অবশেষে এসে গেল ফয়সালার সেই ম্যাচ, যার শেষে ঠিক হয়ে যাবে হিরো আইএসএল ২০১৯-২০-র সেরা দল কারা। আর শনিবার সন্ধ্যায় ফতোরদার জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে এই খেতাবী লড়াইয়ে মুখোমুখি হতে চলেছে লিগের দুই সেরা দল এটিকে এফসি এবং চেন্নাইন এফসি।

দুই দলই দু’বার করে আইএসএল চ্যাম্পিয়ন হয়ে গিয়েছে এবং কী আশ্চর্য মিল, দুই দলই এক বছর অন্তর সেরার শিরোপা নিয়ে ঘরে ফিরেছে। প্রথম ও তৃতীয় বার জেতে এটিকে এবং দ্বিতীয় ও চতুর্থবার জেতে চেন্নাইন এফসি। মাঝে শুধু পঞ্চমবার বেঙ্গালুরু এফসি দুই দলের আধিপত্য খর্ব করে। কিন্তু আইএসএল ৬-এ ফের সেই দুই দলের মধ্যেই একদল জিতে নিয়ে যাবে ভারতের এক নম্বর লিগের বিজয়ীর তকমা। যা সৃষ্টি করবে এক নতুন মাইলস্টোন। হিরো আইএসএলের দলীয় সাফল্যকে যা এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।

দাপুটে প্রত্যাবর্তন

গত দুই মরশুমে যে জায়গায় থেকে শেষ করেছিল এটিকে এফসি, তা সমর্থকদের পক্ষে মেনে নেওয়া বেশ কষ্টকর ছিল। ফলে হিরো আইএসএলের কলকাতার দলটার জনপ্রিয়তা তলানিতে এসে ঠেকে। এ বার তাই মরশুম শুরুর আগে এটিকে ম্যানেজমেন্ট নড়েচড়ে বসে। আন্তোনিও লোপেজ হাবাসকে ফের কোচের পদে ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে শুরু হয় তাদের সাফল্যের রাস্তায় ফেরার প্রক্রিয়া। যিনি একবার চ্যাম্পিয়ন ও আর একবার রানার্সের খেতাব এনে দিয়েছিলেন কলকাতার দলকে।সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ করানো হয় এক ঝাঁক ভাল বিদেশী ফুটবলার ও তরুণ ভারতীয়কেও। যাঁদের সঠিক মিশ্রণে হাবাস তৈরি করে তুলেছেন এক শক্তিশালী ফুটবল-বাহিনী, যাকে এ বারে সমীহ করতে বাধ্য হয়েছে প্রতিটি দল।

যদিও শুরুটা একেবারেই ভাল হয়নি তাদের। কোচিতে প্রথম ম্যাচেই হেরে মাঠ ছাড়তে হয় তাদের। এক গোলে এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও এই হার এটিকে সমর্থকদের মনে ফের আশঙ্কা জাগায়, ব্যর্থতার কালো ছায়া এখনও অনুসরণ করে বেড়াচ্ছে হয়তো তাদের। কিন্তু সেই আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে হিরো আইএসএলে নবাগত দল হায়দ্রাবাদ এফসি-কে ৫-০ গোলে ধরাশায়ী করে হাবাস-বাহিনী বুঝিয়ে দেয়, তারা এ বার সাফল্যের রাস্তায় হাঁটতেই নেমেছে।

এর পরের পাঁচটি ম্যাচ থেকে ১১ পয়েন্ট অর্জন করে নিজেদের এই দাবিকে আরও প্রতিষ্ঠিত করে তোলেন রয় কৃষ্ণা, ডেভিড উইলিয়ামসরা। তিনটি জয় ও দু’টি ড্রয়েই তাঁরা বুঝিয়ে দেন হার না মানার মনোভাব নিয়েই এ বারের আইএসএলে এগিয়ে যেতে এসেছেন। টানা ছ’ম্যাচে অপরাজিত থাকার পরে গোয়ার মাঠে অবশ্য ১-২ হারতে হয় এটিকে এফসি-কে। ঘরের মাঠে হায়দ্রাবাদের বিরুদ্ধে একেবারে শেষ মুহূর্তের গোলে ড্র করে তারা। কিন্তু তাতেও দমানো যায়নি কলকাতার তারকাদের। বছরের শেষ ম্যাচে বড়দিনের রাতে ঘরের মাঠে গতবারের চ্যাম্পিয়ন বেঙ্গালুরু এফসি-কে ১-০ গোলে হারিয়ে দিয়ে ফের মাথা তুলে দাঁড়ান প্রীতম কোটাল, প্রবীর দাসরা।

নতুন বছরে মুম্বই সিটি এফসি এবং এফসি গোয়াকেও হারান হাবাসের দলের ছেলেরা। লিগের দুই ম্যাচ বাকি থাকতেই সেরা চারে নিজেদের জায়গা পাকা করে নেয় এটিকে এফসি। তাই শেষ দুই ম্যাচে সেই মরিয়া মনোভাব দেখা যায়নি তাদের মধ্যে। কয়েকজন খেলোয়াড় টানা খেলে ক্লান্তও ছিলেন। তাই শেষ দিকে তাঁদের অনেককে বিশ্রামও দেন হাবাস। কিন্তু একবারের জন্যও প্রথম চার থেকে ছিটকে যায়নি হাবাস-বাহিনী।

সেমিফাইনালের প্রথম লেগে ভাল খেলেও গত বারের চ্যাম্পিয়ন বেঙ্গালুরু এফসি-র কাছে ০-১ গোলে হারে তারা। কিন্তু ফিরতি লেগে ৩-১ গোলে তাদের হারিয়ে শুধু জবাব দেননি কলকাতার তারকারা, বেঙ্গালুরুকে ফাইনালে ওঠার দৌড় থেকে ছিটকে দিয়ে নিজেরাই সেখানে পৌঁছে যান।

অভাবনীয় উত্থান

এটিকে এফসি শুরু থেকেই রীতিমতো আধিপত্য বিস্তার করলেও চেন্নাইন এফসি-র গল্পটা একেবারে অন্যরকম। জন গ্রেগরির কাছ থেকে যখন কোচের দায়িত্ব নিয়ে আয়ারল্যান্ড থেকে ভারতে আসেন আওয়েন কোইল, তখন চেন্নাইন এফসি ছয় ম্যাচে পাঁচ পয়েন্ট নিয়ে দশ দলের লিগ তালিকায় ছিল ন’নম্বরে। ওখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে সেরা চারে থাকার স্বপ্ন তখন দলটার অতিবড় সমর্থকও হয়ত দেখার সাহস পাননি। কিন্তু কোইল শুধু স্বপ্ন দেখাননি, সেই স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করেছেন। কোইল দায়িত্ব নেওয়ার পরই দুই ম্যাচে চার পয়েন্ট পায় তার দল। পরের দুই ম্যাচে হার।

এর পর থেকেই শুরু হয়ে যায় নেরিজাস ভাল্সকিস, আন্দ্রে শেমব্রি, অনিরুদ্ধ থাপা, লুসিয়ান গোইয়ানদের স্বপ্নের দৌড়।  টানা আট ম্যাচে অপরাজিত থাকেন তাঁরা, ছটি জয় ও দু’টি ড্র। লালিয়ানজুয়ালা ছাংতে, রাফায়েল ক্রিভেলারো, এলি সাবিয়াদের রক্তে ও মস্তিষ্কে যে আগ্রাসী ফুটবলের নেশা প্রবেশ করিয়ে দিলেন ৫৩ বছর বয়সি কোইল, সেই নেশাই তাঁদের শেষ পর্যন্ত খেতাবী লড়াইয়ের সামনে এনে দাঁড়া করিয়েছে। প্রথম সেমিফাইনালে সারা লিগে আধিপত্য বজায় রেখে আসা লিগের সেরা এফসি গোয়াকে যে ভাবে অপদস্থ করে (৪-১) হারায় চেন্নাইন এফসি, তাকে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল অনেকের। কয়েক মাসের মধ্যে একটা দলের যে এতটা পরিবর্তন হতে পারে, তা সত্যিই ভাবা যায় না।

সেরাদের দ্বৈরথ

এ ভাবে এতটা পথ পেরিয়ে এসে দুই দলের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের উদ্দেশে মুখোমুখি হওয়াটা তাই যে কোনও ফুটবলপ্রেমীর কাছেই স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারে। হাই-ভোল্টেজ ম্যাচ বলতে যায় বোঝায়, শনিবার সম্ভবত তেমনই হতে চলেছে হিরো আইএসএল ফাইনালে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, এমন একটা উত্তেজনার বারুদে ঠাসা ম্যাচ দেখতে গ্যালারিতে দেখা যাবে না একটিও মানুষকে। করোনার আতঙ্কের জেরেই এমন সিদ্ধান্ত। তবে ম্যাচটা দেখার জন্য টিভির সামনে অবশ্যই বসবেন লক্ষ লক্ষ ফুটবলপ্রেমী।

কোইল দায়িত্ব নেওয়ার পরে এ পর্যন্ত ১৪টি ম্যাচে ৩৪ গোল করেছে যে দলটি সেই চেন্নাইনের আক্রমণের ঝড় কী ভাবে থামাবে এটিকে-র শক্তিশালী ডিফেন্স, এটা যেমন একটা বড় প্রশ্ন, তেমনই দেখার বিষয় হল এটিকে-র কাউন্টার অ্যাটাক আটকাবে কী করে দক্ষিণী রক্ষণ, যারা ২০ ম্যাচে ২৯টি গোল খেয়েছে।

এটিকে এফসি-রও ২০ ম্যাচে ৩৬ গোল। কিন্তু তারা খেয়েছে ১৮টি গোল। শুধু যে তাদের রক্ষণ বিভাগ শক্তিশালী, তা নয়, প্রয়োজনে রয় কৃষ্ণা, ডেভিড উইলিয়ামসকেও নীচে নেমে ডিফেন্স করতে দেখা গিয়েছে বহু ম্যাচে। বেশির ভাগ ম্যাচেই ৪-৩-৩ ছকে খেলে এসেছে চেন্নাইন। যার আক্রমণভাগে মূলত থাকেন ভাল্সকিস ও তাঁর দু’পাশে ছাংতে ও শেমব্রি। তাঁদের পিছনে থাকা ১০ নম্বর জার্সির রাফায়েল ক্রিভেলারোকে নজরে না রাখলে যে কোনও সময়ে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারেন তিনি। আরও একজনকে নজরে রাখতেই হবে, তিনি অনিরুদ্ধ থাপা। উইং দিয়ে ক্ষিপ্র গতিতে উঠে স্ট্রাইকারদের গোল তৈরি করে দিতে তিনি পারদর্শী।

লুসিয়ান গোইন ও এলি সাবিয়া এ পর্যন্ত সেন্টার ব্যাক হিসেবে খেলে এসেছেন। ফুলব্যাক জেরি লালরিয়ানজুয়ালা ও লালদিনলিয়ানা রেন্থলেই তাদের সঙ্গ দিয়ে বিপক্ষের আক্রমণ আটকানোর ভূমিকা পালন করেন। এই একটা জায়গাতেই চেন্নাইন কিছুটা হলেও পিছিয়ে রয়েছে এটিকে-র চেয়ে, যাদের রক্ষণ ভাগ বেশ শক্তিশালী। প্রীতম কোটাল শুরু থেকেই কঠিন স্তম্ভ। তার সঙ্গে সুমিত রাঠির মতো তরুণের উত্থান কলকাতার জিফেন্সকে আরও চাঙ্গা করেছে। ফেব্রুয়ারিতে অগাস্টিন গার্সিয়ার দেশে ফিরে যাওয়া তাদের কিছুটা চাপে ফেলে দেয়। কারণ, রক্ষণকে বুক দিয়ে আগলে রাখতেন গার্সিয়া। তাঁর পরিবর্ত জন জনসন শুরুটা ভাল করলেও ধারাবাহিকতার অভাব রয়েছে তাঁর পারফরম্যান্সে।

মাঝমাঠ ও আক্রমণই এটিকে-র সবেচেয়ে বড় শক্তি। হাভিয়ে হার্নান্ডেজ যে ভাবে মাঝমাঠ ও আক্রমণের মধ্যে সেতু হিসেবে কাজ করেন, তা অনবদ্য। পাঁচটি গোল করতে সাহায্য করেছেন তিনি। আবার প্রয়োজনে ব্যাকলাইনকেও বাড়তি শক্তি জোগান তিনি। দুই উইংব্যাক প্রবীর দাস ও মাইকেল সুসাইরাজের কথা নতুন করে বলার নেই। দুই উইং দিয়ে দ্রুত আক্রমণে উঠে বিপক্ষের ডিফেন্সে বহুবার চিড় ধরিয়েছেন তাঁরা, গোলমুখ খুলতে সাহায্য করেছেন স্ট্রাইকারদের, বিপজ্জনক সেন্টার ও ক্রস দিয়ে গোল সাজিয়ে দিয়েছেন। এই দু’জনও চিন্তায় রাখবে বিপক্ষকে। যেমন চিন্তায় রাখবেন তৃতীয় ফরোয়ার্ড এডু গার্সিয়া। যে কোনও সময় বিপক্ষের বক্সে ঢুকে বিপদ ঘটাতে পারেন যিনি। আর গোলকিপার অরিন্দম ভট্টাচার্যের অবধারিত গোল বাঁচানোর সংখ্যাও মনে রাখার মতো। সেভের সংখ্যার (৪৮) দিক থেকে তিনি এখন শুভাশিস রায় (৫৫) ও গুরপ্রীত সিং সান্ধুর (৪৯) পরেই। তাঁকে বোকা বানিয়ে গোল করাটাও ভাল্সকিসদের পক্ষে সোজা হবে না।

দ্বৈরথের ইতিহাস

এ পর্যন্ত ১৪টি ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছে দুই দল। ৬ বার জিতেছে এটিকে ও ৪ বার চেন্নাইন। ড্র হয়েছে ৪ বার। তবে একে অপরের বিরুদ্ধে গোলের সংখ্যায় সামান্য হলেও এগিয়ে চেন্নাইন, ২২-২১। ফতোরদায় আবার চেন্নাইনের রেকর্ড ভাল। ৯টি ম্যাচে চারটি জয় ও চারটি হার তাদের। সেখানে এটিকে এখানে সাতটি ম্যাচে ২টিতে জিতেছে ও ৩টিতে হেরেছে। সাত গোল দিয়ে খেয়েছে ১৩টি। চেন্নাইন এই মাঠে ১৭টি গোল করে খেয়েছেও ১৭টি। তাই পরিসংখ্যানেও সে ভাবে কাউকে এগিয়ে বা পিছিয়ে রাখা যাবে না। ফাইনাল তো এমন দুউ দলের মধ্যেই হওয়া উচিত। তাই বসে পড়ুন আজ সন্ধ্যায় টিভির সামনে ও পান ফুটবলের চরম আনন্দ।           

সম্ভাব্য এটিকে একাদশ : অরিন্দম (গোল), প্রীতম, জনসন, সুমিত, প্রবীর, সুসাইরাজ, হার্নান্ডেজ, রানে, রেজিন, গার্সিয়া,  উইলিয়ামস ও কৃষ্ণা।

সম্ভাব্য চেন্নাইন একাদশ : বিশাল কয়েথ (গোল), জেরি, গোইয়ান, সাবিয়া, রান্থলেই, থাপা, ভান্সপল, ছাংতে, ক্রিভেলারো, শেমব্রি, ভাল্সকিস।

হিরো আইএসএল ফাইনাল- এটিকে এফসি বনাম চেন্নাইন এফসি- ১৪ মার্চ, শনিবার, সন্ধ্যা ৭.৩০ থেকে স্টার স্পোর্টস নেটওয়ার্ক, হটস্টার ও জিও টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার।