রবিবার সামনে টানা চার ম্যাচ জিতে আসা বেঙ্গালুরু এফসি। প্রথম লিগে তাদের হারালেও সেই বেঙ্গালুরু আর এই বেঙ্গালুরুর মধ্যে অনেক ফারাক দেখা যাচ্ছে। গত চার ম্যাচে এগারো গোল দিয়েছে তারা। এই রকম একটা দলকে আটকানোর পরিকল্পনা সবুজ-মেরুন শিবিরে তৈরি ঠিকই। কিন্তু হুগো বুমৌস ও আশিক কুরুনিয়ানের মতো তারকাদের এই ম্যাচে না পাওয়া বহু সমর্থককেই চিন্তায় রেখেছে। তাঁদের আস্বস্ত করতে চান স্প্যানিশ কোচ হুয়ান ফেরান্দো। জানান, দুই তারকা না খেললেও, যারা রয়েছেন, তাদের নিয়েই ম্যাচ জেতার ক্ষমতা তাঁর দলের আছে।

কার্ড সমস্যার জন্য বুমৌস ও কুরুনিয়ান রবিবার যুবভারতীতে নামতে পারবেন না। তবে এই নিয়ে খুব একটা চিন্তিত দেখাল না আত্মবিশ্বাসী কোচকে। শনিবার সাংবাদিক বৈঠকে তিনি বলেন, “আমরা ঘরের মাঠে খেলব। তাই এই ম্যাচটা আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিকল্পনা তো করতেই হবে। আমাদের ২৫ জন খেলোয়াড় আছে। হুগো, আশিক খেলতে না পারলেও অন্যরা তৈরি আছে। ওরা খেলবে। যে খেলোয়াড়দের পাওয়া যায়, তাদের নিয়েই পরিকল্পনা করি আমরা। গত কয়েকটা ম্যাচে বেঙ্গালুরু যথেষ্ট উন্নতি করেছে। ওরা প্লে অফে যাওয়ার জন্য মরিয়া। কালকের ম্যাচটা আগের ম্যাচের চেয়ে একেবারে অন্যরকম। কারণ, পরিস্থিতি সম্পুর্ণ আলাদা। আমরা আত্মবিশ্বাসী। যে রকম খেলে এসেছি, সে রকমই খেলব। ঘরের মাঠে তিন পয়েন্টই লক্ষ্য”।

দুই তারকা না খেললেও পরিকল্পনা ও লক্ষ্য একই থাকবে বলে জানান কোচ ফেরান্দো। বলেন, “চার-পাঁচ দিন ধরেই পরিকল্পনা চলছে। যেহেতু গত ম্যাচের পরেই জেনে গিয়েছিলাম এই ম্যাচে দুজনকে পাব না, সেই অনুযায়ীই পরিকল্পনা হয়েছে। যারা আছে তারা দলকে সাহায্য করতে প্রস্তুত। আমি খুব একটা চিন্তিত নই। কারণ, এই মরশুমে অনেক চোট-আঘাত সমস্যা গিয়েছে। কঠিন সময় পেরিয়ে এসেছি আমরা। সমস্যার সমাধান করতে হয়েছে। কখনও সাফল্য পেয়েছি, কখনও পাইনি। দলের সবাই জানে এই অবস্থায় তিন পয়েন্ট কত জরুরি। আশা করি, যারা আছে, তারাই লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে”।

হুগো, আশিক না খেললেও তাঁদের আক্রমণের তীব্রতা একফোঁটাও কমবে না বলে জানান ফেরান্দো। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আক্রমণে আগ্রাসন একই থাকবে। সেই ভাবেই আমরা পরিকল্পনা করেছি। সেই ভাবেই আমরা অনুশীলনও করছি। হুগো, আশিক না খেললে কিছু খুঁটিনাটি বিষয়ে পরিবর্তন আনতে হবে ঠিকই। কিন্তু খেলার নীতি একই থাকবে। আক্রমণের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে চাপে রাখা, জায়গা তৈরি করা ও নিয়ন্ত্রণ করা, বিপক্ষের ডিফেন্ডারদের পিছনে জায়গা তৈরি করা, এই কৌশলগুলোতে কোনও পরিবর্তন হবে না”।

বুমৌসের জায়গায় সম্ভবত মরশুমের মাঝে যোগ দেওয়া অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার ফেদরিকো গায়েগোকে শুরু থেকে দেখা যাবে। তবে এখনই তা জানিয়ে দেওয়ার পক্ষে নন কোচ। বলেন, “হুগোর জায়গায় খেলার মতো অনেকেই আছে আমাদের দলে। রিকি, গায়েগো রয়েছে। ওদের মধ্যে কেউ খেলবে। এখনও অনুশীলন বাকি আছে আমাদের। তার পরে ঠিক করব, কাকে খেলানো যাবে। আপাতত পাঁচজন বিদেশি খেলার জন্য তৈরি আছে আমাদের। এটাই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কাকে শুরু থেকে খেলাব, কাকে বিরতির পর নামাব, এ সব অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। সে সিদ্ধান্ত পরে নেব”।

বেঙ্গালুরু গত চারটি ম্যাচে টানা জিতেছে। কিন্তু তাঁর দল এতটা ধারাবাহিক নয়। গত পাঁচটি ম্যাচের দু’টিতে জিতেছে তারা, দু’টিতে হেরেওছে, একটি ড্র করেছে। এই জায়গায় প্রতিপক্ষের চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও দলের ওপর আস্থা রাখছেন ফেরান্দো। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমার দলের ওপর আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে। একই ভাবে আস্থা বজায় রেখে যাব। খেলোয়াড়দের সময় খারাপ গেলে অবশ্যই তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। এটা ফুটবলেরই অঙ্গ। এখন হয়তো আমরা প্রচুর গোল মিস করছি, ধারাবাহিকতা তেমন নেই। কিন্তু ভবিষ্যতে যে ছবিটা পাল্টাবে না, তার কোনও মানে নেই। এই যে ম্যাচের এক দিন পরেই দলের ছেলেরা সবাই অনুশীলনে চলে আসছে, পরিশ্রম করছে, সে জন্য আমি খুশি”।

শুক্রবার এই যুবভারতীতেই ইস্টবেঙ্গল এফসি তিন নম্বরে থাকা কেরালা ব্লাস্টার্সকে হারিয়ে বড় অঘটন ঘটিয়েছে। এই ম্যাচ থেকেই বোঝা গিয়েছে হিরো আইএসএল কতটা অনিশ্চয়তায় ভরা এবং এর প্লে অফে ওঠা কতটা কঠিন। এই প্রসঙ্গে গতবারের সেমিফাইনালিস্টদের কোচ বলেন, “গত কালের ম্যাচে এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে প্লে অফে ওঠা মোটেই সোজা নয়। ইস্টবেঙ্গল গতকাল কেরালার থেকে যথেষ্ট ভাল খেলেছে। তবে এখন ওই ম্যাচের চেয়ে নিজেদের ম্যাচ নিয়ে বেশি ভাবা উচিত”।

আগামী দশ দিনে যে তাদের কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে সবুজ-মেরুন কোচ বলেন, “আমাদের যথাসাধ্য ভাল জায়গায় থেকে লিগ শেষ করতে হবে, এটাই লক্ষ্য। এর পরে জামশেদপুর ও হায়দরাবাদের বিরুদ্ধেও খেলতে হবে। দশ দিনে তিনটে ম্যাচ খেলতে হবে আমাদের। তাই বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লে চলবে না। পরের দুটো ম্যাচ বাইরে গিয়ে খেলতে হবে। সে জন্য মানসিক ভাবে শক্তিশালী হতে হবে আমাদের। এটাই লিগ টেবলে সেরা জায়গায় যাওয়ার সবচেয়ে বড় সুযোগ”।

প্রতিপক্ষে রয় কৃষ্ণা, হাভিয়ে হার্নান্ডেজ, শিবশক্তি নারায়ণ, রোহিত কুমারের মতো ধারালো গোলস্কোরার রয়েছে। কিন্তু তাদের আলাদা করে গুরুত্ব দিতে চান না কোচ। পুরো দলটাকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন তিনি। এই নিয়ে বলেন, “কোনও দু-একজন খেলোয়াড়কে নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা আমরা করি না। পুরো দলকে নিয়ে করি। ওদের ওঠা-নামায় রাশ টানতে হবে। চেন্নাইনের বিরুদ্ধে বেঙ্গালুরু যে তিনটি গোল করেছিল, তা মোটামুটি একই পরিস্থিতিতে। চেন্নাইন সে ভাবে আক্রমণে উঠতে পারেনি এবং বেঙ্গালুরু তাদের দ্রুত ট্রানজিশনে গোল করে। এই খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলোর ওপর নজর রাখতে হয়”।

এই মরসুমে প্রতি সাংবাদিক বৈঠকেই লিস্টন কোলাসোর সমস্যা নিয়ে যেমন নিয়মিত প্রশ্ন উঠছে, এ দিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এ দিনও প্রায় একই উত্তর দেন কোচ। তিনি মনে করেন, কোলাসোকে প্রতিপক্ষের গোলের সামনে আরও আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। বলেন, “গত ম্যাচে লিস্টন মিনিট দশেক খেলেছিল। তার মধ্যেও সুযোগ পেয়েছিল। তবে সেগুলো সহজ সুযোগ বলা যাবে না। শুধু লিস্টন নয়, অনেকেই প্রতিপক্ষের গোলের সামনে গিয়ে ঘাবড়ে যায়। এটা ফুটবলেরই অঙ্গ। আমরা হয়তো অনেককে হতাশ করছি। কিন্তু এমন হয়। আমাদের প্রতিপক্ষের গোলকিপারের সামনে আরও আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। এর মধ্যে কোনও গোপন রহস্য নেই। সারা বিশ্বে এমন হয়। গত বিশ্বকাপেও হয়েছে। আমাদের লিস্টন, আশিক, মনবীররাই শুধু মিস করছে না। অনেকেই করছে এবং তাদের আরও আত্মিবশ্বাসী হতে হবে। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আশা করি, আমার দলের ছেলেরা তা পারবে”।

দলের গোলকিপার বিশাল কয়েথ, যিনি গত ন’টি ম্যাচে মাত্র তিনটি গোল খেয়েছেন এবং এ পর্যন্ত মোট সাতটি ম্যাচে ক্লিন শিট রাখতে পেরেছেন, তিনিও এ দিন সাংবাদিকদের সামনে হাজির হন এবং দলের রক্ষণ বিভাগের বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, “আমাদের রক্ষণ যদি ভাল না হত, তা হলে অন্যান্য দলের মতো আমরাও অনেক গোল খেতাম। আমিই তো শুধু গোল আটকাচ্ছি তা নয়। গত ম্যাচে একবারই মাত্র বল ধরেছিলাম। তাই রক্ষণ খারাপ, এটা বলা যাবে না। তাই আমার মনে হয়, ধারণাটা ঠিক না”।

২০১৭-১৮ মরশুমেও বিশাল সাতটি ম্যাচে কোনও গোল খাননি। এ বার আর একটি ম্যাচে ক্লিন শ্ট রাখতে পারলে, তা হবে তার সেরা পারফরম্যান্স। তবে গত মরশুম খুব একটা ভাল যায়নি তাঁর। এ মরশুমে উন্নতির রহস্য নিয়ে বলেন, “গত মরশুমের চেয়ে এ মরশুমে ভাল করছি। কারণ, কোচ সব সময়ই পাশে থাকেন। এমনকী ভুল করলেও উনি পাশে থাকেন, পিঠ চাপড়ান। গত মরশুম অন্য রকমের ছিল, এ বার অন্য রকম। সব সময়ই উন্নতি করার চেষ্টা করি। মাঠে নেমে গোল খাব না মনে করাটাই সবচেয়ে জরুরি ব্যাপার। এই প্রত্যয়টা থাকা দরকার। প্রতি ম্যাচে সেই প্রত্যয় নিয়েই নামি”। 

বেঙ্গালুরু দলে একাধিক তারকা স্কোরার থাকলেও আলাদা করে কাউকে বাড়তি গুরুত্ব দিতে নারাজ বিশাল। বলেন, “সুনীল ছেত্রী, রয় কৃষ্ণাদের মধ্যে কে বেশি ভয়ঙ্কর, সেটা ব্যাপার নয়। কারও পায়েই তো আর দুটো বল থাকবে না। প্রতিপক্ষে আরও দশ জন থাকবে। ওদের দলে আরও অনেক গোল করছে। তবে ওদের নিয়ে বেশি ভাবছি না। আমরা কী ভাবে গোল আটকাব, সেটাই আসল কথা। নিজেদের সেরাটা দিয়ে যদি তা করতে পারি, তা হলে আশা করি, কালকের ম্যাচ জিতব”।

বেঙ্গালুরু এফসি-র বিরুদ্ধে এই গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন ম্যাচে নামার আগে সবুজ-মেরুন শিবিরের নির্ভরযোগ্য মিডফিল্ডার কার্ল ম্যাকহিউ বলেন, “বেঙ্গালুরু শেষ চারটি ম্যাচে জিতেছে ঠিকই। আমরাও গত ম্যাচে জয়ের রাস্তায় ফিরে এসেছি। দুই পক্ষের কাছেই ম্যাচটা প্লে অফে থাকার লড়াই। তাই কেউ কাউকে ছাড়বে না। আমাদের সামনে দু’নম্বরে থেকে শেষ করার সুযোগ আছে। কারণ, আমাদের হায়দরাবাদ, ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে ম্যাচ বাকি আছে। সে জ্ন্যই রবিবারের ম্যাচটা আমাদের ফাইনাল ভেবে ঝাঁপাতে হবে”। ক্লাবের মিডিয়া টিমকে কথাগুলি বলেন কার্ল।

দলের সিনিয়র ডিফেন্ডার ও অধিনায়ক প্রীতম কোটাল বলেন, “এখন প্রতি ম্যাচই আমাদের কাছে ফাইনাল। বেঙ্গালুরু টানা চার-চারটে ম্যাচ জিতে আমাদের বিরুদ্ধে নামছে। তবু প্লে অফ নিশ্চিত হয়নি ওদের। ফলে কাল ওরা সর্বশক্তি দিয়ে খেলবে। আমরা ওডিশা ম্যাচের মতো প্রেসিং ফুটবল খেলতে পারলেই জিতে যাব। হুগো, আশিকের না থাকাটা বড় ধাক্কা। দুজনকেই দরকার ছিল এই ম্যাচে। বেঙ্গালুরু বেশিরভাগ গোলের রাস্তাই এখন তৈরি করছে উইং দিয়ে। সে কথা মাথায় রাখতে হবে আমাদের। প্রথম কুড়ি মিনিট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিজেদের গোলের মুখ বন্ধ করে রাখতে হবে যেমন, তেমন সুযোগগুলোও কাজে লাগাতে হবে”।