুরের রক্ষণ কিন্তু মোটেই ইস্পাতকঠিন নয়। ফলে পেট্রাটস, মনবীর, কোলাসো, বুমৌসরা খুব খারাপ না খেললে গোল পেতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় তাদের। 

সংখ্যা যা বলছে 

চলতি মরশুমে ন’টি হোম ম্যাচের মধ্যে মাত্র একটিতে জিতেছে জামশেদপুর এফসি। হেরেছে ৬টিতে। ঘরের মাঠে তারা ১৭টি গোল হজম করেছে। শুধু নর্থইস্ট ঘরের মাঠে তাদের চেয়ে বেশি গোল খেয়েছে। এটিকে মোহনবাগান সাতটি অ্যাওয়ে ম্যাচ খেলে জিতেছে দু’টিতে। গত তিনটি অ্যাওয়ে ম্যাচে জয় পায়নি তারা। এমনকী, কোনও গোলও পায়নি। জামশেদপুর যেখানে এ পর্যন্ত ৩০টি গোল খেয়েছে, সেখানে এটিকে মোহনবাগান তাদের অর্ধেক (১৫) গোল হজম করেছে। 

জেতার জায়গা থেকে ফিরে এসে এ পর্যন্ত মোট দশ পয়েন্ট খুইয়েছে ইস্পাতনগরীর দল, যা এ বারের লিগে সর্বোচ্চ। ঘরের মাঠে তাদের ৫০ গোল হতে আর তিন গোল বাকি। হিরো আইএসএলে  ১৫০ গোলের মাইলস্টোন ছুঁতেও জামশেদপুরকে আর তিনটি গোল পেতে হবে। 

দিমিত্রিয়স পেট্রাটসই এখন এটিকে মোহনবাগানের গোলমেশিন এবং তাঁর ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে সবুজ-মেরুন শিবিরকে। গত ম্যাচে তিনিই একমাত্র ও সান্ত্বনা গোলটি এনে দেন দলকে। পরপর দুই ম্যাচে তিনি গোল করেছেন। এ বার তৃতীয় ম্যাচেও গোল পান কি না, সেটাই দেখার। আট গোল করে তিনিই এখন দলের সর্বোচ্চ গোলদাতা। এর আগে শুধু রয় কৃষ্ণাই এক মরশুমে দিমির চেয়ে বেশি গোল করেছেন। ২০২০-২১-এ রয় ১৪ গোল করেছিলেন সবুজ-মেরুন জার্সি গায়ে। 

এটিকে মোহনবাগান এ পর্যন্ত পাঁচটি ম্যাচ হেরেছে। ২০২০-২১ মরশুমেও ২৩টির মধ্যে পাঁচ ম্যাচে হেরেছিল তারা। এ মরশুমে আর একটি ম্যাচ হারলে হিরো আইএসএলের এক মরশুমে সবচেয়ে বেশি ম্যাচে হার হবে তাদের। কারণ, চলতি লিগে ১৬ ম্যাচে ইতিমধ্যেই পাঁচবার হেরেছে তারা। গত দু’টি মরশুমে সব মিলিয়ে পাঁচটি ম্যাচে গোলশূন্য ছিল তারা। এই মরশুমে ইতিমধ্যেই পাঁচ ম্যাচে গোল দিতে পারেনি তারা। গোলের সুযোগ হাতছাড়া করাতেও তারা নিজেদের অতীত-নজির ভেঙে দিয়েছে। তাদের গোল কনভারশন রেট ৮.৬৯%। এই রেটের দিক থেকে তাদের ওপরে আরও আটটি দল রয়েছে।  

দ্বৈরথের ইতিহাস

এ বার খুব একটা ভাল অবস্থায় না থাকলেও হিরো ইন্ডিয়ান সুপার লিগের পরিসংখ্যান কিন্তু এগিয়ে রেখেছে জামশেদপুর এফসি-কেই। হিরো আইএসএলে দুই দল মুখোমুখি হয়েছে মোট পাঁচবার। তার মধ্যে তিনবারই জেতে ইস্পাতনগরীর দল। দু’টিতে জেতে এটিকে মোহনবাগান। গত মরশুমে শেষ মুখোমুখিতেও জামশেদপুর জিতেছিল ঋত্বিক দাসের একমাত্র গোলে। সেই ম্যাচে জিতেই তারা গতবারের লিগশিল্ড অর্জন করে। সেবার প্রথম লিগেও জামশেদপুর জিতেছিল ২-১-এ। ২০২০-২১ মরশুমে প্রথম ম্যাচে জামশেদপুর ২-১ জিতলেও ফিরতি লিগে এটিকে মোহনবাগান ৮৫ মিনিটে রয় কৃষ্ণার দর্শনীয় গোলে জেতে। আর এ বার প্রথম লিগে বুমৌসের ৯০ মিনিটের গোলে জেতে সবুজ-মেরুন বাহিনী। 

এটিকে মোহনবাগান স্কোয়াড: গোলকিপার- বিশাল কয়েথ, অর্শ শেখ, দেবনাথ মন্ডল; ডিফেন্ডার- আশিস রাই, ব্রেন্ডান হ্যামিল, স্লাভকো দামজানোভিচ, দীপক টাঙরি, প্রীতম কোটাল, রবি রাণা, শুভাশিস বোস, সুমিত রাঠি; মিডফিল্ডার- অভিষেক সূর্যবংশী, কার্ল ম্যাকহিউ, ইঙ্গসন সিং, হুগো বুমৌস, ফেদরিকো গালেগো, লালরিনলিয়ানা হ্নামতে, লেনি রড্রিগেজ, আশিক কুরুনিয়ান, রিকি সাবং; ফরোয়ার্ড- দিমিত্রিয়স পেট্রাটস, কিয়ান নাসিরি, লিস্টন কোলাসো, মনবীর সিং, মহম্মদ ফারদিন আলি মোল্লা। 

কিক অফ- ৯ ফেব্রুয়ারি, সন্ধ্যা ৭.৩০, জামশেদপুরের জেআরডি টাটা স্পোর্টস কমপ্লেক্সে

সম্প্রচার- স্টার স্পোর্টস নেটওয়ার্ক, হটস্টার ও জিও টিভি