উজ্জীবিত লড়াই করে বেঙ্গালুরু এফসি-কে তাদের মাঠে কড়া চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে জয় ছিনিয়ে নিল ইস্টবেঙ্গল এফসি। শুক্রবার কলকাতা থেকে প্রায় ১৮০০ কিলোমিটার দূরে শ্রী কান্তিরাভা স্টেডিয়ামে ক্লেটন সিলভার একমাত্র গোলে জিতে তিন পয়েন্ট অর্জন করল লাল-হলুদ ব্রিগেড। ষষ্ঠ ম্যাচে দ্বিতীয় জয় পেল তারা। গত দুটি ম্যাচে হারার পরে এই জয় এল তাদের।

লিগ টেবলের একেবারে নীচের দিকে থাকা ইস্টবেঙ্গল এফসি-র কাছে শুক্রবারের এই ম্যাচটি ছিল টিকে থাকার লড়াই, যেখান থেকে তিন পয়েন্ট পাওয়া তাদের কাছে ছিল খুবই জরুরি। তাই শুরু থেকেই আগ্রাসী ফুটবল খেলেন ক্লেটন সিলভা, নাওরেম মহেশ, চ্যারিস কিরিয়াকু, সেম্বয় হাওকিপরা। কিন্তু মাঝমাঠে জর্ডন ও’ডোহার্টি ও আক্রমণে ভিপি সুহের প্রত্যাশিত ফর্মে না থাকায় ৬৮ মিনিট পর্যন্ত উদ্দেশ্য সফল হয়নি তাঁদের। কিন্তু তার পরে ২৩ বছর বয়সি নাওরেম মহেশ একক দক্ষতায় যে ভাবে মাঝমাঠ থেকে বল নিয়ে বিপক্ষের বক্সে ঢুকে ক্লেটন সিলভাকে প্রায় গোল সাজিয়ে দেন, তা অনেক দিন মনে রাখার মতো।

সুনীল ছেত্রী, রয় কৃষ্ণা, উদান্ত সিং, হাভিয়ে হার্নান্ডেজদের আটকে এই জয়ের ফলে ইস্টবেঙ্গল ছয় ম্যাচে ছয় পয়েন্ট পেয়ে লিগ তালিকায় আট নম্বরে উঠে এল। টানা তিন ম্যাচে হেরে বেঙ্গালুরু এফসি নেমে গেল নয় নম্বরে।     

এ দিন শুরু থেকেই আক্রমণ ও প্রতি আক্রমণে জমে ওঠে দুই দলের দ্বৈরথ। দুই দলই যে জয়ে ফেরার জন্য মরিয়া, তা তারা শুরু থেকেই বুঝিয়ে দেয়। এক দিকে রয় কৃষ্ণা ও সুনীল ছেত্রী, অন্য দিকে, ক্লেটন সিলভা ও ভিপি সুহের নিজেদের দলের আক্রমণের দায়িত্বে থাকলেও তাঁরা কিন্তু কোনও সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করতে পারেননি। প্রথম ১৫ মিনিট দুই গোলকিপারকেও সে ভাবে কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে হয়নি।

তবে ১৬ মিনিটের মাথায় হাভিয়ে হার্নান্ডেজের ফরোয়ার্ড পাস নিয়ে বিপক্ষের বক্সে ঢুকে পড়েন সুনীল ছেত্রী। কিন্তু সার্থক গলুইয়ের জায়গায় প্রথম এগারোয় নামা অঙ্কিত মুখার্জির অসাধারণ ট্যাকলে সে যাত্রা বেঁচে যায় ইস্টবেঙ্গল এফসি। গোললাইন থেকে এগিয়ে আসেন কমলজিৎও। এর চার মিনিট আগে চ্যারিস কিরিয়াকুর দূরপাল্লার শট রুখে দেন বেঙ্গালুরুর অভিজ্ঞ গোলরক্ষক গুরপ্রীত সিং সান্ধু।

এই ম্যাচেও লাল-হলুদের স্প্যানিশ ডিফেন্ডার ইভান গঞ্জালেজকে সুবিধাজনক জায়গায় প্রতিপক্ষকে অযথা কিছু ফ্রি কিক দিতে দেখা যায়। যদিও ম্যাচের বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনিও নিজেকে ক্রমশ শুধরে নেন। ২৪ মিনিটের মাথায় বক্সের সামনে এমনই এক ফ্রি কিক থেকে হার্নান্ডেজ সোজে গোলে শট নিলেও তা বারের কয়েক ইঞ্চি ওপর দিয়ে উড়ে যায়। মাঝমাঠ থেকে আক্রমণ তৈরি করার ক্ষেত্রে এ দিন হাভিকে বেশ তৎপর হতে দেখা যায়। তবে তাঁর জন্য পাহাড়া রেখেছিল ইস্টবেঙ্গল। সুনীল ছেত্রী, রয় কৃষ্ণাকেও পাহাড়ায় রাখে তারা।

রয়কে এ দিন প্রথমার্ধে বিপক্ষের পেনাল্টি এরিয়ায় যত না দেখা যায়, তার চেয়ে বেশি মাঝমাঠে তাঁর বিচরণ ছিল বেশি। অথচ আক্রমণে সুনীল সে ভাবে তৎপরও ছিলেন না। ৩০ মিনিটের মাথায় রয় গোলের উদ্দেশ্যে প্রথম জোরালো শটটি নেন বক্সের বাইরে থেকে, যা বারের ওপর দিয়ে উড়ে যায়।

ইস্টবেঙ্গলের আক্রমণে বরাবরের মতো ক্লেটন সিলভার ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা দেখা যায় এই ম্যাচেও। বেঙ্গালুরুর ডিফেন্ডাররা সুহেরকে আটকাতে পারলেও প্রায়ই ক্লেটন তাঁর প্রাক্তন ক্লাবের পাহাড়া ভেঙে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন গোলের নেশায়। ৩০ মিনিটের মাথায় পেনাল্টি বক্সের মাথা থেকে ব্রাজিলীয় ফরোয়ার্ডের গোলমুখী শট বিপক্ষের এক খেলোয়াড়ের গায়ে লেগে পোস্টের বাইরে দিয়ে বেরিয়ে যায়।

বিরতির ঠিক আগেই হাওকিপের পা থেকে বল পেয়ে বিপক্ষের বক্সে ঢুকে পড়েন ক্লেটন। কিন্তু সন্দেশ ঝিঙ্গনের বুদ্ধিদীপ্ত ট্যাকল তাঁকে নিরস্ত করে। সুহের এ দিন দুই উইং দিয়ে ওঠার চেষ্টা করলেও তাঁকে বারবার বাধা দেন বিপক্ষের ডিফেন্ডাররা। যার জন্য একাধিকবার মেজাজ হারাতেও দেখা যাক কেরলের এই স্ট্রাইকারকে। ফলে খেলায় ঠিকমতো মনসংযোগও করতে পারছিলেন না তিনি। গোলহীন অবস্থাতেই বিরতিতে যায় দুই দল।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই ইস্টবেঙ্গলকে চাপে ফেলে দেয় বেঙ্গালুরু এফসি। রয় কৃষ্ণাকে তৎপর হয়ে উঠতে দেখা যায়। তবে তাঁকে কড়া মার্কিংয়ে রেখেছিলেন চ্যারিস কিরিয়াকু। যার ফলে গোলের চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হন কলকাতায় খেলে যাওয়া প্রাক্তন ফিজিয়ান তারকা। তবে কিছুক্ষণ পর থেকেই ইস্টবেঙ্গল এফসি ফের পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। এমনই এক আক্রমণ শুরুর সময় পিছন থেকে নাওরেম মহেশকে ধাক্কা দিয়ে হলুদ কার্ড দেখেন উদান্ত সিং। ওই মুভটি বিপজ্জনক হতে পারত।

দ্বিতীয়ার্ধের খেলা দশ মিনিট গড়ানোর পরে ব্রাজিলীয় মিডফিল্ডার অ্যালেক্স লিমা নামেন আহত জর্ডন ও’ডোহার্টির জায়গায়। তবে স্বাভাবিক ভাবেই সদ্য চোট সারিয়ে মাঠে নেমেই নজর কাড়তে পারেননি লিমা। ইস্টবেঙ্গল এফসি-র আগছালো খেলার সুযোগ নিয়ে ৬১ মিনিটের মাথায় কার্যত ওয়ান টু ওয়ান পরিস্থিতিতে গোলের সুযোগ পেয়ে যান রয় কৃষ্ণা। কিন্তু সাইড নেটে শট নেন তিনি।

দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম কুড়ি মিনিট সে ভাবে কোনও ভাল সুযোগ তৈরি করতে না পারলেও প্রথম যে সুবর্ণ সুযোগটি তৈরি করে তারা, তা থেকেই গোল পেয়ে যায় ইস্টবেঙ্গল এফসি। ৬৯ মিনিটে মাঝমাঠ থেকে বল নিয়ে বাঁ দিক দিয়ে একটা স্প্রিন্টে নাওরেম মহেশ পৌঁছে যান বক্সে। মাঝে বেঙ্গালুরুর মিডফিল্ডার সুরেশ তাঁর পা থেকে বল কাড়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। ফের সুরেশের পা থেকে বল ছিনিয়ে নিয়ে বক্সে ঢুকে ডান দিকে ক্লেটনকে গোলের বল সাজিয়ে দেন মহেশ এবং ছ’গজের বক্সের সামনে থেকে গোলে বল ঠেলতে কোনও ভুল করেননি ব্রাজিলীয় ফরোয়ার্ড (১-০)। গোলদাতার নাম ক্লেটন সিলভা হলেও এর বেশিরভাগ কৃতিত্ব প্রাপ্য মহেশেরই।

এই গোলের ছ’মিনিট পরে ফের মাঝমাঠ থেকে আক্রমণের ঝড় তোলেন গঞ্জালেজ ও কিরিয়াকু। কিন্তু কিরিয়াকু বক্সের বাঁ দিকে থাকা লিমাকে বল দিতে গেলে, তা ক্লিয়ার করে দেন বেঙ্গালুরুর বঙ্গতারকা প্রবীর দাস, যিনি এ দিন দ্বিতীয়ার্ধে পরিবর্ত হিসেবে নামেন। গোলের পর থেকেই ব্যবধান বাড়ানোর জন্য তেড়েফুঁড়ে ওঠে লাল-হলুদ বাহিনী। আগের ম্যাচগুলির ভুল শুধরে জয়ের গন্ধ পেয়ে তারা মানসিক ভাবেও চাঙ্গা হয়ে ওঠে। গ্যালারিতে থাকা লাল-হলুদ সমর্থকদের চিৎকারেও তখন মুখর হয়ে ওঠে গোটা স্টেডিয়াম। নিষ্প্রভ ভিপি সুহেরের জায়গায় হীমাংশু জাংরাকে নামানো হয় নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার সাত মিনিট আগে।

ম্যাচের একেবারে শেষ দিকে সমতা আনার সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যান রয় কৃষ্ণা, যখন বক্সের মধ্যে গোলের সামনে বল পেয়ে যান তিনি। কিন্তু তাঁর পা থেকে বল কেড়ে তা ক্লিয়ার করেন ইভান গঞ্জালেজ। বাড়তি ছ’মিনিটে রক্ষণে কার্যত দেওয়াল তুলে দেয় লাল-হলুদ শিবির। যা ভেদ করে গোল শোধ করা আর সম্ভব হয়নি সুনীল ছেত্রীদের পক্ষে।  

ইস্টবেঙ্গল দল: কমলজিৎ সিং (গোল), অঙ্কিত মুখার্জি, লালুচুঙনুঙ্গা, ইভান গঞ্জালেজ, জেরি লালরিনজুয়ালা, চ্যারিস কিরিয়াকু, জর্ডন ও’ডোহার্টি (অ্যালেক্স লিমা), নাওরেম মহেশ সিং, সেম্বয় হাওকিপ, ক্লেটন সিলভা (অধি), ভিপি সুহের (হীমাংশু জাংরা)।

পরিসংখ্যানে ম্যাচ         

বল পজেশন: বেঙ্গালুরু এফসি ৫৬% - ইস্টবেঙ্গল এফসি ৪৪% - সফল পাস: ২৭৭/৩৮৫ (৭২%) - ১৭৭/২৭২ (৬৫%), গোলে শট: ১-৪, ফাউল: ১১-১৩, সেভ: ৩-১, ইন্টারসেপশন: ২৩-১৭, কর্নার: ৮-৬, হলুদ কার্ড: ১-৩, ম্যাচের হিরো: ক্লেটন সিলভা।