ফের জয়ের কাছে পৌঁছেও জয়ের দরজা খুলতে পারল না ইস্টবেঙ্গল এফসি। অথচ তিন-তিনটি গোল করল  তারা। এবং খেলও তিনটি গোল। চলতি হিরো আইএসএল টেবলের একেবারে নীচে থাকা নর্থইস্ট ইউনাইটেডের বিরুদ্ধেও পুরো তিন পয়েন্ট তুলতে পারল না তারা। প্রথমে গোল দিয়েও তারা পিছিয়ে যায় এবং ফের এগিয়ে গিয়েও ব্যবধান বজায় রাখতে পারল না লাল-হলুদ বাহিনী।

বুধবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে তিন পয়েন্ট পেলে নয় থেকে আট নম্বরে যেতে পারত ইস্টবেঙ্গল এফসি। কিন্তু সেই উদ্দেশ্য সফল হল না রক্ষণের ভুলের জন্য, যা তাদের চলতি লিগে বরাবরই ভুগিয়ে আসছে। আক্রমণ ভাল হলেও রক্ষণের দোষে যে বরাবরই তারা পিছিয়ে যাচ্ছে, তা আরও একবার প্রমাণিত হল এ দিন। এই ড্রয়ের ফলে লিগ টেবলে অবস্থান অপরিবর্তিত রয়ে গেল দুই দলেরই। 

ইস্টবেঙ্গলকে দশ মিনিটের মাথায় এগিয়ে দেওয়ার পরে দ্বিতীয়ার্ধে পেনাল্টি থেকে গোল করে ফের দলকে এগিয়ে দেন ব্রাজিলীয় স্ট্রাইকার। প্রথমার্ধের মাঝামাঝি দু’মিনিটের মধ্যে পরপর দুটি গোল করে নর্থইস্টকে এগিয়ে দেন পার্থিব গগৈ ও জিতিন এমএস। প্রথমার্ধের শেষ মিনিটে বাইসাইকেল কিকে অনবদ্য গোল করে সমতা আনেন লাল-হলুদের ব্রিটিশ স্ট্রাইকার জেক জার্ভিস। শেষে নর্থইস্টের তরুণ মিডফিল্ডার ইমরান খানের গোলে ম্যাচের ফল হয় ৩-৩।

প্রথম এগারোয় এ দিন চারটি পরিবর্তন করে ইস্টবেঙ্গল। মহম্মদ রকিপ, লালচুঙনুঙ্গা, শৌভিক চক্রবর্তী ও সুমিত পাসি দলে আসেন অঙ্কিত, সার্থক, মোবাশির ও সুহেরের জায়গায়। পরিবর্তিত দল শুরু থেকেই এ দিন আক্রমণাত্মক মেজাজে ছিল। লড়াকু মেজাজে ছিল নর্থইস্টও। প্রথম পাঁচ মিনিটে বরং তারাই দুটি গোলের চেষ্টা করে। ফলে ম্যাচ বেশ গতিময় হয়ে ওঠে।

দশ মিনিটের মাথাতেই ক্ষিপ্র গতিতে গোল করে দলকে এগিয়ে দেন ইস্টবেঙ্গল এফসি-র গোলমেশিন ক্লেটন সিলভা, যিনি তাঁর এগারো নম্বর গোলটি করেন মাথা দিয়ে। অ্যালেক্স লিমার সঙ্গে ওয়াল খেলার পরে বাঁ দিক থেকে বাঁ পায়ে তাঁকে নিখুঁত ক্রসটি দেন জেরি লালরিনজুয়ালা। ক্লেটনের হেড গোলকিপার অরিন্দম ভট্টাচার্যের বাঁ দিক দিয়ে ঢুকে পড়ে গোলে (১-০)।

ব্যবধান বাড়ানোর সুবর্ণ সুযোগ তারা পেয়ে যায় ২৮ মিনিটের মাথায়, যখন বাঁ দিক থেকে নাওরেম মহেশের ক্রস বিপক্ষের বক্সে গিয়ে পড়ে এবং ক্লেটনের সামনেও প্রায় ফাঁকা গোল ছিল। কিন্তু বল তাঁর পায়ে পৌঁছনোর আগেই তা ক্লিয়ার হয়ে যায়।

এই ঘটনার দু’মিনিট পরেই অসাধারণ এক গোল করে সমতা এনে ফেলেন তরুণ ফরোয়ার্ড পার্থিব গগৈ। ইস্টবেঙ্গলের বক্স থেকে ক্লিয়ার হয়ে আসা একটি বল চলে আসে বক্সের বাইরে তাঁর পায়ে। প্রায় ৪০ ডিগ্রি কোণ থেকে গোলে শট নেন তিনি, যা বারের নীচে লেগে জালে জড়িয়ে যায় (১-১)।

এর দু’মিনিট পরেই ফের গোল করে দলকে এগিয়ে দেন নর্থইস্টের আর এক তরুণ ফরোয়ার্ড জিতিন এমএস। এই গোলটিও দুর্দান্ত। কাউন্টার অ্যাটাকে এই গোলটি আসে। রোমেন ফিলিপোতো ইস্টবেঙ্গলের প্রায় ফাঁকা অর্ধে বল দেন জিতিনকে। তিনি ডানদিক দিয়ে উঠে বক্সে ঢুকে ডানদিক থেকে ঠাণ্ডা মাথায় গোলে বল ঠেলে দেন এগিয়ে আসা গোলকিপার কমলজিৎ সিংয়ের ডানদিক দিয়ে (১-২)।

ইস্টবেঙ্গলের যে আক্রমণ ক্লিয়ার করার পরে এই কাউন্টার অ্যাটাকটি শুরু করে নর্থইস্ট ইউনাইটেড, সেই ক্লিয়ারেন্সের সময় বল অ্যালেক্স সাজির মাথা থেকে হাতে লেগে ছিটকে বেরিয়ে যায়। লাল-হলুদ ফুটবলাররা রেফারির কাছে পেনাল্টির জোরালো আবেদন জানালেও তাতে কর্ণপাত করেননি রেফারি। খেলা চালিয়ে যেতে বলেন এবং তার পরেই গোল।  

দু’মিনিটের মধ্যে পরপর দু’টি গোল খেয়ে দিশাহারা হয়ে যায় ইস্টবেঙ্গল এফসি। কিন্তু ক্রমশ তারা পরিস্থিতি সামলে নেয় এবং প্রথমার্ধের শেষ মিনিটে এক বিশ্বমানের গোল করে সমতা আনেন লাল-হলুদ শিবিরে নবাগত ব্রিটিশ তারকা জেক জার্ভিস। ছ’গজের সামনে থেকে দুর্দান্ত এক বাইসাইকেল কিকে বারের নীচ দিয়ে গোলে বল পাঠিয়ে দেন তিনি (২-২)। বলের গতি এতটাই ছিল যে, গোলকিপার অরিন্দম সঠিক সময়ে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেননি। 

প্রথমার্ধে দুই দলের পজেশন যেমন ছিল ৫০-৫০, তেমনই দুই দলের গোলমুখী শটেরও সংখ্যা ছিল তিনটি করে। প্রথম ৪৫ মিনিটের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পরে যখন দ্বিতীয়ার্ধের খেলা শুরু হয়, তখনও প্রায় একই ছবি দেখা যায়। ৬২ মিনিটের মাথায় ১-২-এ পিছিয়ে থাকা সত্ত্বেও ফের এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ এসে যায় কলকাতার দলের কাছে এবং পেনাল্টি থেকে গোল করে সেই সুযোগই কাজে লাগিয়ে নেন ক্লেটন সিলভা।

ডানদিক থেকে সুমিত পাসির সেন্টারে ক্লেটন হেড করে গোলে বল ঠেলার আগেই গোল লাইনের ঠিক সামনে তাঁকে ঠেলে সরিয়ে দেন সাজি, যার ফলে নর্থইস্টের বিরুদ্ধে পেনাল্টি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন রেফারি। ডানদিকে ঝাঁপানো অরিন্দমের বাঁদিক দিয়ে জালে বল জড়াতে বিন্দুমাত্র ভুল করেননি ব্রাজিলীয় ফরোয়ার্ড (৩-২)। এই নিয়ে চলতি মরশুমে এক ডজন গোল করে ফেললেন তিনি।

ক্লেটন জোড়া গোল করলেও এ দিন দলের আর এক বিদেশি স্ট্রাইকার জার্ভিসও যথেষ্ট তৎপর ছিলেন এবং প্রতিপক্ষের গোল এরিয়ায় তিনি ত্রাসও হয়ে ওঠেন। কিন্তু একাধিক ক্রসে বলের নাগাল না পাওয়ায় তিনি এ দিনের ম্যাচে আর গোল পাননি।

এ দিন নর্থইস্টের রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে এক ফুটবলার মাঠে নামতে যুবভারতীর দর্শকদের হাততালি দিয়ে তাঁকে অভিবাদন জানাতে দেখা যায়। তিনি হীরা মন্ডল। গত মরশুমে যিনি ইস্টবেঙ্গলের হয়ে রক্ষণে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়েছিলেন। বাঁ ঊরুতে বেশ চওড়া ব্যান্ডেজ লাগিয়ে মাঠে নামতে দেখা যায় তাঁকে। বেশ কয়েকটি ভাল ট্যাকলও এ দিন করেন হীরা। তবে একবার যন্ত্রণায় মাঠে লুটিয়েও পড়েন তিনি।

ইস্টবেঙ্গল যখন ম্যাচ জেতার কথা ভাবতে শুরু করে দিয়েছে, তখনই ফের গোল করে সমতা আনে নর্থইস্ট। আশি মিনিটের মাথায় অ্যালেক্স লিমা চোট পেয়ে মাঠের বাইরে চলে যেতেই তাদের মাঝমাঠে ও রক্ষণে বড়সড় ফাটল দেখা যায়, যা কাজে লাগিয়ে এই গোল করে সমতা আনেন প্রজ্ঞান গগৈয়ের জায়গায় আসা তরুণ মিডফিল্ডার ইমরান খান। ৮৫ মিনিটের মাথায় বক্সের ডানদিক থেকে আর এক পরিবর্ত খেলোয়াড় গনি নিগম কাট ব্যাক করে বক্সের মাঝখানে যে বল রাখেন, সেই বলেই গোলে শট নেন ইমরান (৩-৩)। গোলে শট নেওয়ার সময় তিনি ছিলেন সম্পুর্ণ অরক্ষিত।

এই গোলের পরের মিনিটেই লিমার জায়গায় নামা জর্ডন ও’ডোহার্টি বক্সের মাথা থেকে গোলে জোরালো শট নেন, যা অরিন্দম লাফিয়ে উঠে ফিস্ট করে বের করে না দিতে পারলে জয়সূচক গোলটি পেয়ে যেত লাল-হলুদ বাহিনী। কিন্তু দলের এক পয়েন্ট বাঁচিয়ে নেন বাংলার গোলকিপার। যদিও এই এক পয়েন্ট পেয়ে তেমন লাভ হল না নর্থইস্টের। তবে ইস্টবেঙ্গল এই ম্যাচ থেকে তিন পয়েন্ট পেলে লিগ টেবলে এক ধাপ ওপরে উঠতে পারত। সেই ক্ষতিটা স্বীকার করে নিতেই হল তাদের। এ ভাবে এই নিয়ে ১১ পয়েন্ট খোয়াল তারা।   

ইস্টবেঙ্গল দল: কমলজিৎ সিং (গোল), মহম্মদ রকিপ, লালচুঙনুঙ্গা, জেরি লালরিনজুয়ালা, চ্যরিস কিরিয়াকু, শৌভিক চক্রবর্তী, অ্যালেক্স লিমা (জর্ডন ও’ডোহার্টি), সুমিত পাসি (হীমাংশু জাঙরা), নাওরেম মহেশ সিং, ক্লেটন সিলভা (অধি), জেক জার্ভিস ।

পরিসংখ্যানে ম্যাচ         

বল পজেশন: ইস্টবেঙ্গল এফসি ৪৯% - নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি ৫১%, সফল পাস: ২৮৩/৩৭৮ (৭৫%) - ৩০৭/৩৯৮ (৭৭%), গোলে শট: ৫-৫, ফাউল: ১২-৭, সেভ: ২-২, ইন্টারসেপশন: ১-৬, কর্নার: ৮-৯, হলুদ কার্ড: ৩-২, ম্যাচের হিরো: ক্লেটন সিলভা।