হিরো আইএসএল শুরু হতে বাকি আর মাত্র কয়েকটা দিন। বাঙালির সেরা উৎসব দুর্গাপুজো মিটলেই হইহই করে শুরু হয়ে যাবে বাঙালির দ্বিতীয় সেরা উৎসব হিরো ইন্ডিয়ান সুপার লিগ। কলকাতার দুই দলের একের পর এক ম্যাচ হবে প্রতি সপ্তাহেই। এ বারে আবার স্টেডিয়ামে গিয়ে প্রিয় দলের খেলা দেখার সুযোগ পাচ্ছেন সমর্থকেরা। অনেকে ঠিক করে রেখেছেন প্রিয় দলের অ্যাওয়ে ম্যাচও মাঠে গিয়ে দেখবেন। এ রকম ফুটবল পাগল সমর্থক যেমন রয়েছেন এ বঙ্গে, তেমনই এমনও বহু মানুষ রয়েছেন, যাঁরা বেছে বেছে সেরা ম্যাচগুলি দেখতে চান। আমরা তাঁদেরও স্বাগত জানাই হিরো আইএসএলে।

সত্যিই যদি আপনার পক্ষে সব ম্যাচ দেখা সম্ভব না হয়, তা হলে তো আপনাকে জানতে হবে, কোন ম্যাচগুলিতে লড়াই ও উত্তেজনার পারদ উঠতে পারে চরমে। কোন ম্যাচে হতে পারে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই, তাও জানতে হবে। সেই ম্যাচগুলিই বাছাই করার চেষ্টা হয়েছে এই বিশেষ প্রতিবেদনে। এই বছরে, অর্থাৎ ২০২২-এর যে তিন মাস আর আছে, সেই তিন মাসে এই ম্যাচগুলি না দেখলেই নয়। অবশ্যই দেখুন। অবশ্য, এত ঝাড়াই বাছাই করে ম্যাচ দেখার চেয়ে সব ম্যাচ দেখে নেওয়া অনেক সোজা।  

১৬ অক্টোবর, রবিবার: কেরালা ব্লাস্টার্স বনাম এটিকে মোহনবাগান, কোচি

হিরো আইএসএলে যোগ দেওয়ার পর এই প্রথম কোচির জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে গ্যালারি ভর্তি দর্শকের সামনে মুখোমুখি হবে এটিকে মোহনবাগান ও গতবারের রানার্স-আপ কেরালা ব্লাস্টার্স। এই ম্যাচের আবহ কেমন হবে, তা এখন থেকে কল্পনা করলেই গায়ে কাঁটা দিতে পারে। ইভান ভুকোমানোভিচের প্রশিক্ষণে গড়া দুরন্ত দলটি যখন ঘরের মাঠে প্রায় ৬০ হাজার সমর্থকের সামনে মাঠে নামবে, তখন তারাও উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটবে নিশ্চয়ই। বাংলার দুই ক্লাবের সমর্থকদের উন্মাদনার কথা যেমন জানে সারা দুনিয়া, তেমনই কেরালার ফুটবলপ্রেমীদের পাগলামিরও বিশ্বজোড়া খ্যাতি রয়েছে। ফুটবল বলতে তাঁরা অজ্ঞান। প্রিয় দলের হয়ে গলা ফাটানোর জন্যও তাদের জগৎজোড়া যশ রয়েছে।

এ রকম পরিবেশে কেরালা ব্লাস্টার্সের ঘর থেকে জয় ছিনিয়ে আনা আর সিংহের গুহা থেকে মাংসের টুকড়ো ছিনিয়ে আনা প্রায় সমার্থক। তাই এটিকে মোহনবাগানের কাছে ম্যাচটা  হতে চলেছে এক কঠিন পরীক্ষা। হিরো আইএসএলে এখন পর্যন্ত এটিকে মোহনবাগানকে কখনও হারাতে পারেনি কেরালা ব্লাস্টার্স। একটি ম্যাচে ড্র হয়েছে এবং তিনটি ম্যাচে কলকাতার দল জিতেছে। তাই কোচির এই ম্যাচে প্রতিশোধের মনোভাব নিয়েই নিশ্চয়ই মাঠে নামবেন কেরালার দলের ফুটবলাররা ও তাদের সেই অভিযানে গ্যালারি থেকে ইন্ধন জোগাবেন সমর্থকেরা। সবুজ-মেরুন শিবিরের ফুটবলারদের জন্য বেশ কঠিন হতে চলেছে এই ম্যাচ।

২৯ অক্টোবর, শনিবার: এটিকে মোহনবাগান বনাম ইস্টবেঙ্গল এফসি, কলকাতা

বাঙালির কাছে যদি সব খেলার সেরা হয় ফুটবল, তা হলে বাংলার ফুটবলের সেরা খেলা অবশ্যই কলকাতা ডার্বি। যা সারা বাংলাকে কয়েকটা দিনের জন্য কার্যত দ্বিখণ্ডিত করে দেয়। এক দিকে থাকে সবুজ-মেরুন সমর্থকেরা, অন্য দিকে থাকে লাল-হলুদের ভক্তরা। গত একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে এই চিরপ্রতিদ্বন্দিতা। ফুটবল মাঠে এই দুই দলের মুখোমুখি মানেই ঘটি-বাঙালের লাঠালাঠি এবং গোটা বাংলার ফুটবল উৎসবে মেতে ওঠা। তাই কলকাতা ডার্বির দিনটা বাংলার ফুটবলপ্রেমীদের ক্যালেন্ডারে ‘রেড লেটার্ড ডে’ হয়ে থাকে বরাবরই। এ বারের হিরো আইএসএলে সেই দিন ২৯ অক্টোবর। শনিবাসরীয় সন্ধ্যায় যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন যে মুখরিত হয়ে উঠবে ৬৫ হাজার ফুটবল পাগলের গর্জনে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই। মরশুমের প্রথম টুর্নামেন্ট ডুরান্ড কাপের ডার্বিতে এর স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে। এর আগে হিরো আইএসএলে যে চারবার কলকাতার দুই প্রধান মুখোমুখি হয়েছে, তাতে প্রতিবারই এটিকে মোহনবাগান জিতেছে। এ বার স্টিফেন কনস্টান্টাইনের প্রশিক্ষণে সেই ছবিটা বদলের দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই নিশ্চয়ই নামবে লাল-হলুদ বাহিনী। এটিকে মোহনবাগানের হারানোর কিছু নেই। শুধু সামনের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পালা।

৬ নভেম্বর, রবিবার: মুম্বই সিটি এফসি বনাম এটিকে মোহনবাগান, মুম্বই

গত দু’বছরে যে ভাবে দুই দলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দিতার ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠেছে, তাতে এই ম্যাচের সঙ্গে এখন ডার্বিরও তুলনা করা যায়। আবেগের দিক থেকে না হোক লড়াইয়ের দিক থেকে তো বটেই। হিরো আইএসএলে এখন পর্যন্ত মুম্বইয়ের দলকে হারাতে পারেনি এটিকে মোহনবাগান। চারবার মুম্বই সিটি এফসি জিতেছে ও একবার ড্র হয়েছে। ২০২০-২১-এ মুম্বই সিটি এফসি-র কাছে হেরে প্রথমে লিগশিল্ড ও পরে চ্যাম্পিয়নশিপও খোয়াতে হয় এটিকে মোহনবাগানকে। সেই ক্ষত এখনও তাজা সমর্থকদের মনে। তাই যতদিন না মুম্বই সিটি এফসি-কে হারাতে পারছে তাঁদের ক্লাবের ফুটবলাররা, ততদিন শান্তি পাবেন না সমর্থকেরা। এই ম্যাচে মুম্বইকে তাদের ঘরের মাঠে হারিয়ে বদলা নেওয়ার সুযোগ পাবে গঙ্গাপাড়ের ক্লাব।

দুই দলই এ বারের দলবদলে যে পরিমান অর্থ ব্যয় করেছে, তার পরে বলা যায় সবচেয়ে দামী দুই দল এই ম্যাচে মুখোমুখি হতে চলেছে। শেষ পর্যন্ত কারা জয়ের হাসি হাসবে, না গত ম্যাচের মতো ড্র করে মাঠ ছাড়বে, সে তো সময়ই বলবে। তবে ম্যাচটা যে দুই শহরেরই ফুটবলপ্রেমীদের ক্যালেন্ডারে জায়গা পাবেই, এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

২৬ নভেম্বর, রবিবার: এটিকে মোহনবাগান বনাম হায়দরাবাদ এফসি, কলকাতা

কৌশলের লড়াইয়ের দিক থেকে এই ম্যাচ যে অন্যতম সেরা, তা একবাক্যে স্বীকার করে নেন ফুটবল বিশেষজ্ঞরা। গতবার সেমিফাইনালে দুই দলের লড়াইয়ে যা হয়েছিল, তা হিরো ইন্ডিয়ান সুপার লিগের ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিতে পারে অনায়াসে। চ্যাম্পিয়ন হায়দরাবাদ এফসি-র বিরুদ্ধে প্রথম সেমিফাইনালে কয়েক মুহূর্তের ভুলে যে ১-৩-এ হার স্বীকার করতে হয়েছিল এটিকে মোহনবাগানকে, সেই ভুলগুলি শুধরে ফিরতি সেমিফাইনালে তাদের অন্তত তিন গোলের ব্যবধানে জিততেই হত। এ রকম একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ নিয়ে দ্বিতীয় সেমিফাইনালে নেমে ১-০-য় জেতে তারা। স্কোর দেখে অনেকের মনে হতে পারে, সবুজ মেরুন শিবিরের ব্যর্থতাই তাদের টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে দিয়েছিল সে দিন। কিন্তু বাম্বোলিমে হিরো আইএসএল সেমিফাইনালের দ্বিতীয় লেগে অন্তত চার গোলে জিতে ফাইনালে উঠতে পারত এটিকে মোহনবাগান। তাদের সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ান হায়দরাবাদ এফসি-র ৩২ বছর বয়সি গোলকিপার লক্ষ্মীকান্ত কাট্টিমণি, যিনি একাই ছ-ছ’টি অবধারিত গোল সেভ করে বিপক্ষের ফাইনালে ওঠার রাস্তা বন্ধ করে দেন। সে দিন যে সমস্ত গোলের সুযোগ হাতছাড়া করেছিলেন লিস্টন কোলাসো, রয় কৃষ্ণা, হুগো বুমৌস, জনি কাউকোরা, তা তাঁদের কাছ থেকে মোটেই প্রত্যাশিত ছিল না। তাঁরা ১৩টি কর্নার পেলেও সেগুলি বিফলে যায়।

সেই দ্বৈরথের কথা মাথায় রেখে নিশ্চয়ই এ বার মাঠে নামবেন না কলকাতার দলের ফুটবলাররা। কিন্তু সে দিনের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এ বারের ম্যাচে নিশ্চয়ই জেতার মতো খেলা খেলবে হুয়ান ফেরান্দোর দল। আসলে দুই স্প্যানিশ কোচের মস্তিষ্কপ্রসূত কৌশলের লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত কার জয় হবে, তা আগে থেকে বলা বেশ কঠিন। কারণ, এই ম্যাচে যত না দক্ষতার লড়াই হয়, তার চেয়ে বেশি হয় কৌশলের লড়াই।        

৩ ডিসেম্বর, শনিবার: বেঙ্গালুরু এফসি বনাম এটিকে মোহনবাগান, বেঙ্গালুরু

এই ম্যাচেও মাঠের বাইরেও আর একটা ম্যাচ চলবে সমর্থকদের মধ্যে। কারণ, বেঙ্গালুরুতে বঙ্গসন্তানদের ছড়াছড়ি। আর বাঙালি মানেই হয় সবুজ-মেরুন সমর্থক, নয় লাল-হলুদ। তাই কান্তিরাভা স্টেডিয়ামে ডিসেম্বরের প্রথম শনিবার এটিকে মোহনবাগান সমর্থখদের ঢল যে নামবেই, তা আন্দাজ করা যেতেই পারে। আর স্থানীয় দলের সমর্থকেরা তো থাকবেই। তাই দু’পক্ষের সমর্থকদের দ্বৈরথও হবে দেখার মতো।

ম্যাচের কথায় যদি আসি, তা হলে দেখা যাবে এ বার বেঙ্গালুরু এফসি এটিকে মোহনবাগান থেকে একাধিক ফুটবলার নিয়ে এসেছে তাদের শিবিরে। যেমন এসেছেন ফিজিয়ান তারকা স্ট্রাইকার রয় কৃষ্ণা, তেমনই এসেছেন তাঁর প্রিয় বন্ধু প্রবীর দাস এবং ডিফেন্ডার সন্দেশ ঝিঙ্গনও। কলকাতায় একাধিক মরশুম কাটিয়ে তাঁরা এ বার বেঙ্গালুরুতে এসেছেন দল বেঁধে। পুরনো দলের কাছে নিজেদের প্রমাণ করার একটা তাগিদ তো থাকবেই এই তিন ফুটবলারের মধ্যে। তা ছাড়া হুয়ান ফেরান্দোর সঙ্গে বহুদিন থাকায় তাঁর ভাবনা, শক্তি, দুর্বলতা সম্পর্কেও জানেন এই ত্রয়ী। যেটা এই ম্যাচে কাজে লাগবে বেঙ্গালুরুর কোচের। কলকাতার মাঠে মরশুমের শুরুতেই ডুরান্ড কাপ জয়ের পরে এঁদের আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে গিয়েছে। ফলে এই ত্রিফলাকেই এখন সামলাতে হবে ফেরান্দোর দলের ছেলেদের।

এ পর্যন্ত হিরো আইএসএলে চারটি ম্যাচের মধ্যে তিনটিতেই জিতেছে এটিকে মোহনবাগান। একটি ড্র হয়েছে। বেঙ্গালুরুর সামনে তাই গঙ্গাপাড়ের ক্লাবের বিরুদ্ধে প্রথম জয় পাওয়ার তাগিদ থাকছে এই ম্যাচে।

১৬ ডিসেম্বর, শুক্রবার: ইস্টবেঙ্গল এফসি বনাম মুম্বই সিটি এফসি, কলকাতা

এটিকে মোহনবাগানের সঙ্গে মুম্বই সিটি এফসি-র সম্পর্ক যে রকম অম্লমধুর, ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে ততটা নয়। হিরো আইএসএলে শুরুর দিকে যে ভাবে লাল-হলুদ বাহিনীর ওপর আধিপত্য বিস্তার করেছিল, ক্রমশ সেই আধিপত্য তারা হারাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। গত দু’বারের মুখোমুখিতে ইস্টবেঙ্গলকে হারাতে পারেনি ২০২০-২১-এর চ্যাম্পিয়নরা। এই দুই ম্যাচই অবশ্য হিরো আইএসএলের নয়। প্রথম ম্যচটি গতবারের লিগে দ্বিতীয় লেগের লড়াই, যেখানে গোলশূন্য ড্র হয় এবং পরেরটা এ বছর ডুরান্ড কাপে, যেখানে ৪-৩-এ জেতে ইস্টবেঙ্গল এফসি। ডুরান্ড কাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠতে না পারলেও ইস্টবেঙ্গল এফসি তাদের শেষ গ্রুপ ম্যাচে রানার্স আপ মুম্বই সিটি এফসি-কে হারিয়ে বুঝিয়ে দেয়, আর একটু প্রস্তুতির সময় পেলে নক আউট পর্বে উঠতে পারত তারা। ইস্টবেঙ্গল এফসি-র ক্লেটন সিলভা ও সুমিত পাসি দুটি করে গোল দেন। অন্য দিকে, মুম্বই সিটি এফসি-র ফরোয়ার্ড লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতের পা থেকেও জোড়া গোল আসে। তাদের অপর গোলদাতা ছিলেন গ্রেগ স্টুয়ার্ট। প্রথমার্ধে ১৭ মিনিট পর্যন্ত গোলশূন্য থাকার পরে মাত্র ২৬ মিনিটের ব্যবধানে হাফ ডজন গোল দেয় দুই দল। দ্বিতীয়ার্ধে দুই পক্ষই রক্ষণে প্রায় দেওয়াল তুলে দিলেও জয়সূচক গোলটি পেয়ে যায় লাল-হলুদ বাহিনী।

ডিসেম্বরের ঠান্ডার মধ্যে হিরো আইএসএলেও এরকমই এর একটি গরমাগরম ম্যাচ দেখার আশায় থাকতে পারেন। সব ঠিকঠাক চললে ইস্টবেঙ্গল যে এ বার গত দু’বারের মতো ধারাবাহিক ব্যর্থতার মধ্যে ডুবে থাকবে না, সেই ইঙ্গিত ডুরান্ড কাপে পাওয়া গিয়েছে। এ ছাড়াও তারা এ বার যে ফুটবলারদের দলে নিয়েছে, তাতে আশা করা যায়, এ বার দল হিসেবে ভাল খেলবে ইস্টবেঙ্গল এফসি। তা ছাড়া ঘরের মাঠে কলকাতার যে কোনও ক্লাবকেই হারানো কঠিন তাদের সমর্থকদের জন্য। হাজার হাজার মানুষের গর্জন সামলে গ্রেগ স্টুয়ার্টদের পক্ষে লাল-হলুদ ব্রিগেডকে হারানো যে মোটেই সোজা হবে না, তা তাঁরা মরশুমের শুরুতেই বুঝে নিয়েছেন।