গ্রুপ লিগের দুই ম্যাচেই হার স্বীকার করতে হয়েছে তাদের। এই ম্যাচে সেই জ্বালা মেটানোর সুযোগ এটিকে মোহনবাগানের সামনে। শনিবার ফতোরদার জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে হিরো আইএসএল ২০২০-২০২১-এর ফাইনালে। আর আইএসএল অভিষেকেই যে আগ্রাসন ও আধিপত্য নিয়ে শিখরে পৌঁছেছে সবুজ-মেরুন বাহিনী, গত দু’বারের মতো তাদের সেই দর্প চূর্ণ করে ভারতীয় ফুটবলে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখার সুযোগ মুম্বই সিটি এফসি-র।

শনিবার সন্ধ্যায় এই মহা ফুটবল-যুদ্ধের নেপথ্যে দুই স্পেনীয় ক্ষুরধার ফুটবল মস্তিষ্ক, দুই কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাস ও সের্খিও লোবেরা রড্রিগেজ। ভারতের সেরা ফুটবল লিগের ফাইনালে তাঁদের কৌশল-যুদ্ধ দেখবেন সাগরপাড় ও গঙ্গাপাড়ের শহরের ফুটবলপ্রেমীরা। সেই কৌশল অবলম্বন করে দুই দলের একঝাঁক ফুটবল তারকা যে যাঁরা সেরা অস্ত্র দিয়ে একে অপরকে ঘায়েল করার চেষ্টা করবেন ৯০ (প্রয়োজনে ১২০) মিনিট ধরে। ভারতীয় ফুটবলে দেশের কোন প্রান্তের দাপট বেশি, পূর্ব না পশ্চিমের, তা এই লড়াইয়ের পরেই বোঝা যাবে।

বদলা-ই যখন মোটিভেশন

গ্রুপ লিগে অন্য কোনও দলের বিরুদ্ধেই যা ঘটেনি এটিকে মোহনবাগানের, মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে সেটাই হয়েছে। সাগরপাড়ের ক্লাবের বিরুদ্ধে কোনও বারই জিততে পারেনি তারা। হায়দরাবাদ এফসি-র বিরুদ্ধেও জেতেনি সবুজ-মেরুন বাহিনী, দুই ম্যচেই তাদের বিরুদ্ধে ড্র হয়। কিন্তু দুই লেগের ম্যাচেই হার—শুধুমাত্র মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে। তার ওপর এই মুম্বই সিটি এফসি-র কাছে হেরেই লিগশিল্ডের দৌড় থেকে ছিটকে যান রয় কৃষ্ণা, ডেভিড উইলিয়ামসরা। হাতছাড়া হয় এশিয়ার সবচেয়ে বড় ক্লাব লিগ এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলার সুবর্ণ সুযোগ। তাই বদলার উত্তাপে রীতিমতো ফুটছে এটিকে মোহনবাগান শিবির।

মুম্বই সিটি এফসি শিবিরও উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে। কিন্তু তার কারণটা আলাদা। লিগশিল্ড জেতা হয়ে গিয়েছে। ২০২২ এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গ্রুপ পর্বে খেলা পাকা করে ফেলেছে তারা। এ বার চ্যাম্পিয়নের খেতাবটাও জিতলে তা হবে সোনায় সোহাগা। এর আগে কখনও হিরো আইএসএলের ফাইনালে ওঠা হয়নি তাদের। দু’বার সেমিফাইনালে উঠেও সে গণ্ডী পার করতে পারেনি তারা। এ বারই প্রথম ফাইনালে উঠে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুযোগ হুগো বুমৌস, মুর্তাদা ফলদের সামনে। এমন সুযোগ হাতছাড়া করা যায়?

আত্মবিশ্বাসের অভাব নেই দুই শিবিরেই। মুম্বইকে কোনও ম্যাচে হারাতে না পারলেও কলকাতার দল সমান পয়েন্ট (৪০) নিয়ে গ্রুপ লিগ শেষ করে। গোল দেওয়ার দিক থেকে পিছিয়ে থাকলেও গোল খাওয়ার দিক থেকে এগিয়ে ছিল তারা। সেমিফাইনালে যেখানে মুম্বই সিটি এফসি-কে প্রথম লেগ ড্র করার পরে দ্বিতীয় লেগে টাই ব্রেকার (এবং সাডেন ডেথ)-এর বাধা পেরিয়ে ফাইনালে উঠতে হয়, এটিকে মোহনবাগান সেখানে প্রথম লেগ ড্র করার পর দ্বিতীয় লেগে ৯০ মিনিটেই ম্যাচ জিতে খেতাবি লড়াইয়ে লড়ার যোগ্যতা অর্জন করে নেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কারা সত্যিই এগিয়ে বা কারা পিছিয়ে, তার হিসাব ফাইনালেই হবে।

দুই ধারালো মস্তিষ্কের যুদ্ধ

দুই ধারালো স্প্যানিশ ফুটবল-মস্তিষ্ক দুই দলকেই চালনা করে। তাদের রণনীতি, দল বাছাই থেকে শুরু করে তাদের গতিপথ নির্ণয়, সবই দুই স্প্যানিশ কোচের ওপর নির্ভর করে। একদিকে ৬৩ বছর বয়সি অভিজ্ঞ আন্তোনিও লোপেজ হাবাস। অন্য দিকে, ৪৪ বছরের ‘জোয়ান’ কোচ সের্খিও লোবেরা। দু’জনেই একই দেশ থেকে এলেও তাঁদের ফুটবল দর্শনে তফাৎ রয়েছে। হাবাস পছন্দ করেন গতিময়, আগ্রাসী, আকর্ষণীয় ফুটবল। লোবেরা জোর দেন ঠাণ্ডা মাথায়, ধীর-স্থির ভাবে, দেখেশুনে, পাসিং ফুটবল খেলে ম্যাচে নিয়ন্ত্রণ এনে শত্রুকে কাবু করার নীতিতে।

পিছন থেকে আক্রমণ তৈরি করাই পছন্দ মুম্বইয়ের ফুটবলারদের। বল নিজেদের মাটিতে রেখে ও নিজেদের মধ্যে পাস খেলতে খেলতে বিপক্ষের গোল এরিয়ায় এগিয়ে যাওয়াই মুর্তাদা ফলদের খেলার বৈশিষ্ট। সারা লিগে এ পর্যন্ত ১০,৫৭০ টি পাস খেলেছে মুম্বই সিটি এফসি। এই পরিসংখ্যানে শুধু এফসি গোয়া তাদের চেয়ে এগিয়ে। ফাইনালের পরে অবধারিত ভাবে এক নম্বরে চলে যাবে মুম্বই। পাসের সংখ্যার দিক থেকে এটিকে মোহনবাগান অনেক পিছিয়ে। এ পর্যন্ত ২২ ম্যাচে ৭,৩১১টি পাস খেলেছেন কার্ল ম্যাকহিউ, হাভিয়ে হার্নান্ডেজরা। পাসের সংখ্যায় মুম্বইয়ের পরেই স্থান এসসি ইস্টবেঙ্গলের (৮,১৯৩)।

হাবাসের দল অত্যাধিক পাসিংয়ের চেয়ে দ্রুত আক্রমণে উঠে প্রতিপক্ষের পেনাল্টি বক্সে হানা দেওয়ার পক্ষপাতী। তাই শটের সংখ্যার দিক থেকে তারা রয়েছে দু’নম্বরে, এফসি গোয়ার পরেই। গোয়ার দল যেখানে ৩০০ শট মেরেছে ২২ ম্যাচে, সেখানে সবুজ-মেরুন ফুটবলারদের শটের সংখ্যা ২৭৮। মুম্বই সিটি এফসি-ও কাছাকাছি রয়েছে। তাদের শটের সংখ্যা ২৭১। তবে রয় কৃষ্ণার শটের সংখ্যার (৫৮) কাছাকাছি নেই মুম্বইয়ের কোনও খেলোয়াড়।

শক্তি বনাম দুর্বলতা

ঘর সুরক্ষিত রেখে শত্রুকে আক্রমণ করাই হাবাসের প্রধান নীতি। তাই এটিকে মোহনবাগান এ বার দল বাছাইয়ের সময় শুরুতেই একাধিক ডিফেন্ডারকে সই করায়। আনে সন্দেশ, তিরি, শুভাশিসদের মতো ডিফেন্ডারদের। ফলও পেয়েছেন হাতে নাতে। সবচেয়ে কম গোল খেয়েছে তারা (২২ ম্যাচে ১৭)। এফসি গোয়ার কোচ থাকাকালীন লোবেরা গোল খাওয়া নিয়ে বেশি ভাবতেন না। কিন্তু এ বার মুম্বইয়ে যোগ দিয়ে তিনি এ দিকটাও জোর দিতে শুরু করেন। ফলস্বরূপ এই মরশুমে ২০-র বেশি গোল খায়নি তাঁর দল। এ জন্য দু’দলেরই দুর্ভেদ্য রক্ষণ দায়ী।

হাবাসকে এ জন্য অবশ্য অনেক সমালোচনা হজম করতে হয়েছে। তিনি রক্ষণাত্মক ফুটবলকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন, এমন অভিযোগও ওঠে। কিন্তু তাঁর যুক্তি, “আগে গোল দিয়ে তার পরে রক্ষণে দেওয়াল তুলে দেওয়ার মধ্যে ভুলটা কোথায়? এক গোলে জেতাও যা, পাঁচ গোলে জেতাও তাই। ৫-৪ গোলে জেতার চেয়ে আমি ১-০ গোলে জেতা বেশি পছন্দ করব”। এই নীতিতেই এই লিগে ১২টি ম্যাচ জিতেছে হাবাসের দল। শনিবারও সেই একই নীতি অবলম্বন করেন কি না, সেটাই দেখার।  

এটিকে মোহনবাগানের আগ্রাসী, কাউন্টার অ্যাটাক নির্ভর ফুটবল সামলে মুম্বই তাঁদের পাস-নির্ভর ফুটবলের মাধ্যমে কী ভাবে শত্রুকে জব্দ করবে, সেটাই দেখার। তবে এটা ঠিকই যে বল দখলের লড়াইয়ে মুম্বই সিটি এফসি-র ফুটবলারদের হারানো বেশ কঠিন এবং গত দু’বারের মুখোমুখিতে লোবেরার দল যেটা করেছে, তা হল রক্ষণের সামনে দেওয়াল তুলে দিয়ে আক্রমণে ওঠা ও বিপক্ষের রক্ষণের ফাঁক দিয়ে ঢুকে গোল করে আসা। মুম্বইয়ের রক্ষণের দেওয়ালে চিড় ধরাতে গেলে সবুজ-মেরুন বাহিনীকে উইং-প্লে অনেক বাড়াতে হবে, যা তাদের আগের দুই ম্যাচেই ছিল কম।

আগের দুই দ্বৈরথ

প্রথম ম্যাচে এডু গার্সিয়ার সুবর্ণ সুযোগ নষ্টের খেসারত দিতে হয় তাদের। মুম্বইয়ের পাস-নির্ভর ফুটবলের জন্য কাউন্টার অ্যাটাকে সে ভাবে উঠতেই পারেননি রয় কৃষ্ণারা। প্রথমার্ধে যখন পৌনে চারশো পাস খেলা হয়ে গিয়েছিল তাদের, তখন এটিকে মোহনবাগানের পাসের সংখ্যা দেড়শোও পেরোয়নি। বিপক্ষকে কাউন্টার অ্যাটাকের সুযোগ দিলেই যে তাদের বিপদ হতে পারে, মুম্বই তা বুঝে নেয় দ্বিতীয়ার্ধ, যখন মাঝমাঠ থেকে প্রণয়ের পাস ধরে পেনাল্টি বক্সের দিকে দ্রুত দৌড়ে যান এডু গার্সিয়া। বিপক্ষের রক্ষণের বুক চিরে দীর্ঘদেহী ডিফেন্ডার মুর্তাদা ফলকে ধোঁকা দিয়ে প্রায় ফাঁকা গোলে বল ঠেলে দেন তিনি। কিন্তু পোস্টের ভিতরে লেগে বল ফিরে আসে।

এই একটা কাউন্টারেই নড়েচড়ে বসে মুম্বই সিটি এফসি। প্রথমার্ধে যে পাসিংসর্বস্ব ফুটবল খেলছিল তারা, সেই জায়গা থেকে সরে এসে উইং দিয়ে আক্রমণের প্রবণতা বাড়ে তাদের এবং বহু প্রতিক্ষার সেই মুহূর্তটি এসে যায় ৬৯তম মিনিটে। নিজেদের এলাকায় হার্নান সান্তানা এডু গার্সিয়ার পা থেকে বল কেড়ে তাঁকে মাটিতে ফেলে দিয়ে দৌড় শুরু করেন ও বিপক্ষের বক্সের মাথায় থাকা বুমৌসকে পাস দেন। তিনি ফ্লিক করে বল দেন বাঁ দিক দিয়ে ওঠা ওগবেচেকে। তিনি ডান পোস্টের দিকে রাখা জোরালো শটে গোল দেন।

লিগের দ্বিতীয় পর্বের ম্যাচেও শুরুতে গোল করে রক্ষণে দেওয়াল তুলে দেয় লোবেরার দল। সাত মিনিটের মাথায় সেনেগালিজ ডিফেন্ডার মুর্তাদা ফল গোল করে এগিয়ে দেন দলকে। ৩৯ মিনিটের মাথায় সেই ব্যবধান বাড়ান নাইজেরিয়ান ফরোয়ার্ড বার্থোলোমিউ ওগবেচে। দু’জনেই গোল করেন হেডে। ভুল শুধরে দ্বিতীয়ার্ধে গোল শোধ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেও মুম্বইয়ের দুর্ভেদ্য রক্ষণ ভেদ করে বিপক্ষের জালে বল জড়াতে পারেনি এটিকে মোহনবাগান। তাই শনিবার যে মুম্বইকে আর গোল করতে দেওয়া চলবে না, তা বুঝেই গিয়েছেন সবুজ মেরুন শিবিরের ফুটবলাররা। গোল আটকালে যে রয়, ডেভিডরা গোল করে দেবেনই, সেই ভরসা তাদের আছে। বলেই জানিয়েছন প্রীতম, প্রবীর, শুভাশিস, অরিন্দমরা।      

কৌশল বদলাতে হবে, মানসিকতাও বদলাতে হবে। তা হলেই আসবে জয়। এটা জেনে নিয়েই প্রস্তুত হচ্ছে সবুজ-মেরুন শিবির। শনিবার এই হাবাসের এই পরিবর্তিত কৌশলই বিপক্ষকে চমকে দেবে? না লোবেরার কাছেও তাঁর ও তাঁর দলের জন্য কিছু সারপ্রাইজ আছে? সব উত্তর পাওয়া যাবে শনিবার সন্ধ্যায় ফতোরদা স্টেডিয়ামে।

এটিকে মোহনবাগান স্কোয়াড:

গোলকিপার: অরিন্দম ভট্টাচার্য, অভিলাষ পাল, আর্শ শেখ

ডিফেন্ডার: তিরি, প্রীতম কোটাল, প্রবীর দাস, সন্দেশ ঝিঙ্গন, শুভাশিস বসু, সুমিত রাঠি, সালাম সিং

মিডফিল্ডার: প্রণয় হালদার, হাভিয়ে হার্নান্ডেজ, এডু গার্সিয়া, কার্ল ম্যাকহিউ, লেনি রড্রিগেজ, জয়েশ রানে, রেজিন মাইকেল, শেখ সাহিল, এন ইংসন সিং

ফরোয়ার্ড: ডেভিড উইলিয়ামস, রয় কৃষ্ণা, মনবীর সিং, মার্সেলো পেরেইরা, কোমল থাটাল, মহম্মদ ফারদিন আলি মোল্লা   

মুম্বই সিটি এফসি স্কোয়াড:

গোলকিপার: অমরিন্দর সিং, নিশিথ শেট্টি, বিক্রম সিং, ফুর্বা লাচেনপা

ডিফেন্ডার: অমেয় রানাওয়াডে, ভলপুইয়া, মুর্তাদা ফল, মেহতাব সিং, মন্দার রাও দেশাই, তোনদোনবা সিং, মহম্মদ রকিপ

মিডফিল্ডার: আমেদ জাহু, বিদ্যানন্দ সিং, বিপিন সিং, হার্নান সান্তানা, রেইনিয়ে ফার্নান্ডেজ, রাওলিন বোর্জেস, হুগো বুমৌস, সি গদার্ড, আসিফ খান, জ্যাকিচন্দ সিং, ডি ভিগ্নেশ, বিক্রম প্রতাপ সিং, প্রাঞ্জল ভূমিজ

ফরোয়ার্ড: অ্যাডাম লে ফন্দ্রে, বার্থোলোমিউ ওগবেচে

সরাসরি দেখুন:

সন্ধ্যা ৭.৩০ থেকে

টিভিতে: স্টার স্পোর্টস নেটওয়ার্ক

স্ট্রিমিং: ডিজনি প্লাস হটস্টার ও জিও টিভি