শনিবার ফতোরদার জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে হিরো আইএসএল ফাইনালে শুধু যে দুই দল এটিকে মোহনবাগান ও মুম্বই সিটি এফসি ও তাদের ফুটবলারদের যুদ্ধ, তা নয়। আর একটা বড় লড়াই হবে মাঠের বাইরেও, দুই কোচের মধ্যে। আন্তোনিও লোপেজ হাবাস, না সের্খিও লোবেরা-- দুই ক্ষুরধার স্প্যানিশ ফুটবল মস্তিষ্কের দ্বৈরথে শেষ পর্যন্ত কে জিতবেন, এটাও শনিবার ফাইনালের আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকবে।

প্রথম হিরো আইএসএলে চ্যাম্পিয়ন এটিকে-র কোচ ছিলেন হাবাস। তার পরে গত মরশুমেও এটিকে এফসি-কে ট্রফি এনে দিয়ে এই লিগের সবচেয়ে সফল কোচের সম্মান অর্জন করেন ৬৩ বছর বয়সি স্প্যানিশ কোচ। এ বারেও যদি তিনি তাঁর দলকে খেতাব জেতাতে পারেন, তা হলে হাবাসই হবেন হিরো আইএসএলের প্রথম কোচ, যিনি পরপর দু’বছর সেরার খেতাব অর্জন করবেন।

হাবাস, কৌশল-সম্রাট

তুখোড় ফুটবল মস্তিষ্ক তাঁর। কোন ফুটবলারকে কোন পরিস্থিতিতে কী ভাবে ব্যবহার করলে সেই ফুটবলারের কাছ থেকে সেরাটা পাওয়া যাবে, তা হাবাসের চেয়ে ভাল কেউ বোঝেন না বোধহয়। গত মরশুমে সাইড ব্যাক হিসেবে খেলতে অভ্যস্ত প্রবীর দাসকে যে ভাবে রাইট উইং ব্যাক হিসেবে খেলিয়ে চমকে দিয়েছিলেন তিনি, তার কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। বাঁ দিকের উইং দিয়ে মাইকেল সুসাইরাজ ও ডান দিক দিয়ে প্রবীরকে দিয়ে আক্রমণ তৈরির কৌশলে একের এক ম্যাচে বাজিমাত করেন তিনি।

এ বারে সুসাইরাজ প্রথম ম্যাচেই ছিটকে যাওয়ায় তাঁর এই কৌশল আর কাজে লাগেনি। ফলে প্রবীরের ভূমিকাও অনেকটা গুরুত্বহীন হয়ে যায়। তবে তাঁর সেই কৌশল ফিরিয়ে এনেছেন মনবীর সিং ও শুভাশিস বসু। ডান দিক দিয়ে মনবীর ও বাঁ দিক দিয়ে শুভাশিস হানা দিচ্ছেন ঘনঘন, যাতে বিপক্ষের রক্ষণে ফাঁক তৈরি হয় ও সেই ফাঁক দিয়ে ঢুকে গোল করে বেরিয়ে আসতে পারেন রয় কৃষ্ণা, ডেভিড উইলিয়ামসরা।

হাবাস একটা কথাই বারবার বলে থাকেন। দলের রক্ষণ ও আক্রমণের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য বজায় থাকা দরকার। অর্থাৎ নিজের ঘর সুরক্ষিত রেখে শত্রুপক্ষের ঘরে আক্রমণ করো, যাতে কাউন্টার অ্যাটাকে উঠে শত্রুপক্ষ তোমার জালে বল জড়িয়ে চলে যেতে না পারে। দলকে মূলত কাউন্টার অ্যাটাক নির্ভর ফুটবল খেলাতে পছন্দ করেন হাবাস, এমনই অভিযোগ উঠেছে বারবার। হাবাস তা উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, “ফুটবল এমনই। প্রতিপক্ষ যদি কাউন্টার অ্যাটাকে ওঠার সুযোগ দেয় বা সে রকম পরিস্থিতি তৈরি করে দেয়, তা হলে কি আমরা কাউন্টার অ্যাটাকে যাব না? প্রতি আক্রমণে ওঠাটা আমাদের ওপর নির্ভর করে না, করে বিপক্ষের ওপর”।

শত্রুপক্ষকে ভাল করে মেপে নিয়ে তার পরে তাদের দূর্গে হানা দাও, এটাই হাবাসের ফুটবলের মূলমন্ত্র। যা তিনি বরাবরই মেনে এসেছেন। সে জন্য এ বার এটিকে মোহনবাগান বেশির ভাগ গোলই করেছে দ্বিতীয়ার্ধে। প্রথম ৪৫ মিনিটে বিপক্ষের ফাঁক-ফোকরগুলো বুঝে নিয়ে বিরতিতে নতুন করে স্ট্র্যাটেজি তৈরি করতে বসেন হাবাস। দ্বিতীয়ার্ধে বিপক্ষের সেই দুর্বলতাগুলোর ওপরই আঘাত করার রাস্তা বাতলে দেন দলের ফুটবলারদের। এটাই তাঁর কাজের পদ্ধতি।

সেভিয়া থেকে বলিভিয়া, দীর্ঘ যাত্রা

ফুটবলার জীবনে হাবাস ছিলেন ডিফেন্ডার। সেভিয়া, বুর্গোস সিএফ, রিয়েল মুর্সিয়ার মতো বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে খেলেছেন তিনি। কোচিং জীবনে প্রবেশ করার পরে নিজের দেশের বিভিন্ন ক্লাবের দয়িত্বে তো ছিলেনই, বলিভিয়ার জাতীয় কোচের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। বলিভিয়ার দলকে ১৯৯৭-এর কোপা আমেরিকার ফাইনালেও তোলেন। তবে সে বার রানার্স হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাঁর দলকে। তবে ভারতীয় ফুটবলই তাঁকে সবচেয়ে বেশি সাফল্য ও খ্যাতি এনে দিয়েছে।

গত মরশুমে হাবাসের এটিকে এফসি প্রমাণ করে দেয় তারা শুধু আগ্রাসী ফুটবলই খেলে না, আকর্ষণীয় ও দর্শনীয় ফুটবলও খেলে, যা দেখে ফুটবলপ্রেমীরা আনন্দ ও তৃপ্তি দুটোই পেতে পারেন। এ বারেও এটিকে মোহনবাগান সমর্থকদের সেই একই বার্তা দিয়েছেন তিনি ও তাঁর ফুটবলাররা।

স্প্যানিশ কোচের স্পষ্ট কথা, “আমার দলের ছেলেদের শুধু ভাল ফুটবলার হলে চলবে না, তাদের ভাল পেশাদারও হতে হবে। এই দুই মিলে একজন ভাল ফুটবলার হয়। তাই আমার ভাল, পেশাদার ফুটবলারদেরই পছন্দ”।

লোবেরা, ঠাণ্ডা মাথার ঘাতক

হাবাস যতটা ডাকাবুকো, আগ্রাসী প্রকৃতির, তাঁর স্বদেশীয় ও বয়সে প্রায় ১৯ বছরের ছোট সের্খিও লোবেরা ততটাই ধীর-স্থির ও শান্ত স্বভাবের। আগ্রাসী মনোভাব বা উদ্ধত আচরণ কোনওটাই তাঁর চরিত্রের মধ্যে পড়ে না। ঠাণ্ডা মাথায় বিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করার মন্ত্রটা তিনি তাঁর দলের ফুটবলারদের মাথাতেও ঢুকিয়ে দিতে পারেন সফল ভাবে। তাঁর প্রধান বক্তব্য হল, “ফুটবলটাকে আগে উপভোগ করো, তার পরে হার-জিতের কথা ভাবো। অযথা তাড়াহুড়ো করে বা মাথা গরম করে ম্যাচ জেতা যায় না। ঠাণ্ডা মাথায় ধীরে ধীরে বিপক্ষের ওপর আধিপত্য বিস্তার করো ও তাদের হারিয়ে মাঠ ছাড়ো”।

গত বছর বিশ্বখ্যাত সিটি ফুটবল গ্রুপ যখন মুম্বই সিটি এফসি অধিগ্রহন করল, তখনই তারা ঠিক করে নেয় লোবেরাকে দলের দায়িত্ব দেবে। গত বছর জর্জ কোস্টা সেই দায়িত্বে থাকলেও তিনি ভাল ফল দিতে না পারায় কোচ বদলের সিদ্ধান্ত নেয় তারা। গত মরশুমে তিন ম্যাচ বাকি থাকতেই লোবেরাকে অব্যহতি দেয় এফসি গোয়া, যারা লিগের এক নম্বর হয়ে এ মরশুমের এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে।

মুম্বই সিটি এফসি তাঁকে সবরকম সাহায্য তো করেই, দল চালানোর জন্য পূর্ণ স্বাধীনতাও দেয়। দল বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও তাঁকে পুরোপুরি দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হয়, যাতে এ বছর লিগশিল্ড ও চ্যাম্পিয়নশিপ দুটোই জিততে পারে তারা। ফলে চাপটা লোবেরার ওপরও ছিল যথেষ্ট। পুরো দায়িত্ব ও স্বাধীনতা পেয়েও যদি দলকে সঠিক পথ দেখাতে না পারতেন, তা হলে সেই দায়িত্বও তাঁকেই নিতে হত।

সাফল্যের রেসিপি

তবে সে রকম কিছুই হয়নি। বরং তাঁর প্রশিক্ষণে মুম্বইয়ের দলের আইএসএল অভিযান এ বার সবচেয়ে সফল ভাবে হয়েছে। প্রথম ম্যাচেই নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি-র বিরুদ্ধে হার দিয়ে শুরু করলেও তার পরে টানা ১২টি ম্যাচে অপরাজিত ছিল তারা। এর মধ্যে ন’টি ম্যাচেই জয়। মুম্বই দলে থাকা ও এফসি গোয়া থেকে নিয়ে আসা একাধিক দুর্দান্ত বিদেশি ফুটবলার তো তাঁর হাতে ছিলই। এ ছাড়া রাওলিন বোর্জেস, বিপিন সিং, ভিগ্নেশদের মতো ভারতীয় ফুটবলারদের যে ভাবে কাজে লাগিয়েছেন তিনি, তা প্রশংসার যোগ্য।

তবে লিগের শেষ দিকে বেশ কয়েকটি ম্যাচে সাফল্যের খরা মুম্বই সমর্থকদের বেশ চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। টানা ছ’টি ম্যাচের মধ্যে মাত্র একটিতে জেতে তারা। কিন্তু শেষ দুই ম্যাচে চেনা ফর্মে দলকে ফিরিয়ে সেই দুশ্চিন্তা দূর করেন লোবেরা। তাঁর দল ৬-১-এ হারায় ওডিশা এফসি-কে এবং লিগ শেষ করে এটিকে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে ২-০ জয় দিয়ে। যে ম্যাচে এক নম্বরে থেকে লিগশিল্ড জয়ের জন্য জেতা ছাড়া কোনও রাস্তা ছিল না তাদের সামনে, সেই ম্যাচ তারা জিতেই শেষ করে। এখানেই প্রমাণ হয় লোবেরার দল কতটা দৃঢ়চরিত্রের ও কতটা প্রত্যয়ী।

কোনও ভারতীয় ক্লাব যে এত ভাল ও নিখুঁত পাসিং ফুটবল খেলতে পারে, তা সের্খিও লোবেরা মুম্বই সিটি এফসি-র দায়িত্ব না নিলে বোধহয় জানাই হত না। গত মরশুমে এফসি গোয়াও যে রকম চিত্তাকর্ষক পাস-নির্ভর ফুটবল দেখিয়েছিল, এ বার মুম্বইও অনেক ম্যাচে তেমনই ফুটবল উপহার দেয়। ফুটবলপ্রেমীদের কাছে এমন ফুটবল শুধু আনন্দদায়কই নয়, চোখকে আরামও দেয়।

বার্সেলোনা এফসি থেকে মুম্বই

দোসা সেলেসিয়ান্স ও ইউএফবি জাবাক তেরাসা ক্লাবে নজর কাড়ার পরে লোবেরা ১৯৯৭-এ এফসি বার্সেলোনায় যোগ দেন কোচিং স্টাফ হিসেবে। বার্সেলোনা ইউথ অ্যাকাডেমির আলেভিন এ দলকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার দায়িত্ব পান তিনি। সেই দলকে তিনি ফুতবল ৭ প্রেফারেন্তে লিগের টানা দু’টি মরশুমে সাফল্য এনে দেন। এই সাফল্যের জন্য ২০০৬-০৭ মরশুমে বার্সেলোনার সি টিমের কোচিংয়ের দায়িত্ব পান তিনি।

২০০৭-এ তেরাসা এফসি স্পোর্টিং ডিরেক্টর করে নিয়ে আসে তাঁকে। সেই মরশুমে দলের শেষ সাতটি ম্যাচে তিনি কোচের ভূমিকাতেও ছিলেন। ২০১২-য় তিনি বার্সেলোনায় ফিরে আসেন টিটো ভিলানোভার সহকারী হিসেবে। তবে সেই ভূমিকায় বেশিদিন থাকেননি তিনি। স্পেনের দ্বিতীয় ডিভিশন ক্লাব ইউডি লা পালমায় যোগ দেন এক মাস পরেই। সেবার লিগের ছ’নম্বরে ছিল তাঁর দল।

এর পরেই প্রথম স্পেনের বাইরে পা রাখেন লোবেরা ও মরক্কোর মঘরেব তেতুয়ান ক্লাবে যোগ দেন এবং ক্লাবকে প্রথমবার আফ্রিকান চ্যাম্পিয়ন্স লিগের প্রাথমিক পর্বের গণ্ডী পার করান। ২০১৭-য় তিনি আসেন ভারতে, এফসি গোয়ার দায়িত্ব নিয়ে। সেবারই দলকে প্লে-অফে তোলেন তিনি এবং পরেরবার ফাইনালে। তবে সে বার ফাইনালে বেঙ্গালুরু এফসি-র কাছে হেরে যায় গোয়ার দল। হিরো আইএসএল চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও ২০১৯-এ দলকে সুপার কাপে চ্যাম্পিয়ন করেন লোবেরা। তবে গত মরশুমে তাঁর দল যখন লিগ টেবলের শীর্ষে ছিল এবং লিগে আর মাত্র তিনটি ম্যাচ বাকি ছিল, তখন দায়িত্ব ছেড়ে দেশে ফিরে যান।

ঠাণ্ডা মাথায় ও আগ্রাসী ফুটবল না খেলেও কী ভাবে প্রচুর গোল করা যায়, তা ভারতীয় ফুটবলারদের প্রথম শেখান লোবেরাই। টানা তিন মরশুমে লিগে সবচেয়ে বেশি গোল করে তাঁর প্রশিক্ষণে থাকা এফসি গোয়া। এ বার সেই দল থেকে মুর্তাদা ফল, আমেদ জাহু, হুগো বুমৌস, মান্দার রাও দেশাই-দের নিয়ে এসে বাজিমাত করে দিয়েছেন। ইউডি পালমায় তাঁর প্রশিক্ষণে খেলা হারনান সান্তানাকেও তিনিই নিয়ে আসেন মুম্বইয়ে। বাকিটা সারা মরশুম জুড়ে সবাই দেখেছেন।

শনিবার ফতোরদায় যার দলই শেষ হাসি হাসুক, এমন দুই অসাধারণ কোচকে পেয়ে লাভবান হয়েছেন ভারতীয় ফুটবলার ও ফুটবলপ্রেমীরা। তাঁদের প্রভাব এ দেশের ফুটবলে অনেক দিন থাকবে। যতদিন তাঁরা হিরো আইএসএলে থাকবেন, তত দিন তো বটেই। তার পরেও বহু বছর।