কঠিন সময় পেরিয়ে তাঁর দল ক্রমশ নিজেদের আগের জায়গায় ফিরে যাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু সেরাস্তাতেও কম কাঁটা নেই। সবার আগে বড় কাঁটা শনিবারের ডার্বি।  এই ম্যাচে বিপক্ষকে নিয়ে দুশ্চিন্তার চেয়ে নিজের দল নিয়ে বেশি চিন্তায় রয়েছেন এটিকে মোহনবাগানের স্প্যানিশ কোচ হুয়ান ফেরান্দোশনিবার সাংবাদিকদের যা বললেন, তাতে বারবার এই ব্যাপারটাই উঠে এল। এমনকী দলের অন্যতম সেরা তারকা রয় কৃষ্ণাকে নিয়েও চিন্তামুক্ত নন তিনি। শুক্রবারের ভার্চুয়াল সাংবাদিক বৈঠকের উল্লেখযোগ্য অংশ এখানে তুলে ধরা হল।  

ভারতীয় ফুটবলের সবচেয়ে বড় ম্যাচ কলকাতা ডার্বি-র অঙ্গ হয়ে উঠতে পেরে কেমন লাগছে আপনার?

অবশ্যই আমি খুশি। এ রকম একটা বিশাল ম্যাচে অংশ নিতে পারার সুযোগ পাওয়াটা আমার কাছে বড় ব্যাপার। তবে এই ম্যাচে আমাদের লক্ষ্য একই থাকবে, তিন পয়েন্ট অর্জন করা। নিজেদের স্টাইলে উন্নতি করা, কিছু জায়গায় উন্নতি করাও লক্ষ্য। ফোকাস যেন নড়ে না যায়, সেটাও দেখতে হবে। এটা আবেগের ম্যাচ ঠিকই। কিন্তু সে জন্য ফোকাস নড়ে যাওয়া চলবে না।

গত ম্যাচে রয় কৃষ্ণা হালকা চোট পেয়েছেন। ডার্বিতে কি রয় পুরো ৯০ মিনিট খেলতে পারবেন?

দেখা যাক। সময় দরকার। গত সপ্তাহে রয়ের কঠিন সময় চলছিল। কোভিড পরিস্থিতির কথা সবাই জানেন। সারাক্ষণ স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গে ঘরবন্দি হয়ে থাকতে হয় ওকে। তবে ওর ওপর আমাদের আস্থা আছে। মাঠে নেমে নিজের একশো শতাংশ দেয় ও। ড্রেসিং রুমকেও যথেষ্ট উজ্জীবিত রাখে ও। ওকে আমাদের দরকার। কিন্তু মাঝে মাঝে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। কারণ, একটা ম্যাচে খেলিয়ে একজন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়কে তিন-চার সপ্তাহের জন্য হারানোর কোনও মানে হয় না।

বিপক্ষ সম্পর্কে কী বলবেন? আপনার দলে আর কারও কি কোনও চোট-আঘাত রয়েছে?

এসসি ইস্টবেঙ্গল এখন অনেকটাই বদলে গিয়েছে। মরশুমের শুরুর দিকে ওরা যেমন ছিল, তার চেয়ে এখন অনেক আলাদা। ওদের গত তিন-চারটে ম্যাচে দেখছি ওরা এখন অনেক খোলা মনে নিজেদের মতো খেলতে পারছে। পুরো দলটাই এখন অনেক সঙ্ঘবদ্ধ। অনেকেই বলছিলেন, ওদের পারফরম্যান্স ভাল না, ওদের প্রস্তুতি নাকি ভাল হয়নি। কিন্তু ওরা যে ভাবে এখন বিপক্ষকে চাপে রাখছে, তাতে আমার বিশ্বাস শেষ কয়েকটা ম্যাচ দেখে ওদের সমর্থকেরা নিশ্চয়ই খুশি হয়েছেন।

হুগো বুমৌস তার এক ম্যাচের সাসপেনশন কাটিয়ে ফিরছেন এই ম্যাচে। সে ক্ষেত্রে বিদেশিদের কী ভাবে প্রথম এগারোয় সাজাবেন?

পরিকল্পনা তো আছেই। তবে সেটা এখন বলতে পারব না। তবে দলের বিদেশিরা যে সকলেই এখন তৈরি, এটা জেনে আমি খুশি। স্থানীয় খেলোয়াড়রাও সুস্থ। আমাদের স্কোয়াডে এখন ২৯ জন রয়েছে। অভিলাষের যা চোট, তাতে ওর সেরে উঠতে পাঁচ-ছমাস লাগবে। তবে কোভিড, চোটের ঝুঁকি ইত্যাদি নিয়ে অবস্থা যে রকম ছিল তাতে সব কিছু কঠিন হয়ে ওঠে। এখন ধাপে ধাপে খেলোয়াড়রা তৈরি হচ্ছে এবং উন্নতি করছে।

শেষ দুই ম্যাচে আপনার দল লিগ টেবলে তেমন এগোতে পারেনি। এই নিয়ে কি আপনি চিন্তিত?

আমরা পজিশনাল অ্যাটাকে যে যথেষ্ট ভাল, তা আমরা আগেই প্রমাণ করেছি। এ ছাড়া আক্রমণে ওঠার সময়ে দ্রুত ট্রানজিশন (ওঠা-নামা) করা খুব জরুরি। ঝুঁকির পাস করার ক্ষেত্রেও আমাদের আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। দলের ছেলেরা ঝুঁকি নিয়ে পাস দিতে ভয় পাচ্ছে। তবে বল পা-ছাড়া হওয়ার পর দ্রুত নেমে আসাটা আমার কাছে খুবই জরুরি। এটা খুবই কঠিন কাআমাদেরজ। কারণ, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগেও দেখে থাকবেন অনেকেই দ্রুত ট্রানজিশন করতে না পারায় গোল খেয়েছে। তবে আমাদের ছেলেরা খুবই চেষ্টা করছে। কোভিডের জন্য অনেকেরই শারীরিক সমস্যা হয়েছে। অনেক কিছু বদলে গিয়েছে তাদের শরীরে। তবু সমর্থখদের জন্য বলি, আমাদের খেলোয়াড়রা তাদের সেরাটা দিয়ে চেষ্টা করছে। আমার কাছে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

এসসি ইস্টবেঙ্গলের মূল শক্তি কোথায় বলে আপনার মনে হয়?

আমি তো বললামই ওদের যে ম্যাচগুলো দেখেছি, সেগুলো দেখে আমার কী মনে হয়েছে। এর বেশি আর ওদের সম্পর্কে কিছু জানা নেই আমার। কারণ, নিজের দল নিয়েই এত ব্যস্ত আমি যে ওদের দলে আর মনোনিবেশ করতে পারিনি। আসলে এই কঠিন সময়ে কোচিং স্টাফদের কাজও কঠিন হয়ে উঠেছে এবং প্রত্যেককেই সমান পরিশ্রম করতে হচ্ছে। আমাদের দলের ডাক্তার থেকে শুরু করে ম্যাসিওর প্রত্যেকেই এত ভাল কাজ করেছে বলে আমরা কঠিন সময় থেকে কিছুটা হলেও বেরিয়ে আসতে পেরেছি।

এসসি ইস্টবেঙ্গল গত ম্যাচে চার গোল খেয়ে হেরেছে আর আপনার দল ক্লিন শিট রেখে ড্র করে। এই দুই ফল কি আপনার দলকে ডার্বিতে সামান্য হলেও এগিয়ে রেখেছে?

আমার তা মনে হয় না। এ বারের মরশুমে প্রতি ম্যাচই আলাদা। কারণ, কঠিন পরিস্থিতির জন্য প্রতি ম্যাচেই খেলোয়াড়দের মানসিকতা বদলে যাচ্ছে। এসসি ইস্টবেঙ্গলের শেষ ম্যাচে দুটো ছোট ছোট ভুলই ওদের হারিয়ে দিল। এই ভুলগুলো না হলে এত তাড়াতাড়ি ২-০ করতে পারত না হায়দরাবাদ। তার পরে ওডিশা-হয়দরাবাদ ম্যাচেও একই রকম হয়েছে। এখন যা অবস্থা, তাতে আবেগ মাঝে মাঝেই বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা মোটেই সোজা নয়।

এসসি ইস্টবেঙ্গলের নতুন বিদেশিরা কি ওদের কাল বাড়তি শক্তি জোগাবে? আপনার কী মনে হয়?

হ্যাঁ, ওরা ভাল খেলোয়াড়। দ্বিতীয় জনকে আমি চিনি। আমারই দেশের খেলোয়াড় সোতা। খুব ভাল খেলোয়াড়। ওর পাসিং খুব ভাল। জায়গা তৈরি করে নিতে পারে। নিশ্চয়ই ওরা দলকে সাহায্য করবে। তবে আর নটা ম্যাচ খেলতে হবে ওদের। সময় বেশি নেই। এই সময়ে পুরো দল হিসেবে উন্নতি করা মোটেই সোজা নয় আর যারা নতুন এসেছে, তাদেরও মানিয়ে নিতে সময় লাগবে। তাই সব ম্যাচেই যে তারা সাহায্য করবে, এটা বোধহয় মুশকিল।

আপনি কি এর আগে কোনও কলকাতা ডার্বি দেখেছেন?

হ্যাঁ, গত বছর যখন আমি ভারতে আসি, তখন এফসি গোয়ার ম্যাচ ছাড়াও অন্যান্য দলের অনেক ম্যাচও দেখি। তখন কলকাতার দুই দলের ম্যাচও দেখি। গত বছর ডুরান্ড কাপে যখন দল নিয়ে যাই, তখন কলকাতার স্টেডিয়ামে আমাদের ম্যাচ ছিল। অসাধারণ স্টেডিয়াম। ওখানকার পরিবেশও দুর্দান্ত। পরের বছর যদি সুযোগ পাই, গ্যালারিভর্তি স্টেডিয়ামে এটিকে মোহনবাগান বনাম এসসি ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে থাকার, আমার কাছে সেটা এক বিশাল অভিজ্ঞতা হবে।

এটিকে মোহনবাগান সমর্থকদের উদ্দেশ্যে কী বলবেন?

সমর্থকদের আবেগ, অনুভূতি বুঝি। আমরা সেরাটাই দিতে চাই। আমাদের সময়টা যে ভাল যাচ্ছে না, তা জানি। বায়ো বাবল, কঠিন সময়ের মধ্যে ঠিকমতো অনুশীলন না হওয়ার ফলে হয়তো আমাদের পারফরম্যান্সে কিছুটা ঘাটতি হয়েছে। কিন্তু এখন আমরা সব ভুলে গিয়ে মাঠে নামতে চাই। কালকের ম্যাচে আমরা সমর্থকদের জন্য নিজেদের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করব। জানি প্রচুর মানুষ আমাদের মেসেজ পাঠাচ্ছে। আশা করি, কাল তিন পয়েন্ট নিয়েই মাঠ ছাড়ব।

শেষ প্রশ্ন, প্রথম কলকাতা ডার্বি জিতলে কী ভাবে সেলিব্রেট করবেন?

সত্যিই বলছি, তিন পয়েন্ট পাওয়ার পর মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে ম্যাচের প্রস্তুতি শুরু করব। আমার স্বপ্ন লিগ জেতা। এই ক্লাবকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে নিয়ে যাওয়াটাই আমার স্বপ্ন। তাই এই ম্যাচে জেতার পরে আমাকে মুম্বই ম্যাচ জেতারও প্রস্তুতি নিতে হবে। কারণ, এটাই আমার কাজ, এটাই আমার লক্ষ্য। আশা করি, আমাদের সমর্থকেরা শনিবার রাতে খুব হইহুল্লোড় করবেন।