দেশের জার্সি গায়ে শতাধিক ম্যাচ খেলেছেন তিনি। দেশের ফুটবলকে দিয়েছেন অনেক কিছু। তাঁর পারফরম্যান্সের জন্য অনেকে তাঁকে ‘ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাস্টিক’ বলেও ডেকে থাকেন। ফুটবলপ্রেমীরা যেমন সুনীল ছেত্রীকে ভারতীয় ফুটবলের সেরা তারকার আসনে বসিয়েছেন, তেমনই তাঁর সতীর্থরা ফরোয়ার্ডরাও এই ব্যাপারে একমত। ভক্তরা তাঁকে বাইরে থেকে দেখে সেরার আসনে বসিয়েছেন। কিন্তু যাঁরা তাঁকে একেবারে কাছ থেকে দেখেছেন, সেই বাইচুং ভুটিয়া, বলওয়ন্ত সিং, জেজে লালপেখলুয়া, রবিন সিং ফারুখ চৌধুরি, মনবীর সিং-রা কী বলছেন, সেটাও শোনা দরকার। ৩৫ বছর বয়সি ছেত্রীর ১৪ বছরেরও বেশি ফুটবল জীবনে প্রজন্ম পাল্টেছে। তিনি একসময় যাঁদের নেতৃত্বে খেলতেন, পরে তাঁদেরই নেতৃত্ব দিয়েছেন। যাঁকে পাশে নিয়ে ভারতীয় দলে প্রথম খেলা শুরু করেন ছেত্রী, সেই বাইচুং ভুটিয়ার বয়স এখন ৪২। আর এখন যাঁকে পাশে নিয়ে ভারতীয় দলে খেলছেন তিনি, সেই ফারুখ চৌধুরির বয়স ২৩। মাস ছয়েক পরেই ফুটবলজীবনের ১৫ বছর পূর্ণ করবেন ছেত্রী। তার আগে জেনে নেওয়া যাক তাঁর সম্পর্কে কী বলছেন তাঁর সতীর্থ ফরোয়ার্ডরা। মানুষ ছেত্রী, ফুটবলার ছেত্রী— জেনে নেওয়া যাক তাঁর দুই সত্ত্বার কথাই।

বাইচুং ভুটিয়া

সুনীল ছেত্রীর যো্গ্য পূর্বসূরী বলাই যায় তাঁকে। তাঁর সময়ে বাইচুংই ছিলেন দেশের সেরা ও সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবলার। পরে যখন ছেত্রীর যুগ শুরু হয়, তখন তিনিই বাইচুংয়ের জায়গাটা নিয়ে নেন। ২০০৫ থেকে ২০১১— এই ছ’বছর ভারতীয় দলের আক্রমণ বিভাগে একসঙ্গে খেলেন দু’জন। এই ছ’বছরেই নিজেকে বাইচুংয়ের যোগ্য উত্তরসূরী করে তোলার দিকে বেশ কিছুটা এগিয়ে যান ছেত্রী।

ভারতীয় দলে জায়গা করে নেওয়ার সময় থেকেই যে ছেত্রীকে পরখ করে তাঁকে বুঝে গিয়েছিলেন বাইচুং, সে কথাই জানিয়ে বলেন, “আমি যে ক’জন ফরোয়ার্ডকে পাশে নিয়ে খেলেছি, তাদের মধ্যে ছেত্রীই সেরা। আমাদের মধ্যে বোঝাপড়াটা ছিল বেশ স্বাভাবিক। ওর সঙ্গে খেলার অভিজ্ঞতাও যথেষ্ট ভাল ছিল। কয়েক বছরে ও নিজেকে অনেক উন্নত ও পরিণতও করে তুলেছে। ওর মতো পেশাদারও আমি খুব কম দেখেছি। নিজের শরীর ও ফিটনেসের দিকেও ও খুব যত্নবান”।

রবিন সিং

সুনীল ছেত্রীর ভাল বন্ধু এই ফরোয়ার্ড তাঁর সঙ্গে শুধু জাতীয় দলে নয়, ক্লাব দলেও খেলেছেন। বেঙ্গালুরু এফসি দলে একসঙ্গে খেলেছেন। সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে রবিন বলেছেন, “সুনীল সবসময়ই নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করে। সে ক্লাব বা দেশ, যাদের হয়েই খেলুক। ওর সঙ্গে খেলার অভিজ্ঞতা যথেষ্ট ভাল। আমরা দুজনে একসঙ্গে বেশ ধারালো হয়ে উঠেছিলাম। নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়াও বেশ ভাল আমাদের। আসলে আমরা পরষ্পরকে বুঝি বলেই আরও সুবিধা হয়েছে। আশা করি ভবিষ্যতে যখন ফের আমরা একসঙ্গে মাঠে নামব, তখন একই রকম খেলব।” ছেত্রীর সবচেয়ে বড় গুন নিয়ে তিনি বলেন, “খেলাটাকে ও এতটাই ভালবাসে যে ফুটবলের জন্য ও সব করতে পারে। অনেকগুলো গুন আছে ওর মধ্যে। যে গুলো একসঙ্গে করলে তবেই সুনীল ছেত্রীর মতো ফুটবলার পাওয়া যায়”।

জে জে লালপেখলুয়া

তাঁর অভিষেকের পর থেকে জেজে ও ছেত্রী একসঙ্গে বহু ম্যাচ খেলেছেন। ছেত্রীর সঙ্গে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন মিজোরামের এই তারকা ফুটবলারই। সুনীল ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর প্রথম মাঠে নামার অভিজ্ঞতা নিয়ে জেজে বলেছেন, “২০১২-য় প্রথম ভারতের হয়ে থেলি আমি। সঙ্গে পাই সুনীল ভাইকে। ওটাই বোধহয় ভারত অধিনায়ক হিসেবে ওর প্রথম ম্যাচ। এএফসি কাপের বাছাই পর্বের ম্যাচ ছিল সম্ভবত। তখন থেকে আমাদের মধ্যে একটা দারুণ বোঝাপড়া তৈরি হয়। ভুল না হলে, ভারতের হয়ে আমার প্রথম গোলটাও ছিল সুনীল ভাইয়ের সাহায্যেই। মাঠে ও মাঠের বাইরে ওর কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। ওর সঙ্গে খেলাটা ভাগ্যের ব্যাপার। আশা করি ভবিষ্যতেও এটা থাকবে। ভারতীয় ফুটবলে ওর অবদান প্রচুর। আশা করি, ও আরও কয়েক বছর খেলবে।”

চেন্নাইন এফসি স্ট্রাইকার বলেন, “সুনীল ভাইয়ের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছে আমাদের মতো  উঠতি ফুটবলাররা। ওঁর সঙ্গে যারা খেলে, তাদের সঙ্গে ও বন্ধুর মতো মেশে। ও সব সময় চেষ্টা করে যাতে অন্যদেরও উন্নতি হয়। ক্লাব ও জুনিয়র স্তরের চেয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অনেক কঠিন। সুনীল ভাই ওর নিজের অভিজ্ঞতা আমাদের সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করে। সবসময়ই আমাদের পরামর্শ দেয়। সবসময়ই ওর সঙ্গে অন্যদের কথাবার্তা হতে থাকে। শুধু খেলার ব্যাপারে নয়, কী খাব, কী খাব না, কোথায় কেমন আচরণ  করা উচিত, সে সব নিয়েও পরামর্শ দেয় সুনীলভাই”।

মনবীর সিং

ভারতীয় ফুটবলের নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি ২৪ বছর বয়সি এই স্ট্রাইকার। তাঁর কথায় সুনীল ছেত্রীর সঙ্গে খেলার অভিজ্ঞতাই তাঁকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। তাঁর মতে, “সুনীল ছেত্রী আমাদের কাছে অনেকটা মেন্টরের মতো। প্রতি মুহূর্তে ও আমাদের গাইড করে। ডায়েট থেকে খেলা, সব কিছু নিয়েই ওর পরামর্শ পাই আমরা। কোনও সমস্যা হলেই ওর সঙ্গে যোগাযোগ করি আমরা”।

ফারুখ চৌধুরি

মনবীরে মতো ফারুখও এখন ভারতীয় ফুটবল দলের নতুন তারকা। জামশেদপুর এফসি-র এই তরুণ ফরোয়ার্ডের কাছে সুনীল ছেত্রীর মতো তারকার সঙ্গে আন্তর্জাতিক ফুটবল জীবন শুরু করার অভিজ্ঞতা একেবারে স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতো। ফারুখ বলেন, “জাতীয় দলে যখন ছিলাম না, তখন স্বপ্ন দেখতাম, সুনীল ভাইয়ের সঙ্গে ভারতীয় দলের হয়ে মাঠে নামছি। ও একজন কিংবদন্তি। দেশের জন্য প্রচুর গোল করেছে। ওর পাশে খেলাটা যথেষ্ট সম্মানের।”

অন্যদের মতো ফারুখও বলেন, “সুনীল ভাইয়ের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখা যায়। যখনই দরকার পড়ে আমাদের, তখনই ওর কাছে ছুটে যাই আর সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় সুনীল ভাই। আমি ওর কাছ থেকে সবচেয়ে ভাল যেটা শিখেছি, তা হল, সব সময় ফোকাস বজায় রাখো। আমাদের মতো তরুণদের ওর কাছ থেকে সব সময় শেখা উচিত”।

সুনীল ছেত্রী

তবে ছেত্রীর প্রশংসাতেই যে সবাই পঞ্চমুখ, তা কিন্তু নয়। ছেত্রীও কম প্রশংসা করেননি তাঁর সতীর্থদের। বলেন, “দেশের হয়ে এত দিন ধরে খেলাই যথেষ্ট সম্মানের। এই ব্যাপারে আমি সত্যিই ভাগ্যবান বলতে পারেন। এই কয়েক বছরে বেশ কয়েকজন ফরোয়ার্ডের সঙ্গে খেলেছি আমি। এই ব্যাপারটাও আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে এবং নিজেকে উন্নত করে তোলার ক্ষেত্রে সাহায্য করেছে। সঙ্গীর সঙ্গে বোঝাপড়াটা কী করে তৈরি করে নিতে হয়, সেটাই শিখেছি আমি। স্ট্রাইকারদের মধ্যে বোঝাপড়াটা ভীষণ জরুরি যে। এর ওপরেই সাফল্য ও ব্যর্থতা নির্ভর করে অনেকটা।”

কী ভাবে তাঁর সতীর্থরা তাঁকে নানা ভাবে সাহায্য করেছেন, সেই প্রসঙ্গে ছেত্রী বলেন, “যখন প্রথম ভারতীয় দলের হয়ে খেলা শুরু করি আমি, তখন বাইচুংদা আমাকে নানা ভাবে সাহায্য করত। আমার ওপর থেকে ও চাপ অনেক কমিয়ে দিত। সেই শিক্ষা থেকেই আমি আমার জুনিয়রদেরও সাহায্য করার চেষ্টা করি সবসময়। যাতে ছেলেরা স্বাধীন ভাবে খেলতে পারে ও নিজেদের সেরাটা মাঠে দিতে পারে”।

সবচেয়ে প্রিয় সতীর্থ ফরোয়ার্ড কে, এই প্রশ্ন করলে ছেত্রী বলেন, “এটা বোধহয় বলা ঠিক হবে না। তবে প্রশ্নটা বেশ কঠিনও। অনেকের সঙ্গেই আমি খেলেছি। বাইচুং-এর সঙ্গে বহু দিন খেলেছি। ওর সঙ্গে খেলাটা সব সময়ই স্পেশাল ব্যাপার ছিল। ও আমার রোল মডেল ছিল। আমার সঙ্গে জেজে-র কম্বিনেশনটাও ভাল। আমরা একে অপরকে যথেষ্ট ভাল বুঝি। তাই নিজেদের জুগলবন্দিটা উপভোগও করি।” তাঁর পরে কে? এই প্রশ্নে সুনীল আশাবাদী, “অনেকেই আছে। সিনিয়র থেকে অনূর্ধ্ব ১৬ পর্যন্ত, সব দলেই ভাল ভাল স্ট্রাইকার আছে। তারাই ভারতীয় ফুটবলের ভবিষ্যৎ। এখন তাদের অপেক্ষাতেই থাকতে হবে আমাদের”।