হিরো আইএসএল শুরুর পর থেকে এক ঝাঁক বিদেশি কোচ দায়িত্ব সামলেছেন কলকাতার ক্লাবগুলিতে। কেউ যেমন দারুন সফল হয়েছেন, তেমনই কেউ চরম ব্যর্থ হয়েছেন। আন্তোনিও লোপেজ হাবাস কোচিং জীবনের সেরা সময়টা যদি কাটিয়ে থাকেন এই লিগে, তা হলে সবচেয়ে খারাপ সময় গিয়েছে রবি ফাউলার, মানোলো দিয়াজদের। কেমন ছিল তাদের এই অভিযান। ফুটবল-মক্কার ফ্যানদের মন জয় করতে পেরেছেন কারা, কী ভাবে এবং কারাই বা কী ভাবে তলিয়ে গিয়েছেন বিস্মৃতির অতলে, এই সব নিয়েই এই বিশেষ প্রতিবেদন।

আন্তোনিও লোপেজ হাবাস (এটিকে, এটিকে মোহনবাগান)

হিরো আইএসএলে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সফল কোচ বলা হয়ে থাকে এই স্প্যানিশ কোচকে। সবচেয়ে অভিজ্ঞও বটে। ২০১৪-য় প্রথম হিরো আইএসএলেই তিনি চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন কলকাতার দল এটিকে-কে। ২০১৯-২০ মরশুমে তিনি ফের এটিকে-র দায়িত্ব নিয়ে তাদের চ্যাম্পিয়ন হতে সাহায্য করেন। দ্বিতীয় মরশুমে তাঁর প্রশিক্ষণেই এটিকে সেমিফাইনালে ওঠে এবং ২০২০-২১-এও সদ্যগঠিত এটিকে মোহনবাগানকে প্রথমে লিগের দু’নম্বর দল হিসেবে নক আউটে ও পরে ফাইনাল পর্যন্ত নিয়ে যান। তবে সে বার ফাইনালে ২-১ গোলে হেরে যায় তাঁর দল।

পরবর্তী মরশুমে (২০২১-২২) এএফসি কাপ ও হিরো আইএসএলে আশানুরূপ ফল না পাওয়ায় মরশুমের মাঝপথেই (ডিসেম্বর) দায়িত্ব ছেড়ে চলে যান। খেলোয়াড়জীবনে ডিফেন্ডার হিসেবে মাঠে নামা হাবাস প্রথমবার এটিকে-র দায়িত্ব নেওয়ার পরে ২০১৪-র জুলাই থেকে ২০১৫-র ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৩টি ম্যাচের মধ্যে ১৩টিতে জেতে কলকাতার দল। এই অভিযানে হাবাসের দলের সাফল্যের শতকরা হিসাব ছিল ৩৩.৩৯ শতাংশ। ২০১৯-এ যখন ফের এটিকে-র দায়িত্ব নেন, সে বার তাঁর প্রশিক্ষণে থাকা দলটির ‘সাকসেস পার্সেন্টেজ’ বা সাফল্যের হার ছিল ৫৭.১৪% (২১ ম্যাচে ১২ জয়)।

২০২০-তে এটিকে মোহনবাগানের দায়িত্ব নেওয়ার পরে তিনি যে দেড় মরশুমে দলকে প্রশিক্ষণ দেন, সেই সময়ে সবুজ-মেরুন বাহিনী ৩৩টি ম্যাচে ১৭টি জয় পায়। জয়ের শতকরা হার ছিল ৫১.৫২%। অর্থাৎ, সব মিলিয়ে কলকাতার দলকে তিনি ৮৭টি ম্যাচে নামিয়ে জয়ের পথ দেখিয়েছেন ৪২টিতে। সব মিলিয়ে সাফল্যের হার ৪৮.২৭%। এ ছাড়াও হিরো আইএসএলে তিনি পুণে সিটির কোচও ছিলেন ২০১৯-২০ মরশুমে। তবে ভারত ছেড়ে যাওয়ার পরে আর কোনও নতুন দায়িত্ব নেননি হাবাস।

হোসে ফ্রান্সিসকো মলিনা (এটিকে)

২০১৬-র মে মাসে হাবাসের জায়গায় এটিকে কোচ হিসেবে নিয়ে আসে মলিনাকে। সে বছর দলকে দ্বিতীয় হিরো আইএসএল খেতাব জিততে সাহায্য করেন তিনি। সে বার লিগ পর্বে ১৪টি ম্যাচের মধ্যে চারটিতে জয় পায় এটিকে। আটটিতে ড্র করে। ২০ পয়েন্ট পেয়ে চতুর্থ দল হিসেবে নক আউটে ওঠে। সেমিফাইনালে মুম্বই সিটি এফসি-কে ৩-২-এ হারিয়ে ফাইনালে ওঠে। যেখানে টাই ব্রেকারে ৪-৩-এ হারিয়ে তারা চ্যাম্পিয়ন হয়। সে বার তাঁর দলের কানাডিয়ান ফরোয়ার্ড লেইন হিউম সাতটি গোল করে সর্বোচ্চ স্কোরারদের তালিকায় দু’নম্বরে ছিলেন।

এটিকে-তে যোগ দেওয়ার আগে কোচ হিসেবে স্পেনের ভিলারিয়াল ক্লাবের সিনিয়র, বি ও সি দল সামলান তিনি। গেতাফের বি ও হংকংয়ের কিচি ক্লাবেও ছিলেন। খেলোয়াড় জীবনে গোলকিপার হিসেবে আতলেটিকো মাদ্রিদ ও দেপোর্তিভো করুনার মতো ক্লাবে টানা দশ বছর খেলেছেন মলিনা। স্পেনের জাতীয় দলের জার্সি গায়েও মাঠে নেমেছেন। এটিকে ছাড়ার পরে তিনি স্পেনের ক্লাব ফুটবলে ফিরে যান এবং ২০১৮-য় রয়্যাল স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশনের স্পোর্টিং ডিরেক্টর হিসেবে যোগ দেন।   

টেডি শেরিংহ্যাম (এটিকে):

১৯৯০ এর দশকে ইংল্যান্ডের তারকা ফরোয়ার্ড টেডি শেরিংহ্যাম ২০১৭-র জুলাইয়ে এটিকে-র প্রধান কোচ হিসেবে দায়িত্ব নেন। খুব একটা সফল কোচ হিসেবে যে ভারতে এসেছিলেন তিনি, তা নয়। ২০১৪-য় ওয়েস্ট হ্যাম ক্লাবে অ্যাটাকিং কোচ হিসেবে যোগ দিয়ে তাদের খেলার স্টাইল বদলাতে বিশেষ ভাবে সাহায্য করেন তিনি। পরের বছর দ্বিতীয় ডিভিশন ক্লাব স্টিভেনেজের ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব নেন তিনি। কিন্তু সেখানেও সফল হননি। এর পরের বছরই জুলাইয়ে এটিকে-র হেড কোচের দায়িত্ব নেন তিনি। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই অনিশ্চয়তার কালো মেঘে ঢেকে যায় তাঁর কোচিং কেরিয়ার। ২০১৮-র জানুয়ারিতেই ফের দায়িত্ব ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। কারণ, দশটি ম্যাচের মধ্যে মাত্র তিনটিতে জিততে পেরেছিল তাঁর দল।

সে বার লিগ তালিকার নয় নম্বরে থেকে মরশুম শেষ করে এটিকে। ১৮টির মধ্যে মাত্র চারটি ম্যাচে জয় ও চারটিতে ড্র ছিল তাদের। শেরিংহাম চলে যাওয়ার পরে তাঁর জায়গায় দায়িত্ব নেন ইংল্যান্ডের আর এক প্রাক্তন ফুটবলার অ্যাশলে ওয়েস্টউড এবং তিনিও প্রায় দেড় মাস পরে দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার পরে খেলোয়াড় হিসেবে যোগ দেওয়া আইরিশ ফুটবলার রবি কিনই কোচের দায়িত্ব সামলান শেষ তিন মাসের জন্য।    

স্টিভ কপেল (এটিকে)

শেরিংহ্যামের প্রশিক্ষণে ২০১৭-১৮ মরশুমে ভরাডুবির পরে দলকে সঠিক জায়গায় ফিরিয়ে আনতে এটিকে ম্যানেজমেন্ট ২০১৮-১৯ মরশুমে দলের হেড কোচ করে নিয়ে আসে ইংল্যান্ডের প্রাক্তন রাইট উইঙ্গার স্টিভ কপেলকে। যাঁর কোচিং কেরিয়ারও ছিল উল্লেখযোগ্য। এটিকে-তে কোচ হিসেবে আসার আগে তিনি ১৯৮৪ থেকে ২০১০ পর্যন্ত ক্রিস্টাল প্যালেস, ম্যাঞ্চেস্টার সিটি, ব্রেন্টফোর্ড, ব্রিস্টল সিটির মতো নামী ক্লাবে প্রশিক্ষণ দেন। হিরো আইএসএলের বৃত্তে তিনি প্রথম পা রাখেন ২০১৬-য় কেরালা ব্লাস্টার্সের আমন্ত্রণে। সেবার কেরালা ব্লাস্টার্স রানার্স হয় ফাইনালে এটিকে-র কাছে হেরেই।

এই পারফরম্যান্স দেখে ২০১৭-১৮ মরশুমে জামশেদপুর এফসি তাঁকে দলের দায়িত্ব দেন। কিন্তু এ বার দলকে নক আউটে তুলতে পারেননি কপেল, পাঁচ নম্বরে থেকে যায় তাঁর দল। ২০১৮-র জুনে এটিকে তাদের কোচ হিসেবে ঘোষণা করে কপেলের নাম। কিন্তু তিনি এসেও কলকাতার দলের হাল ফেরাতে পারেননি। ছয় নম্বরে থেকে যায় তাঁর দল। সারা মরশুমে ছ’টি-র বেশি ম্যাচ জিততে পারেনি তারা। দু’বারের চ্যাম্পিয়নদের এই নিয়ে টানা দু’বার প্লে অফে উঠতে না পারার জ্বালা আরও বাড়ে ২০১৯-এর সুপার কাপ সেমিফাইনালে চেন্নাইন এফসি-র কাছে হেরে যাওয়ায়। এই হারের পরেই কপেলের বিদায়-ঘোষণা ছিল অবধারিত।

হুয়ান ফেরান্দো (এটিকে মোহনবাগান)

 

গত মরশুমের মাঝখানেই, ১৮ ডিসেম্বর আন্তোনিও লোপেজ হাবাস এটিকে মোহনবাগানের পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার পর ক্লাব কর্তারা তড়িঘড়ি এফসি গোয়া থেকে নিয়ে আসেন স্প্যানিশ কোচ হুয়ান ফেরান্দোকে, যিনি ১৮ বছর বয়স থেকেই ফুটবল কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িত পড়েন। হিরো আইএসএলের মাঝখানে দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর টানা ১৫টি ম্যাচে অপরাজিত ছিল এটিকে মোহনবাগান। এমনকী লিগ শিল্ড জয়েরও কাছাকাছি চলে এসেছিল তারা। কিন্তু একেবারে লিগের শেষ দিকে এসে জামশেদপুর এফসি-র কাছে কাছে হেরে লিগ টেবলের তিন নম্বরে শেষ করে তারা এবং সেমিফাইনালেও হায়দরাবাদের কাছে হেরে ছিটকে যায়।

খেলোয়াড়জীবনে একের পর এক চোট পেয়ে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ফুটবল মাঠে নামা ছেড়ে দিলেও ফুটবল ফেরান্দোকে ছাড়েনি। স্পেনের এস্পানিয়ল ক্লাব থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই যুবক প্রথমে সেই ক্লাবের ক্যাম্পাস অ্যান্ড মেথডলজিকাল কোচের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর হাতে-কলমে কোচিংয়ের শিক্ষা বার্সেলোনা ‘বি’ দলে। সেখান থেকেই স্পেনের প্রেমিয়া, তেরাসা, হসপিতালেত, মালাগা ক্লাবের যুব দলের কোচ। ২০১৩-য় মলদোভিয়া যাত্রা করেন শেরিফ তিরাসপল ক্লাবের ডাকে। ২০১৪-য় গ্রিসের এর্গোতেলিসে কোচিং করানোর পরে ফিরে আসেন নিজের দেশে, কালচারাল লিওনেসার প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে। ২০১৭-য় লিনারেস ফুটবল ক্লাবের দায়িত্ব নেন। তার পরে পাঁচ বছর গ্রিসের ভোলোসে। সেখান থেকেই ২০২০-তে এফসি গোয়ায় এবং পরের মরশুমের মাঝখানে এটিকে মোহনবাগানে।

প্রথম বছর হিরো আইএসএলে এটিকে মোহনবাগানকে খাদের কিনারা থেকে তুলে আনার পরে কলকাতার ক্লাবের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ বাড়ে তার। এএফসি কাপের বাছাই পর্ব ও গ্রুপ পর্বের গণ্ডী পেরিয়ে ইন্টার জোনাল সেমিফাইনালেও পৌঁছে দেন দলকে। কিন্তু তার পরে আর এগোতে পারেনি। ক্লাব মরশুমের শুরুটাও ভাল করতে পারেননি ফেরান্দো। মরশুমের প্রথম টুর্নামেন্ট ডুরান্ড কাপের গ্রুপ পর্ব থেকে ছিটকে যায় সবুজ-মেরুন বাহিনী। এ বার সামনে হিরো আইএসএলের পরীক্ষা। তবে এটিকে মোহনবাগানের কোচ হিসেবে তাঁর সাফল্যের হার ৬১.৯০%।

রবি ফাউলার (এসসি ইস্টবেঙ্গল)

খেলোয়াড়জীবনে একজন সফল স্ট্রাইকার ও প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে সর্বোচ্চ স্কোরারদের তালিকায় আট নম্বরে জায়গা করে নিলেও রবি ফাউলারের কোচিং জীবন মোটেই তেমন সাফল্যের নয়। ২০১১-য় তাইল্যান্ডের মুয়াংথং ইউনাইটেডের দায়িত্ব নিয়ে কোচিং কেরিয়ার শুরু করা ফাউলার ২০১৩-য় ফিরে যান তাঁর পুরনো ক্লাব লিভারপুলে, অ্যাকাডেমি কোচ হয়ে। ২০১৯-এ তিনি অস্ট্রেলিয়ান ক্লাব ব্রিসবেন রোর-এর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই কোভিড থাবা বসায় সেখানকার ক্লাব ফুটবলে এবং দেশে ফিরে যান ফাউলার। সে বছরই অক্টোবরে তিনি এসসি ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে চুক্তি করেন। কিন্তু ভারতীয় ফুটবলের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটা যে তাঁর মতো হাই প্রোফাইল ফুটবলারের পক্ষে মোটেই সোজা কাজ নয়, তা বুঝতে পারেন, যখন ১৮ ম্যাচে তাঁর দল ১৭ পয়েন্টের বেশি পায়নি। রেফারিদের সঙ্গে চরম ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে কড়া শাস্তির মুখেও পড়েন তিনি। সেই মরশুমের পরেই ক্লাব জানিয়ে দেয়, তাঁর সঙ্গে আর চুক্তি বহাল রাখা হবে না।

মানোলো দিয়াজ (এসসি ইস্টবেঙ্গল)

রিয়াল মাদ্রিদের যুব দল, তাদের বি ও সি দলকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরে ২০২১-এর সেপ্টেম্বরে এসসি ইস্টবেঙ্গলের কোচ হিসেবে যোগ দেন দিয়াজ। কিন্তু কোচিং জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময় তিনি ভারতে এসেই কাটান। তাঁর প্রশিক্ষণে মাঠে নেমে আটটি ম্যাচ খেলে লাল-হলুদ বাহিনী। কিন্তু একটিও ম্যাচ জিততে পারেনি তারা। এই ফলের পর তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দেশে ফিরে যান।   

মারিও রিভেরা (এসসি ইস্টবেঙ্গল)

মানোলো দিয়াজ দায়িত্ব ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে ২০২২-এর জানুয়ারিতে এসসি ইস্টবেঙ্গল দলের দায়িত্ব নেন আর এক স্প্যানিশ কোচ মারিও রিভেরা, যিনি এর আগেও (২০২০) দুঃসময়ে এই ক্লাবের দায়িত্ব নিয়ে সন্মান বাঁচিয়েছিলেন। সেই উদ্দেশ্যেই হয়তো এ বারও তাঁকে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু এ বার আর আগেরবারের মতো দলকে খাদের কিনারা থেকে টেনে আনতে পারেননি। বাকি ১২টি ম্যাচের মধ্যে মাত্র একটিতে জয় এনে দিতে পারেন তিনি। এই পারফরম্যান্সের পর স্বাভাবিক ভাবেই আর চুক্তির মেয়াদ বাড়েনি রিভেরার। ২০০৭ থেকে ফুটবল কোচ হিসেবে কেরিয়ার শুরু করা রিভেরা মাদ্রিদের লেগানেস, সেলটিক, আতলেতিকো মাদ্রিদ সি, ব্রুনেই অনূর্ধ্ব ২১ দলেরও কোচ ছিলেন। ২০১৮-য় তিনি প্রথম ভারতে আসেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের ডাকে।