জাতীয় দলের জার্সি গায়ে একটি গোল করেই যে এমন নায়কের আসনে বসে পড়বেন তিনি, তাঁকে নিয়ে এতটা প্রশংসা করবেন সবাই, তা বোধহয় কখনও ভাবতে পারেননি তিনি। এই ভাবনা তো দূরের কথা। কোনও দিন দেশের হয়ে মাঠে নামবেন, তাও কি ভাবতে পেরেছিলেন আনোয়ার আলি? বোধহয় না।

এশিয়ান কাপ ২০২৩ বাছাই পর্বের চূড়ান্ত রাউন্ডের শেষ ম্যাচে হংকংয়ের বিরুদ্ধে প্রথম মিনিটেই অনবদ্য গোল করে দলকে এগিয়ে দেন আনোয়ার। ভারত সেই ম্যাচ ৪-০-য় জেতার পরে উচ্ছ্বসিত তরুণ ডিফেন্ডার বলেন, “দেশের হয়ে কোনও দিন যে গোল করতে পারব, তা ভাবতেই পারিনি। স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। এত ভাল ভাল ফুটবল দলে থাকতে আমি? ভাবতেই পারছি না”।

ফুটবল জীবনের শুরুতেই চরম ধাক্কা খেয়েছিলেন পঞ্জাবের আদমপুর থেকে উঠে আসা আনোয়ার। ডাক্তাররা বলে দিয়েছিলেন, তাঁর হৃদযন্ত্রের দেওয়ালের কিছুটা অংশ একটু মোটা, যার ফলে তাঁর হৃদযন্ত্রে রক্ত সঞ্চালনে সমস্যা হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই রোগের নাম হাইপারট্রফিক মায়োকার্ডিওপ্যাথি। তাই চিকিৎসকেরা ২১ বছর বয়সি ছেলেটিকে জানিয়ে দেন, তাঁর আর আর ফুটবল খেলা হবে না।

ফুটবল চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধাটি নেমে ডাক্তারদের পরামর্শের পরে, যখন সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের মেডিক্যাল কমিটি তাঁকে পেশাদার ফুটবল থেকে সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেয়। কারণ, এই একই সমস্যা থাকায় ২০০৩-এ ক্যামেরুনের প্রাক্তন তারকা মার্ক ভিভিয়ান ফো ফিফা কনফেডারেশন কাপের সেমিফাইনাল চলাকালীন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

২০১৭-য় যুব বিশ্বকাপে ভারতীয় দলে ছিলেন তিনি। পরের বছর মুম্বই সিটি এফসি ৩০ লক্ষ টাকা দিয়ে তাঁকে সই করায়। একজন অনূর্ধ্ব ১৮ ফুটবলারকে এত টাকা দিয়ে চুক্তিবদ্ধ করার ঘটনা সেই প্রথম। ২০১৯-এ জাতীয় দলেও ডাক পেয়েছিলেন তিনি। এতটাই প্রতিশ্রুতিমান ছিলেন আনোয়ার। এমন উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ডাক্তারদের এক হুঁশিয়ারিতে শেষ হয়ে যাবে?  

তাই কপাল ঠুকে, ব্যক্তিগত মুচলেকা দিয়ে ফুটবল চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন আনোয়ার। চার বছর পরে তাঁর জীবনে যেটা ঘটল, তাকে তল্পনাতীত বললেও ভুল হবে না। ২০২১-২২ মরশুমে এফসি গোয়ায় যোগ দেন তিনি। সেখানে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখান। তার পরেই ভারতের ক্রোয়েশিয়ান কোচ ইগর স্টিমাচ তাঁকে ডেকে নেন জাতীয় দলের জন্য। এশিয়ান কাপ বাছাই পর্বের আগে বাহরিন, বেলারুশ ও জর্ডনের বিরুদ্ধে ভারতীয় দলের তিনটি ফ্রেন্ডলি ম্যাচেই খেলেছিলেন আনোয়ার।

তাঁর এই অদম্য মানসসিক শক্তির কথা জেনে মুগ্ধ দেশের ফুটবল মহল। আনোয়ারের প্রতি অভিনন্দনের বন্যা বইছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝরে পড়ছে হাজার হাজার আনোয়ার-স্তুতি। তবে সবচেয়ে ভাল বলেছেন তাঁর ক্লাব সতীর্থরা। তাঁকে কাছ থেকে দেখার পরে সেরিটন ফার্নান্ডেজ আনোয়ারকে নিয়ে বলেছেন, “যেদিন থেকে ক্লাবে অনুশীলন শুরু করেছিল ও, সে দিন থেকেই সবাইকে মুগ্ধ করেছে। এফসি গোয়ায় যোগ দেওয়ার আগে ওর লড়াইটা নিয়ে আমরা সবাই জানি। কী ভাবে ও জীবনের সঙ্গে প্রায় যুদ্ধ করে ফুটবলে ফিরে এসেছে। ভারতীয় দলে ওর ডাক পাওয়ার খবরে তাই আমরা সবাই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠি। আমার বিশ্বাস, ও সবে জীবন শুরু করল”।

স্প্যানিশ তারকা মিডফিল্ডার এডু বেদিয়াও আনোয়ারের এই সাফল্যে উচ্ছ্বসিত। বলেন, “দেশের হয়ে ওই গোলটা এবং তারপরে ওকে নিয়ে যে এখন যা হইচই হচ্ছে, এ সবই ওর প্রাপ্য ছিল। ওর সঙ্গে যখন খেলতে শুরু করি, তখনই বুঝেছিলাম, ও অন্য ধরনের প্রতিভা। ভারতে আমার পাঁচ মরশুম হয়ে গেল। আনোয়ারের মতো ফুটবলার আর দেখিনি। দেশের সর্বোচ্চ স্তরের ফুটবল খেলতে গেলে একজন ফুটবলারের যা যা দরকার, তা সবই ওর আছে”।

এফসি গোয়ার আর এক তারকা প্রিন্সটন রেবেলোও আনোয়ার আলির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তিনি বলেন, “ও রকম একটা গুরুত্ব ম্যাচে ভারতের হয়ে আনোয়ারের গোল দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি। আন্তর্জাতিক ফুটবলের শুরুতেই ও এত ভাল খেলছে, যা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। এশিয়ান কাপের মূলপর্বে ভারতের যোগ্যতা অর্জনে ওর অবদান যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ওর সঙ্গে দেখা করে ওকে অভিনন্দন জানানো পর্যন্ত আর তর সইছে না যেন”।