এক ঝাঁক নতুন ফুটবলারে গড়া ভারতীয় দল বৃহস্পতিবার দুবাইয়ে ফ্রেন্ডলি ম্যাচে যে ভাবে ওমানের বিরুদ্ধে পিছিয়ে থেকেও ১-১ ড্র করল, তা প্রশংসা পেয়েছে ভারতীয় ফুটবল মহলে। ভারতের প্রথম এগারোয় ছজন ও চারজন পরিবর্ত ফুটবলারের আন্তর্জাতিক অভিষেক হয় এই ম্যাচে। তা সত্ত্বেও তারা ২৩ ধাপ ওপরে থাকা ওমানকে আটকে দিয়ে নিজেদের দক্ষতার প্রমাণ দিল বলেই ধারণা বিশেষজ্ঞদের।

সদ্যসমাপ্ত হিরো আইএসএলে যে ভারতীয় ফুটবলাররা যথেষ্ট প্রশংসা কুড়িয়েছে, তাঁদেরই মাঠে নামান দলের ক্রোয়েশিয়ান কোচ ইগর স্টিমাচ। আন্তর্জাতিক ফুটবলের অভিজ্ঞতা ছাড়াই মাত্র ৮-৯ দিনের অনুশীলনে দলটা দ্বিতীয়ার্ধে যে রকম সঙ্ঘবদ্ধ ফুটবল খেলে, তা কিছুটা অপ্রত্যাশিতই ছিল বলা যায়।

দুশ্চিন্তার প্রথমার্ধ  

এমন ফলে যখন ভারতীয় ফুটবলপ্রেমী ও বিশেষজ্ঞরা খুশি, তখন কোচও যে খুশিই হবেন, এটাই স্বাভাবিক। খুশি হলেও স্টিমাচ উচ্ছ্বসিত নন। তাঁর মতে, প্রথম ৪৫ মিনিটে ছেলেদের খেলা দেখে আমি খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। কেউ পায়ে বল রাখতে পারছিল না। অনুশীলনে আমরা যে ভাবে পাসিং প্র্যাকটিস করি, দলের সবচেয়ে কমবয়সি সুরেশ (ওয়াঙজাম) ছাড়া কেউই সে ভাবে পাস দিতে পারছিল না

শুরুর দিকে দলের সমস্যা নিয়ে স্টিমাচ ব্যাখ্যা দেন, আমরা দুটো বেসিক জিনিস ঠিকমতো করতে পারিনি। ওরা যখন আমাদের অর্ধে পায়ে বল পাচ্ছিল, তখন আমরা ওদের চাপে ফেলতে পারিনি। ওরা যখন আক্রমণ তৈরি করছিল, তখন আমরা ওদের চেয়ে দূরে থাকছিলাম না। ওদের (ওমান) আত্মবিশ্বাস ক্রমশ বাড়ছিল। আমাদের কমছিল। বিরতিতে ওদের বলি, ফল নিয়ে আমি চিন্তা করব। তোমরা বিন্দুমাত্র ভয় না পেয়ে খেলে যাও। দ্বিতীয়ার্ধে ছেলেরা সেটাই দেখাল। ওমান অবশ্যই ভাল দল। প্রথম একশোয় থাকা দলগুলোর মধ্যে ২৫-৩০ ধাপের পার্থক্য মানে অনেক

লড়াইয়ে ফেরা

বৃহস্পতিবারের ম্যাচের প্রথমার্ধে ভারতীয় দলের খেলায় কিছুটা জড়তা লক্ষ্য করা যায় ঠিকই। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে একেবারে অন্য ছবি দেখা যায়। প্রথমার্ধে যেখানে ওমানের আক্রমণের চাপ সামলাতেই ব্যস্ত ছিলেন ভারতীয় ডিফেন্ডাররা, খুব কম সংখ্যক পাল্টা আক্রমণ তৈরি করতে সক্ষম হন, বল বেশি পায়ে রাখতে পারেননি তাঁরা। সেখানে দ্বিতীয়ার্ধে বিপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করে পাল্টা আক্রমণে উঠে গোলের সুযোগও যেমন তৈরি করেন ভারতীয় ফুটবলাররা, তেমনই গোল শোধও করে তারা।

সংগঠিত ও সুপরিকল্পিত আক্রমণে গোলের সুযোগ তৈরি করার পরেই গোল দেয় ভারত। ডান দিকের উইং বরাবর ওঠা আশুতোষ মেহতা বল বাড়ান বক্সের সামনে থাকা বিপিন সিংকে। হিরো আইএসএল ফাইনালে মুম্বই সিটি এফসি-র জয়সূচক গোলদাতা বিপিন বক্সের মধ্যে ভাসানো ক্রস দেন মনবীরকে উদ্দেশ্য করে। ক্ষিপ্র মনবীর বিপক্ষের দুই ডিফেন্ডারের মাঝখান দিয়ে হেড করে জালে বল জড়িয়ে দেন।

দ্বিতীয়ার্ধে দলের ফর্মে ফিরে আসা প্রসঙ্গে কোচ বলেন, দ্বিতীয়ার্ধে আমরা বোঝালাম যে, ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। প্রথমার্ধে ওরা যে ভাবে আমাদের চার ডিফেন্ডারকে চাপে ফেলে দিয়েছিল, সেই চাপ কাটিয়ে ওঠাটা মোটেই সোজা ছিল না। দ্বিতীয়ার্ধে এই কাজটা ওরা খুব ভাল করেছে। ওরা নিজেদের সেরাটা দিয়েছে। সবরকম ভাবে চেষ্টা করে এসেছে। ওঠানামাও খুব ভাল করেছে ওরা, যেটা আমি চেয়েছিলাম

ওমানের পথের কাঁটা

এটা অবশ্য স্বীকার করতেই হবে যে, ওমান একাধিক সুবর্ণ সুযোগ নষ্ট করেছে এই ম্যাচে। এমনকী, পেনাল্টি পেয়েও তা থেকে গোল করতে পারেননি তাঁরা। বক্সের মধ্যে ননম্বর জার্সির মালিক আল মকবলিকে অবৈধ ভাবে বাধা দেওয়ায় রাওলিন বোর্জেস বিপক্ষকে কার্যত এই পেনাল্টি উপহার দেন। কিন্তু মকবলির নেওয়া দুর্বল শট রুখে দিয়ে সে যাত্রা বিপদ কাটান অমরিন্দর সিং। মুম্বই সিটি এফসি-র গোলরক্ষক অমরিন্দর আরও কয়েকটি নিশ্চিত গোল বাঁচান এ দিন। সে দিক দিয়ে দেখতে গেলে ভারতকে এ দিন ভাগ্য অনেকটাই সাহায্য করেছে। প্রথমার্ধে ভারতীয় ফুটবলারদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে একাধিক গোল দিতে পারত তারা।

কিন্তু স্টিমাচ দ্বিতীয়ার্ধে মাঝমাঠে লালেঙমাউইয়া ওরফে আপুইয়াকে নামানোয় দলের খেলায় অনেকটাই উন্নতি দেখা যায়। এ বার হিরো আইএসএলের সেরা উঠতি খেলোয়াড়ের খেতাবজয়ী নর্থইস্ট ইউনাইটেডের লালেঙমাউইয়া মাঠে নেমে ওমানের আক্রমণের রাস্তাগুলোয় বারবার বাধা হয়ে উঠছিলেন। যার জেরে দলটা আগের চেয়ে বেশি প্রতি আক্রমণে উঠতে পারছিল। গোলটাও তেমনই এক প্রতি আক্রমণের ফসল।

চাই আরও পেশিশক্তি

তবে একটা ব্যাপারে চিন্তিত স্টিমাচ। শারীরিক দিক থেকে তাঁর দলের ফুটবলারদের পিছিয়ে থাকা। তাঁর দলে আরও পেশিশক্তি প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। বলেন, ওমানের খেলোয়াড়রা কত শক্তিশালী, কত ভাল ট্যাকল করে, দেখলেন তো। কত দ্রুত পাস করতে পারে ওরা। আমাদের দলেও কয়েকজন দ্রুতগতির খেলোয়াড় রয়েছে। কিন্তু ওরা ওমানের ডিফেন্ডারদের নাগাল থেকে বেরোতে পারছিল না। শরীরকে আরও পেশিময় করে তোলার জন্য আমাদের আরও পরিশ্রম করতে হবে

ওমানের বিরুদ্ধে কখনও জিততে পারেনি ভারত। গত দুবারের মুখোমুখিতে দুবারই জিতেছে ওমান। এ বারও ভারত পারল না ঠিকই। কিন্তু মনে ছাপ ফেলার মতো পারফরম্যান্স দেখিয়েছে তারা। বিশেষ করে দশজন নতুন খেলোয়াড় নিয়ে এই পারফরম্যান্স, অপ্রত্যাশিতই। সে দিক দিয়ে কোচ স্টিমাচ খুশিই। ৫৩ বছর বয়সি ক্রোয়েশিয়ার প্রাক্তন বিশ্বকাপার বলেন, সব মিলিয়ে আমি খুশি ওই দশজন ছেলেকে নিয়ে, যারা এর আগে ভারতের সিনিয়র দলের জার্সি পায়নি কখনও। কয়েকজন তো অনেক বেশিক্ষণ মাঠে থাকার সুযোগ পেয়েছে। প্রত্যেকেই তাদের দায়িত্ব পালন করেছে

এ বার সামনে আর এক শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দী সংযুক্ত আরব আমিরশাহী। ফিফা ক্রমতালিকায় যারা ওমানের চেয়েও সাত ধাপ ওপরে। জানুয়ারিতে তারা বিশ্বের ৬৯ ও এশিয়ার সাত নম্বর ইরাকের বিরুদ্ধে ফ্রেন্ডলি ম্যাচে গোলশূন্য ড্র করে। ঘরের মাঠে তারা যে ওমানের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠবে, এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। চলতি সফরের শেষ ম্যাচ নিয়ে ভারতীয় কোচ বলেন, আমিরশাহী ও ওমানের মধ্যে অনেক ফারাক। আমাদের চেয়ে তো আরওই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমরা ফলাফল তৈরি করতে পারব না। সেটাই এই ম্যাচে বুঝিয়েছি। পরের ম্যাচে অন্য খেলোয়াড়দেরও মাঠে নামার সুযোগ দিতে হবে।