গত হিরো আইএসএলে সেমিফাইনালের প্রথম লেগে হারের পর দ্বিতীয় লেগে চ্যাম্পিয়ন হায়দরাবাদ এফসি-কে প্রায় কোণঠাসা করে হারালেও মোট গোলের বিচারে ফাইনালে উঠতে পারেনি। প্রচুর গোলের সুযোগ হাতছাড়া হওয়া ও হায়দরাবাদের গোলরক্ষক লক্ষ্মীকান্ত কাট্টিমণির অসাধারণ দক্ষতা সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাদের। 

তবে হিরো আইএসএএলেই শেষ হয়ে যায়নি এটিকে মোহনবাগানের অভিযান। তার পরেও তারা এশীয় মঞ্চে নিজেদের মেলে ধরেছে এবং সেখানেও রীতিমতো দাপট বজায় ছিল তাদের। এপ্রিলে তারা শ্রীলঙ্কার ব্লু স্টার ও ঢাকার আবাহনী লিমিটেডকে হারিয়ে গ্রুপ পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে।

মে মাসে গ্রুপ পর্বে তারা গোকুলম কেরালা এফসি-র কাছে ২-৪-এ হারলেও বাংলাদেশের বসুন্ধরা কিংসকে ৪-০ ও মলদ্বীপের মাজিয়া এসআর-কে ৫-২-এ হারিয়ে ইন্টার জোনাল সেমিফাইনালে ওঠে। তবে ঘরের মাঠ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে সেই মোকাবিলায় তারা ১-৩-এ হেরে যায় কুয়ালা লামপুর সিটির বিরুদ্ধে। এ মরশুমের শুরুতে ডুরান্ড কাপেও গ্রুপ পর্বের বেড়া ডিঙোতে পারেনি সবুজ-মেরুন বাহিনী। গ্রুপের দুই সেরা দলের সমান পয়েন্ট থাকলেও মুখোমুখি লড়াইয়ের ফলের ভিত্তিতে নক আউটের দৌড় থেকে ছিটকে যায় তারা। এ বার তাদের চ্যালেঞ্জটা আরও কঠিন। কারণ, আরও সামনে লম্বা ঘরোয়া ক্লাব মরশুম।  

তাই এ বার দলের খোলনলচে পাল্টে ফেলেছেন সবুজ-মেরুন বাহিনীর স্প্যানিশ কোচ হুয়ান ফেরান্দো। দলকে আরও শক্তিশালী করার চেষ্টায়, একটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী দলে নতুন খেলোয়াড় নিয়ে এসেছেন তিনি ও ক্লাবের কর্তারা। কিন্তু সেই পরিকল্পনা কতটা কার্যকরী হয়ে উঠবে, সেটাই বোঝা যাবে সারা মরশুমে।  

-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

গত দুই মরশুমে

২০২০-২১: লিগ টেবলে ২ নম্বরে, রানার্স-আপ; ২০২১-২২: লিগ টেবলে ৩ নম্বরে, সেমিফাইনালিস্ট

-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

দল কেমন হল?

সমর্থকদের দুই নয়ণের মণি রয় কৃষ্ণা ও ডেভিড উইলিয়ামসকে বিদায় দিয়েছে এটিকে মোহনবাগান। ডিফেন্ডার সন্দেশ ঝিঙ্গনকেও অব্যহতি দিয়েছে তারা। আরেক নির্ভরযোগ্য ডিফেন্ডার স্প্যানিশ তারকা তিরি চোটের জন্য এই মরশুমের বেশির ভাগ সময়টাই মাঠে নামতে পারবেন না। এই ঘাটতি পূরণের জন্য দুই বিদেশি ডিফেন্ডার গিনির ফ্লোরেন্তিন পোগবা ও অস্ট্রেলিয়ার ব্রেন্ডান হ্যামিলকে সই করানো হয়েছে। গত হিরো আইএসএল মরশুমে এটিকে মোহনবাগান লিগ পর্বে ২৬টি গোল খেয়েছিল, যা চার সেমিফাইনালিস্টের মধ্যে ছিল সবচেয়ে বেশি। তাই এ বার দলবদলের শুরুতেই রক্ষণ মজবুত করার দিকে জোর দেন কোচ ফেরান্দো। যোগ দিয়েছেন গত হিরো আইএসএল চ্যাম্পিয়ন হায়দরাবাদ এফসি থেকে আসা ডিফেন্ডার আশিস রাই। কিন্তু সম্প্রতি ডুরান্ড কাপে এই ডিফেন্স লাইন-আপকে তেমন শক্তিশালী মনে হয়নি। গ্রুপ পর্বে ছ’গোল দিয়ে চার গোল খেয়েছে তারা।

গত মরশুম পর্যন্ত যে কাজটা করেছেন রয় কৃষ্ণা, সেই কাজটা এ বার করবে কে, সেটাই এখন কোটি টাকার প্রশ্ন। নাকি কোচের মস্তিষ্কে অন্য কোনও ছক ঘোরাফেরা করছে? শুধুমাত্র কিয়ান নাসিরিকে সামনে রাখবেন তিনি? নাকি নবনিযুক্ত অস্ট্রেলিয়ান অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার পাঁচ ফুট ন’ইঞ্চির দিমিত্রিয়স পেট্রাটসকে ‘ফলস নাইন’-এর ভূমিকায় দেখা যাবে?  ফেরান্দোর এই অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্ত থেকেই অনেকে মনে করছেন, তিনি কোনও জেনুইন স্ট্রাইকারকে দিয়ে আক্রমণে না উঠে হয়তো দুই উইং দিয়ে আক্রমণ শানিয়ে বিপক্ষের রক্ষণে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করবেন। সে জন্য লিস্টন কোলাসো ও মনবীর সিং আছেন। এক্ষেত্রে আশিস রাইয়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

পেট্রাটস কিন্তু মূলত অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার। গোলের সুযোগ তৈরি করেন তিনি। তাঁর পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যায়, তিনি যত না গোল করেছেন, গোলের সুযোগ তৈরি করেছেন অনেক বেশি। ‘নাম্বার নাইন’ হিসেবে না ভেবে পেট্রাটসকে ‘নাম্বার টেন’ হিসেবে ধরাই ভাল। অন্তত তাঁর অতীতের রেকর্ড সে রকমই বলছে। ‘ফলস নাইন’-এর ভূমিকায় খেলার অভ্যাস রয়েছে তাঁর। দূরপাল্লার গোলেও তিনি বিশেষজ্ঞ।  তবে ফেরান্দো তাঁকে কোন ভূমিকায় ব্যবহার করবেন, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। ডুরান্ড কাপে তিনি ছিলেন না। তাই তাঁর খেলা এখনও দেখা যায়নি। সমর্থকেরা তাই অপেক্ষায় রয়েছেন এই অস্ট্রেলিয়ানের কেরামতি দেখার জন্য।

স্বাগত: বিশাল কয়েথ, ফ্লোরেন্তিন পোগবা, ব্রেন্ডান হ্যামিল, আশিস রাই, আশিক কুরুনিয়ান, দিমিত্রিয়স পেট্রাটস, লালরিনলিয়ানা হ্নামতে, দেবনাথ মন্ডল,

বিদায়: রয় কৃষ্ণা, ডেভিড উইলিয়ামস, মাইকেল সুসাইরাজ, শেখ সাহিল, প্রবীর দাস, সন্দেশ ঝিঙ্গন।

পুরো স্কোয়াড দেখতে এখানে here ক্লিক করুন

বিশেষজ্ঞ কী বলছেন?

পল মেসফিল্ড, ইংল্যান্ডের প্রাক্তন ক্লাব ফুটবলার ও হিরো আইএসএলের টিভি ধারাভাষ্যকার: লিগ জেতার জন্যই এই দলটা তৈরি করেছেন হুয়ান ফেরান্দো। আশিস রাই ও আশিক কুরুনিয়ান এই দলে যোগ দেওয়ায় সেই সম্ভাবনা আরও বেশি করে দেখতে পাচ্ছি। এই দু’জন দলের পারফরম্যান্সে আরও গতি এনে দেবে, যা তাদের এমনিতেই আছে। এ ছাড়া হ্যামিল ও পোগবাকে এনে দলের রক্ষণকে আরও শক্তপোক্ত করতে চাইছেন ফেরান্দো। সবরকম দলই তাঁর হাতে চলে এসেছে। সাফল্য পেতে তাঁর এ বার দরকার সঠিক রেসিপি।

এই দলের চার তারকাকে অবশ্যই নজরে রাখতে হবে। লিস্টন কোলাসো, জনি কাউকো, আশিক ও হুগো বুমৌস। গত মরশুমে কোলাসো তার গতি, দক্ষতা ও ফিনিশিং-এর ক্ষমতা দিয়ে নিজেকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছিল। জনি কাউকো প্রতি দিনই নিজেকে উন্নত করে তুলছে। নীচ থেকে উঠে গিয়ে ওর গোলের সুযোগ তৈরি করার দক্ষতা অসাধারণ। আশিক একাধিক পজিশনে সমান ভাল খেলতে পারে। এটাই ওর সবচেয়ে বড় গুণ। দরকার শুধু আরও একটু ধারাবাহিকতা। হুগোর গত মরশুমটা তেমন ভাল যায়নি। তবে এ বার নিশ্চয়ই ও ফর্মে ফিরবে। দুই মরশুম আগে কেন ও হিরো অফ দ্য লিগ খেতাব পেয়েছিল, সেটা নিশ্চয়ই প্রমাণ করার চেষ্টা করবে।

ভবিষ্যদ্বাণী: লিগশিল্ড বা চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার মতো দল হুয়ান ফেরান্দোর হাতে রয়েছে। এ বার তাঁকে ম্যাচ ও প্রতিপক্ষ অনুযায়ী সঠিক এগারো বাছতে হবে। অনেক কিছুই তাঁর ওপর নির্ভর করছে।   

ক্রীড়াসূচি কেমন হল?

কলকাতা ডার্বির প্রথম লেগ হবে ২৯ অক্টোবর ও দ্বিতীয় লেগ হবে ২৫ ফেব্রুয়ারি। লিগ পর্বে কলকাতার দুই প্রধানের শেষ ম্যাচ এটিই। হয়তো দেখা যাবে এই ম্যাচের ওপর একাধিক ফয়সালা নির্ভর করবে। এটিকে মোহনবাগান লিগ শুরু করছে ঘরের মাঠে, ১০ অক্টোবর, গতবার আট নম্বরে থাকা চেন্নাইন এফসি-র বিরুদ্ধে। অক্টোবরে ডার্বি-সহ তাদের ২৫ দিনে মোট তিনটি ম্যাচ খেলতে হবে। নভেম্বরে ৩০ দিনে তারা খেলবে চারটি ম্যাচ। প্রতি ম্যাচের পরে তিন থেকে ন’দিনের বিশ্রাম পাবে তারা। ডিসেম্বরে মোট চারটি ম্যাচ খেলবে সবুজ-মেরুন বাহিনী। সে মাসেও তিন থেকে ন’দিনের বিশ্রাম পাবেন ফেরান্দোর দলের ফুটবলাররা। জানুয়ারিতে তাদের তিনটি ও ফেব্রুয়ারিতে পাঁচটি ম্যাচ তাদের। সুতরাং, বেশির ভাগ ম্যাচের আগেই প্রস্তুতি ও ফুটবলারদের ফিটনেস ফিরিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট সময় পাবে দুই দলই। ফলে খেলার মানও অনেক ভাল হবে বলে আশা করা যেতেই পারে।

বিস্তারিত সূচি: অক্টোবর ১০- চেন্নাইন এফসি, ১৬- কেরালা ব্লাস্টার্স, ২৯- ইস্টবেঙ্গল এফসি, নভেম্বর ৬- মুম্বই সিটি এফসি, ১০- নর্থইস্ট ইউনাইটেড, ২০- এফসি গোয়া, ২৬- হায়দরাবাদ এফসি, ডিসেম্বর ৩- বেঙ্গালুরু এফসি, ৮- জামশেদপুর এফসি, ১৫- ওডিশা এফসি, ২৪- নর্থইস্ট, ২৮- গোয়া, জানুয়ারি ১৪- মুম্বই, ২১- চেন্নাইন, ২৮- ওডিশা, ফেব্রুয়ারি ৫- বেঙ্গালুরু, ৯- জামশেদপুর, ১৪- হায়দরাবাদ, ১৮- কেরালা, ২৫- ইস্টবেঙ্গল এফসি।

লিগের পুরো ক্রীড়াসূচি দেখতে এখানে here ক্লিক করুন