ছ’দিন আগে তারা ছিল উত্তর মেরুতে, ছ’দিন পরে, তাদের পাওয়া গেল দক্ষিণে। শনিবার সন্ধ্যায় কলকাতার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে যে অবস্থায় পাওয়া গেল এটিকে মোহনবাগানকে, তা এ ভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় অনায়াসে। এ দিন সম্ভবত চলতি হিরো আইএসএলে সেরা পারফরম্যান্স দেখিয়ে গতবারের চ্যাম্পিয়ন তথা চলতি লিগে দুই নম্বরে থাকা হায়দরাবাদ এফসি-কে ১-০-য় হারিয়ে দিল তারা। ১১ মিনিটের মাথায় হুগো বুমৌসের গোলে এগিয়ে যাওয়ার পরে প্রতিপক্ষকে কোনও গোলই করতে দেয়নি গতবারের সেমিফাইনালিস্টরা। সারা ম্যাচে একটির বেশি শট গোলে রাখতে পারেনি নিজামের শহরের দল। এটিকে মোহনবাগান অবশ্য ব্যবধান বাড়ানোর একাধিক সুযোগ পায়।  

যাদের কাছে হেরে গত মরশুমে সেমিফাইনাল থেকে ছিটকে গিয়েছিল, সেই হায়দরাবাদকে এ দিন ঘরের মাঠে রীতিমতো নাস্তানাবুদ করে হারাল এটিকে মোহনবাগান। সে দিক থেকে দেখতে গেলে এর মতো মধুর প্রতিশোধ বোধহয় আর হয় না। এ দিন টানা ৯০ মিনিট উজ্জীবিত, দাপুটে ও গতিময় ফুটবল খেলে এটিকে মোহনবাগানের পুরো দলটি। ফুটবল যে দলগত খেলা এবং পুরো দল ভাল খেললে যে সাফল্য আসতে বাধ্য, তা এ দিন প্রমাণ করে দিল সবুজ-মেরুন ব্রিগেড।     

জনি কাউকো যে হাঁটুর চোটের জন্য কার্যত লিগের বাইরেই চলে গিয়েছেন, তা আগেই জানা ছিল। চোট-আঘাতের তালিকায় অস্ট্রেলীয় ফরোয়ার্ড দিমিত্রিয়স পেট্রাটসও যে যোগ দিয়েছেন, তা বোঝা গেল এই ম্যাচের স্কোয়াড দেখে। প্রথম দলে তো ছিলেনই না দিমি, এমনকী পরিবর্তদের তালিকাতেও তাঁর নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি। তিন জনের বেশি বিদেশি দলে রাখতে পারেননি কোচ হুয়ান ফেরান্দো। কাউকোর জায়গায় কার্ল ম্যাকহিউ ও পেট্রাটসের জায়গায় আশিক কুরুনিয়ানকে প্রথম এগারোয় দেখা যায় এ দিন। 

এই দু’টি পরিবর্তনই দলের চেহারা পুরো পাল্টে দেয়। প্রথম এগারোয় নিয়মিত সুযোগ না পেয়ে ক্ষুধার্ত দুই ফুটবলার একশো শতাংশ উজাড় করে দিয়ে নিজেদের প্রমাণ করে দেন। ঘরের মাঠে সমর্থকদের সামনে শুরু থেকেই এ দিন উজ্জীবিত পারফরম্যান্স দেখায় এটিকে মোহনবাগান। বাঁ দিক দিয়ে আশিক ও কোলাসো এবং ডানদিক থেকে মনবীর ও বুমৌস আক্রমণে ঝড় তোলা শুরু করেন। অন্য দিকে, শুরুর দিকে হায়দরাবাদ এফসি-র ডিফেন্ডাররা অনেকটা উঠে খেলায় প্রতি আক্রমণের জন্য কোলাসোদের সামনে বিস্তৃত জায়গাও খুলে যায়। 

এই জায়গা কাজে লাগানোর জন্যই ঘন ঘন দুই উইং দিয়ে গতিময় আক্রমণে উঠতে থাকেন সবুজ-মেরুন অ্যাটাকাররা এবং ১১ মিনিটের মাথাতেই জয়সূচক গোলটি পেয়ে যান বুমৌস। মাঝমাঠ থেকে কোলাসো বল বাড়ান ফরাসি মিডফিল্ডারকে। মাঝ বরাবর বল নিয়ে বক্সে ঢুকে পড়েন তিনি এবং তাঁকে ঘিরে ধরেন প্রতিপক্ষের চার ডিফেন্ডার। দুই ডিফেন্ডারের মাঝখানে ফাঁকা জায়গা দিয়ে বাঁ উইং থেকে বক্সে ঢোকা আশিককে কাট ব্যাক করে বুমৌস গোললাইনের সামনে চলে যান। আশিক নিখুঁত ও মাপা পাসে ফের বল পাঠান বুমৌসের কাছেই এবং তিনি জালে বল জড়াতে বিন্দুমাত্র ভুল করেননি (১-০)। হায়দরাবাদের ডিফেন্ডাররা কার্যত নীরব দর্শকে পরিণত হন। 

ম্যাচের শুরুতেই গোল পেয়ে যাওয়ায় আরও উজ্জীবিত হয়ে ওঠে হোম টিম এবং ব্যবধান বাড়ানোর জন্য ঘন ঘন আক্রমণে উঠতে শুরু করে। আশিক, কোলাসো, মনবীর, বুমৌস প্রায়ই জায়গা বদল করে আক্রমণে ওঠেন এবং তাঁদের সঙ্গে আক্রমণে মাঝে মাঝে যোগ দেন শুভাশিস বোস। বেশিরভাগ আক্রমণই ছিল বিপজ্জনক। কিন্তু সঠিক ফিনিশিংয়ের অভাবে ব্যবধান বাড়াতে পারেনি তারা। ম্যাচের ৩০ মিনিটের মধ্যে এটিকে মোহনবাগান যেখানে তিনটি শট গোলে রাখে, সেখানে হায়দরাবাদের কোনও গোলমুখী শট দেখা যায়নি।

কাউন্টার অ্যাটাকের মতো ট্রানজিশনেও এ দিন দুর্দান্ত ছিল গতবারের সেমিফাইনালিস্টরা। প্রতি আক্রমণের পরেই যতবার হায়দরাবাদ আক্রমণে উঠেছে, ততবারই তাদের আটকানোর জন্য দ্রুত নেমে আসে এটিকে মোহনবাগানের প্রায় গোটা দলটাই। গত মরশুমের সেমিফাইনালের দ্বিতীয় লেগে যে মরিয়া পারফরম্যান্স দেখিয়েছিল ফেরান্দোর দল, শনিবার যুবভারতীতে সেই ম্যাচের স্মৃতিই ফিরে আসে। সেই ম্যাচ যেখানে শুরু করেছিলেন কোলাসোরা, এ দিন যেন সেখান থেকেই ফের শুরু করেন তাঁরা।  

কিন্তু কথায় বলে, ভাল সময় দীর্ঘায়িত হয় না। এটিকে মোহনবাগানের ক্ষেত্রে সেটাই হয় বিরতির ঠিক আগে। হায়দরাবাদের মিডফিল্ডার হীতেশ শর্মার মরিয়া স্লাইডিং ট্যাকলে পায়ে চোট পেয়ে মাঠের বাইরে চলে যেতে বাধ্য হন মনবীর সিং। তাঁর জায়গায় নামেন কিয়ান নাসিরি। এই ফাউলের জন্য হীতেশকে হলুদ কার্ড দেখতে হয়। কিন্তু মনবীর তাঁর দলের আহত সদস্যদের তালিকায় ঢুকে পড়লেন কি না, সেটাই প্রশ্ন।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে হায়দরাবাদকে বল পজেশন বাড়িয়ে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের দিকে আনার চেষ্টা করতে দেখা গেলেও ৫১ মিনিটের মাথায় লিস্টন কোলাসো ব্যবধান বাড়ানোর সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যান। সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার চিঙলেনসানা সিং একটি বল ক্লিয়ার করতে গিয়ে দীপক টাঙরির গায়ে মারেন এবং সেখান থেকেই বল ছিটকে আসে কোলাসোর কাছে। ওয়ান টু ওয়ান পরিস্থিতিতে তিনি বক্সের মাথা থেকে গোলকিপারের বাঁ দিক দিয়ে গোলে শট নেন। কিন্তু অসাধারণ ভাবে বাঁ হাত বাড়িয়ে প্রায় অবধারিত গোলটি বাঁচিয়ে নেন গুরমিত সিং।  

এ দিন এটিকে মোহনবাগানের অ্যাটাকাররা যেমন উজ্জ্বল ছিলেন, তেমনই মাঝমাঠে কার্ল ম্যাকহিউ-ও নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেন। মাঝমাঠে প্রায় একার দায়িত্বেই প্রতিপক্ষকে বারবার প্রতিহত করার চেষ্টায় সফল হন তিনি। বেশিরভাগ ডুয়ালেই ম্যাকহিউ বল ছিনিয়ে নেন প্রতিপক্ষের পা থেকে। তিনি দলে আসায় এটিকে মোহনবাগানের মাঝমাঠকে এ দিন অনেক সঙ্ঘবদ্ধ দেখায়। সারা ম্যাচে মাঝমাঠ থেকে দুই উইংয়ে বল সাপ্লাই করতে পারেননি আকাশ মিশ্র, নিখিল পূজারি, জোয়াও ভিক্টর, হীতেশ শর্মারা।  

এটিকে মোহনবাগান ফের ব্যবধান বাড়ানোর সুবর্ণ সুযোগ পায় ৫৭ মিনিটের মাথায়। বাঁ দিক দিয়ে ওঠা আশিক গোলের সামনে নিখুঁত ক্রস দেন, যাতে পা ছোঁয়াতে পারলে হয়তো গোল পেতেন কিয়ান নাসিরি। কিন্তু এতটাই গতিতে ছিলেন তিনি যে বলে পা ছোঁয়াতেই পারেননি। 

সমতা আনার জন্য মরিয়া হায়দরাবাদ কোচ মানুয়েল মার্কেজ দ্বিতীয়ার্ধে তাঁর রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে তিন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হালিচরণ নার্জারি, সাহিল তাভোরা ও জোয়েল চিয়ানিজকে নামান। ৭৫ মিনিটে ফরোয়ার্ড হাভিয়ে সিভেরিওকেও নামানো হয়। তাঁরা প্রতিপক্ষের রক্ষণের ওপর চাপ বাড়ালেও সবুজ-মেরুন দূর্গের দেওয়াল ভেঙে ভিতরে ঢুকতে ব্যর্থ হন। ম্যাচের ৭০ মিনিট পর্যন্ত একটিও শট গোলে রাখতে পারেনি তারা। 

 গোলমেশিন বার্থোলোমিউ ওগবেচেকে এ দিন কার্যত বোতলবন্দী করে রেখেছিলেন প্রীতমরা। তাঁকে গোল এরিয়ায় ঢুকতেই দেওয়া হয়নি এ দিন। তবে ৭৪ মিনিটের মাথায় বক্সের বাইরে ফ্রি কিক থেকে গোলে যে তীব্র গতির শট নেন নাইজেরিয়ান ফরোয়ার্ড, তাতে চেনা ওগবেচেকে খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু গোলকিপার বিশাল কয়েথ অসাধারণ দক্ষতায় তা সেভ করেন। এটাই ছিল এই ম্যাচে হায়দরাবাদের প্রথম এবং একমাত্র গোলমুখী শট।

এটিকে মোহনবাগান অবশ্য সমানে ব্যবধান বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যায়। ৭৮ মিনিটের মাথায় কর্নারে মাথা ছুঁইয়ে যে গোলের চেষ্টা করেন শুভাশিস, তা গোললাইনের সামনেই ড্রপ করে যাওয়ায় বল বারের ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। এর আগে ৭৫ মিনিটের মাথায় কোলাসোকে তুলে লালরিনলিয়ানা হ্নামতেকে নামান কোচ ফেরান্দো। সাত মিনিটের স্টপেজ টাইমের প্রথম মিনিটে হুগো বুমৌসের জায়গায় ফারদিন আলি মোল্লাকেও নামান তিনি। তবে তা নিছকই কিছুক্ষণ তাঁকে মাঠে সময় কাটানোর সুযোগ দেওয়ার জন্য। ততক্ষণে ম্যাচ জেতা হয়ে গিয়েছে এটিকে মোহনবাগানের। 

এটিকে মোহনবাগান দল: বিশাল কয়েথ (গোল), আশিস রাই (কিয়ান নাসিরি), প্রীতম কোটাল (অধি), ব্রেন্ডান হ্যামিল, শুভাশিস বোস, দীপক টাঙরি, কার্ল ম্যাকহিউ, হুগো বুমৌস (ফারদিন আলি মোল্লা), আশিক কুরুনিয়ান, মনবীর সিং (কিয়ান নাসিরি), লিস্টন কোলাসো (লালরিনলিয়ানা হ্নামতে)।  

পরিসংখ্যানে ম্যাচ

বল পজেশন: এটিকে মোহনবাগান ৪৫% - হায়দরাবাদ এফসি ৫৫% , সফল পাস: ২১৩/৩১৬ (৬৭%) - ৩৩১/৪৩৯ (৭৫%), গোলে শট: ৪-১, ফাউল: ১৭-১৩, সেভ: ১-৩, ইন্টারসেপশন: ১৩-৭, কর্নার: ৯-৬, হলুদ কার্ড: ৩-৩, ম্যাচের হিরো: শুভাশিস বোস