আমাদের 'উইমেন ইন ব্লু'দের-কে চিনে নিন। পিছনের সারিতে: সুইটি দেবী, জবামণি, ইন্দুমতী, অঞ্জু, ডাংমেই গ্রেস, আশালতা। সামনের সারিতে: রতনবালা, ডালিমা, অদিতি, সঞ্জু, সঙ্গীতা

ভারতীয় মহিলা ফুটবল দল নিয়ে আমার এই প্রতিবেদন। আর আপনি এই প্রতিবেদন পড়ছেন মানেই আপনি ভারতীয় মহিলা দলের ফ্যান, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে ভারতীয় মহিলা দল সম্পর্কে কতটুকু অবগত? মহিলা দিবস উদযাপনে হিরো আইএসএল থেকে নজর সরিয়ে আমাদের ফোকাসে ভারতীয় মহিলা দল। আসুন জেনে নিই ভারতীয় মহিলা দল সম্পর্কে নানা তথ্য। গত কয়েকমাসে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে ভারতীয় মহিলা ফুটবল দল। ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে প্রথমবার অলিম্পিকের যোগ্যতা অর্জন করে প্রমিলা বাহিনী। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে হংকং ও ইন্দোনেশিয়া সফরে চারটি প্রীতিম্যাচ খেলে সব কটি ম্যাচ জেতে ভারতীয় মহিলা দল। আর গত সপ্তাহে তুর্কি কাপে তুর্কমেনিস্তানকে ১০-০ গোলে উড়িয়ে দেন অদিতিরা।

বর্তমানে ভারতীয় মহিলা দল পেয়েছে এক মহিলা কোচ, মেমল রকি যিনি একজন প্রাক্তন জাতীয় ফুটবলার। আর এক যুব দল পাওয়ায় উন্নতি ঘটেছে দলের, যেই দলের গড় বয়স ২১ বছরের সামান্য বেশি। তাদের মধ্যে প্রতিশ্রুতিমান পাঁচ ফুটবলারের সঙ্গে পরিচয় করাব আপনাদের সঙ্গে।

ইন্দুমতি কাথিরেসন

নিজের মেজাজে ইন্দুমতি কাথিরেসন

ইন্দুমতির কাহিনী জানলে বুঝতে পারবেন বিশাল জীবন যুদ্ধে জয়ী হয়ে ফুটবল মাঠে নেমেছেন ইন্দুমতি। তামিলনাড়ুর মৎসজীবি পরিবারে জন্ম ইন্দুমতির। তবে ২০০৪ সালের সুনামি কেড়ে নেয় ইন্দুমতির পরিবার। বিশাল এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় হার মানাতে পারেনি ইন্দুমতিকে। ফুটবলকে ভালবেসে জীবন যুদ্ধে নেমে পড়েন এই লড়াকু ফুটবলার। এরপর তামিলনাড়ুর রাজ্য দলে সুযোগ পান ইন্দুমতি, যার সঙ্গে এই দলে ছিলেন আরও দুই ফুটবলার যারা তাদের পরিবারের সকলকে হারিয়েছেন সুনামিতে। ‘সমুদ্রে সুনামিতে আমরা সব হারিয়েছি, কিন্তু ফুটবলকে ভালবেসে জীবন ফিরে পেয়েছি আমরা’, জানান ভারতীয় দলের মিডফিল্ডার। ‘উইমেন ইন ব্লু’ হিসাবে নিয়মিত ফুটবলার তুর্কমেনিস্তানের বিরুদ্ধে অধিনায়কত্ব করেন এবং হংকং-এর বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ম্যাচে একমাত্র গোলটি করেন।

সঞ্জু যাদব

খেলোয়াড়ি মেজাজে সঞ্জু যাদব

হরিয়ানার আলাখপুরার এক সাধারণ পরিবারে জন্ম সঞ্জুর। হরিয়ানা থেকে দেশের মুখ উজ্জ্বল করা মহিলা ক্রীড়াবিদ প্রতিষ্ঠা পেলেও মহিলাদের খেলার প্রশ্নে এখনও দ্বিধায় হরিয়ানার সমাজ। তবে তাতে থেমে যাননি সঞ্জু। সামাজিক ভ্রান্ত ধারনাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দেশের প্রতিনিধিত্ব করে বর্তমানে হরিয়ানার আদর্শ সঞ্জু। হরিয়ানার এই ফুটবলার মাত্র ১০ বছর বয়সে ফুটবল খেলা শুরু করেন। ফুটবলকে ভালবেসে নয়, স্কলারশিপ পেয়ে পরিবারকে সাহায্য করাই ছিল উদ্দেশ্য। তারপর আর ঘুরে তাকাতে হয়নি তাকে। মাঠে তার ইতিবাচক মানসিকতাই জয়ী করেছে সঞ্জুকে। ‘জীবনের নানা প্রতিকূলতা আমাকে আরও শক্তিশালী করেছে। মাঠে ও মাঠের বাইরে লড়তে মানসিক ও শারীরিক দিক থেকে শক্তি জুগিয়েছে’,  জানান তুর্কমেনিস্তানকে ১০-০ হারানো ম্যাচে হ্যাটট্রিক করা ফুটবলার।

ডাংমেই গ্রেস

চেনা ছন্দে ডাংমেই গ্রেস

মনিপুরের এক গ্রামের ধর্মগুরুর মেয়ে হলেন ডাংমেই গ্রেস। তবে মনিপুরের মতো ফুটবল পাগল রাজ্যের মেয়ে হওয়ার কারণে ছোট থেকেই ফুটবলে মশগুল ছিলেন ডাংমেই। ‘বাড়ির বাইরে পা রাখার সুযোগ পেলেই এক ছুট্টে মাঠে হাজির হতাম আর ফুটবলে মেতে যেতাম। মাঠে আর কেউ না থাকলে একাই দৌড়তাম বল নিয়ে। মনে মনে একটাই কথা বলতাম নিজেকে, আমি ফুটবল খেলব’,  বলেন ২৩ বছর বয়সী ফুটবলার। আন্তর্জাতিক প্রীতিম্যাচে একটানা ৫টি ম্যাচে জেতে ভারতীয় মহিলা দল, তার মধ্যে ৩টি গুরুত্বপূর্ণ গোল করেন এই উইঙ্গার। একইসঙ্গে ইন্ডিয়ান উইমেন্স লিগে গত বছর ‘ইমার্জিং প্লেয়ার’-এর খেতাব জেতেন ডাংমেই। ‘সৌভাগ্যবশত মণিপুরের গ্রামে প্রত্যেকেই মহিলা ফুটবলকে উৎসাহ দেয়। তাদের কারণেই আমি আজ এখানে পৌছতে পেরেছি’, বলেন হংকং-এর বিরুদ্ধে ৫-২ গোলে জেতা ম্যাচে জোড়া গোল করা ফুটবলার।

ডালিমা ছিবের

ডালিয়া ছিবের এবং জবামণি টুডু

দিল্লির ২১ বছর বয়সী ফুটবলার ডালিমা ছিবের রাইট ব্যাক, সেন্টার ব্যাক ও সেন্টার মিডফিল্ডে দক্ষতার সঙ্গে খেলতে পারেন। দিল্লি ডায়নামোসের এই ফ্যান জন্মেছেন এক ফুটবল পাগল পরিবারে। তার ছোটবেলায় বাবার কাছেই তার ফুটবল শুরু। এরপর ইন্ডিয়া রাস সকার ক্লাব ও এফসি পুণে সিটির হয়ে ইন্ডিয়ান উইমেন্স লিগে খেলেন। ভারতীয় জাতীয় দলের জার্সি গায়ে তোলার আগে অনূর্ধ্ব-১৪, অনূর্ধ্ব-১৬ ও অনূর্ধ্ব-১৯ দলের প্রতিনিধিত্ব করেন ডালিমা। ভারতের মহিলা ক্রীড়াক্ষেত্রে পরিকাঠামোর উন্নতির পক্ষে সাওয়াল করেন ডালিমা। ‘আমাদের দেশে ফুটবল ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হলেও ক্রিকেট দমিয়ে রেখেছে। এখন কমপক্ষে পুরুষদের ফুটবল স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু মহিলাদের ফুটবলের ক্ষেত্রে চিত্রটা অন্যরকম এবং তা পুরুষদের মতো জনপ্রিয় হতে সময় লাগবে। আমার আশা ভারতে আরও বেশি সংখ্যায় মহিলারা ফুটবলকে পেশা হিসেবে নিয়ে প্রতিষ্ঠা পাবে’, জানান ডালিমা।

জবামনি টুডু

চনমনে জবামণি টুডু

ওড়িশার ১৮ বছর বয়সী জবামনি ইতিমধ্যেই জাতীয় দলের প্রথম একাদশে জায়গা পাকা করে ফেলেছে। একইসঙ্গে জুনিয়র ফুটবলার হয়েও জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব করেছেন। ছোটবেলায় জবামনির বাবা-মা জবামনির ফুটবল খেলা পছন্দ করতেন না। তবে সুযোগ পেলেই পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে চুটিয়ে ফুটবল পেটাতে শুরু করতেন জবামনি। তবে রাজ্যের আবাসিক দলে জবামনি নির্বাচিত হওয়ার পর বাবা-মার মতো বদলায়। মাত্র ১৬ বছর বয়সে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে তোলেন জবামনি আর তারপর থেকেই দলের অন্যতম সদস্য হয়ে যান এই ওড়িশার ফুটবলার। তার দক্ষতা ও বৈচিত্রের জন্য রাজ্য দলে ফরওয়ার্ডে ও জাতীয় দলে লেফট ব্যাকে খেলেন জবামনি। তার প্রতিভার কারণে ইন্ডিয়ান উইমেন্স লিগ ২০১৭-এ ‘ইমার্জিং প্লেয়ার’-এর খেতাব জেতেন জবামনি এবং গত বছর রাইসিং ফুটবল ক্লাবের হয়ে খেতাব জেতেন।

তিরঙ্গা নিয়ে ভারতীয় মহিলা দল

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের পতাকা তুলে ধরেছে ভারতের মহিলা ফুটবল দল। একইসঙ্গে ক্রীড়াক্ষেত্রে ভারতের মহিলাদের সম্ভাবনার চিত্রটা পরিষ্কার করে দিয়েছেন জবামনি, ইন্দুমতি, সঞ্জুরা। ভারতের ক্রীড়াক্ষেত্রে মহিলাদের প্রতিষ্ঠার পাহাড়-প্রমাণ লড়াইয়ে নাম লিখিয়ে সবরকমের সামাজিক চ্যালেঞ্জ, পরিকাঠামোর সমস্যাকে তুচ্ছ করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। আর ওদের জন্য মানে আমাদের ভারতের মহিলা প্রতিভাদের জন্যই আমাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে, উৎসাহ দিতে হবে ওদের। আশা একটাই, এই সব সফল, প্রতিশ্রুতিমানদের লড়াই আর সাফল্যের গল্প অনুপ্রেরণা জাগাবে আরও অনেক প্রতিভাবানদের মনে। এভাবেই ওদের খেলা দেখে, ওদের উৎসাহে গলা ফাটিয়ে আপনিও এই পরিবর্তনের আন্দোলনে নাম লেখাতে পারেন, অবদান রাখতে পারেন সমাজের পুরনো ধারনা ভেঙ্গে মহিলাদের বিশাল উচ্চতায় তুলে ধরে, নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত করে নতুন ভারত গড়তে।