ফুটবলে গোলই যেখানে শেষ কথা, সেখানে ফুটবল বা ফুটবলারদের নিয়ে লিখতে বসলে সবার আগে গোলের কথাই আসে। গোলই একজন ফুটবলারের জীবন বদলে দিতে পারে। আর এই কথাটা সুশান্ত ম্যাথুর চেয়ে ভাল আর কে জানেন?

সম্প্রতি পেশাদার ফুটবল থেকে অবসর নিলেন সুশান্ত, যিনি প্রথম হিরো আইএসএল-এর প্রথম মরশুমে কেরালা ব্লাস্টার্সের হয়ে সব মিলিয়ে চার ম্যাচে ৫৬ মিনিট খেললেও একটা গোলই তাঁকে এই ক্লাবের ইতিহাসে জায়গা করে দিয়েছে। অসাধারণ সেই বিশ্বমানের গোলটা সুশান্ত দিয়েছিলেন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী চেন্নাইন এফসি-র বিরুদ্ধে।

৪১ বছর বয়সি সদ্য অবসর নেওয়া কেরালার এই ফুটবল তারকা হিরো আইএসএল-এর নিজস্ব ওয়েবসাইটে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেই গোলের স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, “ফুটবল জীবনে অনেক মধুর স্মৃতি রয়েছে আমার। আন্তর্জাতিক তারকাদের সঙ্গে খেলা, তাদের সঙ্গে এক ড্রেসিংরুমে থাকা। কিন্তু ওই গোলটার কোনও তুলনা হবে না। ওই গোলের স্মৃতি সারা জীবন উপভোগ করব আমি। কারণ, ওই ওই একটা গোলই আমার জীবন বদলে দিয়েছিল। আমাকে নায়কের আসনে বসিয়ে দিয়েছিল। এখনও অনেকে আমাকে ফোন করে বা মেসেজ করে বলে, তারা যখনই ওই গোলটা দেখে, তখনই তাদের গায়ে কাঁটা দেয়। অনেককে বলতে শুনেছি ওটাই আইএসএল-এর ইতিহাসে সেরা গোল। আমার সৌভাগ্য যে, ওই একটা গোলের জন্যই লোকে এখনও আমাকে মনে রেখেছে”।

এটা ঠিকই যে, সুশান্তের সেই গোলটা হয়তো হিরো আইএসএল-এর অন্যতম সেরা গোল হিসেবে রয়ে যাবে চিরকাল। কেরালার ফুটবলপ্রেমীরা আজও সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই গোলের স্মৃতি তাজা করে তোলেন প্রায়ই। সে বার কেরালা ব্লাস্টার্স কোনও রকমে সেমিফাইনালে উঠে প্রতিবেশী রাজ্যের দল চেন্নাইন এফসি-র মুখোমুখি হয়েছিল। চেন্নাইন লিগের সেরা দল হিসেবে সেরা চারে উঠেছিল। স্বাভাবিক ভাবেই কেরালা ব্লাস্টার্সকে কেউ জয়ীর আসনে বসাতে রাজিই ছিল না। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই ম্যাচে প্রথম ৪৫ মিনিটের মধ্যেই ২-০ গোলে এগিয়ে যায় কেরালা! শুনতে অবাক লাগলেও এটাই কিন্তু সত্যি। দ্বিতীয়ার্ধে চেন্নাইনকে কার্যত বোতলবন্দি করে রেথেছিল তারা। ম্যাচের শেষ মুহূর্তে অসাধারণ সেই গোলটা করে সে দিন নিজেদের মাঠে রাজকীয় জয় অর্জন করেছিল কেরালা ব্লাস্টার্স। আর তার অন্যতম নায়ক ছিলেন এই সুশান্ত ম্যাথু।

গোলের অন্তত ৪০ গজ দূরে বলটা ধরেন সুশান্ত। প্রথমেই কাটিয়ে নেন ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের প্রাক্তন তারকা ও চেন্নাইনের ব্যাক হিসেবে খেলা মাইকেল সিলভেস্টরকে। পরের মুহূর্তেই কিংবদন্তি ইতালিয়ান ডিফেন্ডার আলেসান্দ্রো নেস্তা তাঁর সামনে এসে পড়েন। তাঁর বাঁদিক দিয়ে এমন একটা বাঁকানো শট নেন সুশান্ত যে, সেই শটেই গোলের বাঁদিকের ওপরের কোণ দিয়ে বলটা ঢুকে জালে জড়িয়ে যায়। এ আইএসএল না বিশ্বকাপের গোল!এই বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই কোচির স্টেডিয়ামের গ্যালারি আনন্দের উল্লাসে ফেটে পড়ে। বিশ্বের তাবড় ফুটবলতারকাদের উপস্থিতিতেও এক ভারতীয় ফুটবলারের এমন বিশ্বমানের গোল দেখা যে কী তৃপ্তির, তা বোঝা গিয়েছিল দর্শকদের ওই উল্লাসে। অপ্রত্যাশিত জয় পাওয়ার চেয়েও সে দিন কেরালার সমর্থকদের বেশি উত্তেজিত করে তুলেছিল ওই চিরস্মরণীয় গোল।

ফিরতি লেগে চেন্নাইন ম্যাচটা অতিরিক্ত সময় পর্যন্ত গড়িয়ে নিয়ে গেলেও স্টিফেন পিয়ারসনের গোল কেরালা ব্লাস্টার্সকে ফাইনালের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলেও প্রথম লেগে সুশান্তের ওই অবিশ্বাস্য গোলের জন্যই তাদের ফাইনালের রাস্তা সাফ হয়েছিল। যেখানে তারা কলকাতার এটিকে-র কাছে শেষ পর্যন্ত হেরে যায়। “কেরালার ছেলে হয়ে কেরালার দলকে প্রথম আইএসএল-এর ফাইনালের তোলার আনন্দ আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। দলের কাছেও এটা বিরাট সম্মান”।

২০১০ থেকে ২০১৩—এই চার বছর কলকাতার দুই প্রধানে খেলে যাওয়া সুশান্তকে যেমন ফুটবল জীবনের সেরা দিন দেখিয়েছে হিরো আইএসএল, তেমনই দুঃসময়ও দেখিয়েছে। দ্বিতীয় মরশুমে তিনি যোগ দেন পুণে এফসি-তে। কিন্তু নিয়তি যেন তাঁর সেই ক্লাব বদলের অপেক্ষাতেই ছিল। পুণের হয়ে তিনটি ম্যাচ খেলার পরে ফ্রান্সের প্রাক্তন আন্তর্জাতিক তারকা ফ্লোরঁ মালুদার কড়া ট্যাকলের শিকার হয়ে পুরো মরশুমের জন্যই ছিটকে যান সুশান্ত।

সেই সর্বনাশা ট্যাকলের কথা মনে পড়লে আজও আঁতকে ওঠেন ৪১ বছর বয়সি ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। বলেন, “সেই সময়টা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা সময়। ট্যাকলটা সত্যিই খুব বিপজ্জনক ছিল। মালুদার মতো একজন নামী বিশ্বকাপ তারকা এমন একটা ট্যাকল করেছিল বলে আরও কষ্ট হয়েছিল। ও যে ফ্রান্স দলের সদস্য ছিল, সেই দলটার বিরাট ভক্ত ছিলাম আমি। বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, বিশ্বকাপের আগে ওদের ওই টিমটার একটা বিরাট পোস্টার আমাদের পাড়ায় টাঙিয়েছিলাম আমি। আর সেই দলেরই একজন সদস্যা কী না আমার কেরিয়ারটাই নষ্ট করে দিল! এ কথা ভেবে খুব মানসিক যন্ত্রণায় ভুগেছিলাম অনেক দিন”।

সেই ঘটনাই ফুটবল মাঠ থেকে ছিটকে দেয় তাঁকে। সুশান্ত বলেন, “সেই মরশুমে আর খেলা হয়নি আমার। দীর্ঘদিন চিকিৎসা ও রিহ্যাবের পরে যখন মাঠে ফিরলাম, তখন আর নিজেকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে পারিনি। তবে আমি মানসিক ভাবে খুব শক্তিশালী ছিলাম। কখনও হাল ছেড়ে দিইনি। পরিশ্রম করেছিলাম, যাতে আরও কয়েকটা বছর খেলতে পারি। ফুটবলে তো এমন দুঃসময় এসেই থাকে”।

কেরালার বাইরে খেলেছেন বহু জায়গায়। গোয়া, মুম্বই, কলকাতা, শিলং, ইম্ফল। কিন্তু নিজের রাজ্যের ফুটবলপ্রেমীদের সামনে খেলে যে আনন্দ পেয়েছেন তিনি, তার চেয়ে বেশি আনন্দ আর কোথাও খেলে পাননি, নিজেই এ কথা জানিয়েছেন সুশান্ত।  তাঁর কথায়, “কেরালার মানুষের কাছ থেকে যে ভালবাসা পেয়েছি তার কোনও তুলনা হবে না। কোচির স্টেডিয়ামে হলুদ জার্সি পরে মাঠে নামার সেই দিনগুলো খুব মিস করি। যে কোনও খেলোয়াড়ের কাছে ভক্ত, সমর্থকেরাই সবচেয়ে বড় মোটিভেশন। আমি ভাগ্যবান যে, সমর্থকদের কাছ থেকে ভরপুর ভালবাসা পেয়েছি। হ্যাটস অফ”।

হিরো আইএসএল-এর প্রশংসা করে তিনি বলেন, “২০১৪-য় হিরো আইএসএল শুরু হওয়ার পরে দেশের ফুটবল সংস্কৃতিই পুরো পাল্টে গিয়েছে। এই লিগই এখন দেশের ফুটবলের ভবিষ্যৎ। জানেন, এখন ভারতে বাচ্চারা সবাই ফুটবল খেলতে চায়! বাবা-মায়েরা তাঁদের বাচ্চাদের বিভিন্ন ফুটবল অ্যাকাডেমিতে পাঠাচ্ছেন। প্রায় সকলেই এখন নিয়মিত লাইভ ফুটবল দেখে। সারা দেশে বহু অ্যাকাডেমিও গড়ে উঠেছে। হিরো আইএসএল-এর জন্য আমাদের দেশের ফুটবলাররা আন্তর্জাতিক ফুটবলারদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে খেলার সুযোগ পাচ্ছে। তাদের কাছ থেকে কত কী শিখতে পারছে তারা।”

নিজের অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়ে সুশান্ত ম্যাথু বলছেন, “আরও দু-একটা বছর খেলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বর্তমানে আমার যা পরিস্থিতি, তাতে খেলা চালিয়ে যাওয়া আর সম্ভব হচ্ছে না। বাড়ির বাইরে থাকতে হচ্ছে দিনের পর দিন, ফিটনেসও আর আগের মতো নেই। ঈশ্বরের আশীর্বাদে টানা ২০ বছর ফুটবল খেলেছি। আমি ভাগ্যবান যে এত দিন ধরে খেলতে পেরেছি। তাই আমার পক্ষে এটাই অবসর নেওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত সময় ছিল”।