ন’দিন আগেই জোড়া গোলে এগিয়েও চার গোল খাওয়ার হতাশায় ডুবে গিয়েছিল যারা, সেই ইস্টবেঙ্গল এফসি ইস্পাতনগরী থেকে তিন পয়েন্ট জিতে ঘরে ফিরছে। রবিবার রাতে জেআরডি টাটা স্পোর্টস কমপ্লেক্সে জামশেদপুর এফসি-কে ৩-১-এ হারিয়ে লিগ টেবলে দু’ধাপ উঠে এল কলকাতার দল।

আগের রাতেই অভাবনীয় হারের ধাক্কা সামলে উঠে যে ভাবে সাহসী পারফরম্যান্স দেখিয়েছিল কলকাতার আর এক দল এটিকে মোহনবাগান। তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আরও এক সাহসী পারফরম্যান্স দেখিয়ে জামশেদপুরের বিরুদ্ধে জয় তুলে নিল ইস্টবেঙ্গলও। বাংলার ফুটবলপ্রেমীদের কাছে এই সপ্তাহটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে হয়তো। পরপর দু’দিনে দু’টি অসাধারণ জয় কলকাতার দুই দল হিরো আইএসএলে এর আগে কখনও পেয়েছে বলে মনে পড়ে না।

রবিবার ইস্পাতনগরীর দলের বিরুদ্ধে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের দু’মিনিটের মধ্যেই ভিপি সুহেরের গোলে এগিয়ে যায় লাল-হলুদ শিবির। ২৬ মিনিটের মাথায় ব্যবধান বাড়ান ইস্টবেঙ্গলের ব্রাজিলীয় ফরোয়ার্ড ক্লেটন সিলভা। তৃতীয় গোলটিও তাঁরই, যা আসে ৫৮ মিনিটের মাথায়। বিরতির পাঁচ মিনিট আগে পেনাল্টি থেকে গোল শোধ করেন জে এমানুয়েল থমাস।

লাল-হলুদ ব্রিগেডের তিনটি গোলেই অর্ধেক কৃতিত্ব দলের তরুণ ফরোয়ার্ড নাওরেম মহেশ সিংয়ের, অ্যাসিস্টের হ্যাটট্রিকের নজির হিরো আইএসএলে আর কোনও ভারতীয় ফুটবলারের নেই। পাঁচ গোল করে চলতি লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতাদের তালিকার শীর্ষে উঠে এলেন ক্লেটন এবং তাঁর দল লিগ তালিকায় উঠে এল আট নম্বরে।       

দুই দলই এ দিন ৪-৪-২ ছকে খেলা শুরু করে। ফলে লড়াইটা ছিল সমানে সমানে। ইস্টবেঙ্গল এফসি আহত চ্যারিস কিরিয়াকুর জায়গায় নামায় অ্যালেক্স লিমাকে। জেরি লালরিনজুয়ালা চোট সারিয়ে এ দিন দলে ফিরে আসেন প্রীতম সিংয়ের জায়গায়। জামশেদপুর এফসি-র নাইজেরীয় ফরোয়ার্ড ড্যানিয়েল চিমা চুকুউ এই প্রথম তাঁর প্রাক্তন ক্লাব ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে এ দিন মাঠে নামেন। কিন্তু স্মরণীয় করে রাখতে পারলেন না এই ম্যাচ।

যে ভাবে খেলা শুরু করে ইস্টবেঙ্গল এফসি, তা হিরো আইএসএলে আজ পর্যন্ত কখনও করেনি তারা। দু’মিনিটের মধ্যেই বিপক্ষের জালে বল জড়িয়ে এগিয়ে যায় লাল-হলুদ বাহিনী। বক্সের বাঁ দিক থেকে নাওরেম মহেশের অসাধারণ মাপা ক্রসে নীচু হয়ে হেড করে গোল করেন কেরালার ফরোয়ার্ড ভিপি সুহের (১-০)। ঘটনার আকস্মিকতায় এতটাই দিশাহারা হয়ে গিয়েছিলেন জামশেদপুরের ডিফেন্ডাররা যে, সুহেরকে মার্ক করার কথা খেয়ালই ছিল না তাঁদের।

সম্বিৎ ফিরতেই পাল্টা আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন ইস্পাতনগরীর ফুটবলাররা। সমতা ফেরানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে তারা। পাঁচ মিনিটের মাথায় প্রতীক চৌধুরির গোলমুখী হেড অসাধারণ দক্ষতায় বাঁচান লাল-হলুদ গোলকিপার কমলজিৎ সিং। কুড়ি মিনিটের মাথায় বরিস সিংয়ের পাস থেকে গোলের সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যান জে এমানুয়েল থমাস বা ‘জেট’। কিন্তু তিনি বারের ওপর দিয়ে বল উড়িয়ে দেন। ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণও এ দিন ছিল যথেষ্ট তৎপর। এমানুয়েল, চিমা ও সয়্যারের ত্রিমুখী আক্রমণকে বারবার প্রতিহত করেন ইভান গঞ্জালেজরা।  

এক গোলে এগিয়ে যাওয়ার পরও পুরোপুরি রক্ষণাত্মক হয়ে যায়নি ইস্টবেঙ্গল। ব্যবধান বাড়ানোর চেষ্টা শুরু করে তারা। ১৩ মিনিটের মাথায় জর্ডন ও’ডোহার্টির কর্নার থেকে হেডে আর একটি গোল করেও দেন ক্লেটন সিলভা। কিন্তু সুহের অফসাইডে থাকায় সেই গোল বাতিল হয়ে যায়। তবে ব্যবধান বাড়ানোর জন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি তাদের। ২৬ মিনিটের মাথায় ক্লেটন সিলভার গোলে জয়ের দিকে আরও এগিয়ে যায় ইস্টবেঙ্গল।

প্রথম গোলের মতো এই গোলের ক্ষেত্রেও অর্ধেক কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন নাওরেম মহেশ। এ বারেও বাঁ দিকের উইং থেকে মাপা ও নিখুঁত ক্রস দেন তিনি। মাঝমাঠ থেকে প্রায় ৭০ মিটার দৌড়ে বক্সে ঢুকে পড়া ক্লেটন আলতো টোকায় জালে বল জড়িয়ে দেন (২-০)। এ বারও জামশেদপুরের তিন ডিফেন্ডার থাকা সত্ত্বেও তাঁকে কেউই মার্ক করেননি।

দু’গোলে পিছিয়ে যাওয়া জামশেদপুর আক্রমণে আরও চাপ বাড়াতে থাকে। ৩৩ মিনিটের মাথায় বক্সের মাথা থেকে যে বাইসাইকেল কিকটি নেন চিমা, তা সম্প্রতি বিশ্বকাপে ব্রাজিলের রিচার্লিসনের স্মরণীয় গোলের কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু কমলজিৎ অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় সেই শট বাঁচান।

চিমার এই দুর্দান্ত শট বিফলে যাওয়ার তিন মিনিট পরেই জামশেদপুরকে গোল শোধ করার সুযোগ এনে দেন রেফারি ক্রিস্টাল জন। ইস্টবেঙ্গলের বক্সের মধ্যে উড়ে আসা বল লাফিয়ে রিসিভ করতে গিয়ে বাধা পান হ্যারি সয়্যার। চুঙনুঙ্গার কনুই তাঁর মুখে লাগে। সম্ভবত সেই কারণেই পেনাল্টি পায় জামশেদপুর এফসি। লাল-হলুদ শিবিরের খেলোয়াড়রা তীব্র প্রতিবাদ করলেও তাতে কর্ণপাত করেননি রেফারি। বরং তর্কাতর্কির জন্য হলুদ কার্ড দেখান সুহেরকে। পেনাল্টি থেকে গোল করেন ‘জেট’ (২-১)।

এই গোলের তিন মিনিট পরেই, ৪৩ মিনিটের মাথায় ফের গোলের সুবর্ণ সুযোগ পান সয়্যার। বরিসের ক্রস থেকে গোলের সুযোগ পান তিনি। কিন্তু গোলের বাইরে মারেন তিনি। অতিরিক্ত ছ’মিনিটের মধ্যে ইস্টবেঙ্গলের সেম্বয় হাওকিপ ও জামশেদপুরের পিটার হার্টলে সুযোগ পেয়েও তা কাজে লাগাতে পারেননি।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই ফের দুই দলের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই দেখা যায় এবং দুই দলই গোলের সুযোগ তৈরিও করে নেয়। ৫২ মিনিটে লিমা গোলের সুযোগ পেয়েও তা বাইরে মারেন। ৫৭ মিনিটের মাথায় চিমার মাপা ক্রস পেয়ে জেট গোলে হেড করলেও তা কমলজিতের হাতে জমা হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত সাফল্য পায় লাল-হলুদ শিবির। কারণ, তাঁদের নাওরেম মহেশ ও ক্লেটন সিলভা রয়েছেন। তাঁদেরই জুগলবন্দিতে আসে লাল-হলুদের তৃতীয় গোলটিও।

মাঝমাঠ থেকে সুহের বল বাড়ান বাঁদিকের উইংয়ে থাকা মহেশকে। তিনি বক্সে ঢুকে গোলের বল সাজিয়ে দেন ক্লেটনকে। পিটার হার্টলে তাঁকে বাধা দেওয়ার মরিয়া চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হন এবং সেই সুযোগে গোলে বল ঠেলে দেন ব্রাজিলীয় ফরোয়ার্ড (৩-১)। তিনটি গোলেই মহেশের কৃতিত্বের ভাগ ছিল অর্ধেক। স্বাভাবিক কারণেই তাঁকেই এ দিন ম্যাচের নায়ক ঘোষণা করা হয়। একই ম্যাচে তিন-তিনটি অ্যাসিস্ট হিরো আইএসএলে সম্ভবত আর কেউ দিতে পারেননি।

গোলশোধের জন্য মরিয়া জামশেদপুরের বরিস ৭৪ মিনিটের মাথায় বাঁ দিক দিয়ে বিপক্ষের বক্সে ঢুকে চিমাকে বল বাড়ান। উড়ে আসা বলের দখল নেওয়ার জন্য চিমা ও কমলজিৎ দু’জনেই লাফালেও সেই লড়াইয়ে জেতেন চিমা। কিন্তু তাঁর গোলমুখী হেড বারে লেগে ফিরে আসে। লাল-হলুদ ফুটবলাররা চিমার বিরুদ্ধে ফাউলের জোরালো আবেদন জানালেও রেফারি তা দেননি।

নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার ১১ মিনিট আগে সুপারসাব ইশান পন্ডিতাকে নামায় জামশেদপুর এফসি। এর আগে ৬৪ মিনিটের মাথায় সুহেরকে তুলে অনিকেত যাদবকে নামায় ইস্টবেঙ্গল। জামশেদপুর ততক্ষণে ঋত্বিক দাস ও ফারুক চৌধুরিকেও নামিয়ে দেয় ডাগ আউট থেকে। পন্ডিতা নামলেও খেলার রঙ বদলাতে পারেননি। বরং ৯০ মিনিটের মাথায় ক্লেটন তাঁর হ্যাটট্রিকের সুযোগ পেয়েও হাতছাড়া করেন। ৬ মিনিটের স্টপেজ টাইমে মহেশ নিজে গোল করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। তা সত্ত্বেও তিনিই ছিলেন এই জয়ের নায়ক।

ইস্টবেঙ্গল দল: কমলজিৎ সিং (গোল), অঙ্কিত মুখার্জি (সার্থক গলুই), লালুচুঙনুঙ্গা, ইভান গঞ্জালেজ (অধি), জেরি লালরিনজুয়ালা, অ্যালেক্স লিমা, ভিপি সুহের (অনিকেত যাদব), জর্ডন ও’ডোহার্টি, নাওরেম মহেশ সিং, ক্লেটন সিলভা, সেম্বয় হাওকিপ।

পরিসংখ্যানে ম্যাচ         

বল পজেশন: জামশেদপুর এফসি ৪৪% - ইস্টবেঙ্গল এফসি ৫৬%,  সফল পাস: ২২৩/৩২৯ (৬৮%) - ৩১৬/৪২৮ (৭৪%), গোলে শট: ৫-৭, ফাউল: ৮-৫, সেভ: ৪-৪, ইন্টারসেপশন: ৯-৯, কর্নার: ৭-৬, হলুদ কার্ড: ৩-২, ম্যাচের হিরো: নাওরেম মহেশ সিং