তাজিকিস্তানের রাজধানী দুশানবে-তে যেমন ঠান্ডা, তেমনই রিপাবলিক কানস্কি স্টেডিয়ামের কৃত্রিম ঘাসের গতি। দুটোই সামলানো বেশ কঠিন অনভ্যস্তদের পক্ষে। ভারতীয়দের এই সমস্যাকে কাজে লাগিয়েই বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের ম্যাচে নির্ধারিত ৯০ মিনিট পর্যন্ত এক গোলে এগিয়ে ছিল আফগানিস্তান। কিন্তু ম্যাচ শেষের ১২ মিনিট আগে মাঠে নামা মণিপুরের ২৪ বছর বয়সি ফরোয়ার্ড ‘লেন’-এর দুর্দান্ত হেড থেকে হওয়া গোলে অপরাজিতই থেকে গেল ভারত। চার ম্যাচে তিন পয়েন্ট নিয়ে আপাতত চমৎকারের অপেক্ষায় ইগর স্টিমাচের ভারতীয় দল। গ্রুপের অন্য ম্যাচে যদি অঘটন ঘটে, তাহলেই তাদের পরবর্তী রাউন্ডে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। না হলে ভারতের বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের চ্যালেঞ্জ কার্যত শেষই বলা যায়। কলকাতায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যেমন শেষ মুহূর্তের গোলে মান বাঁচিয়েছিলেন আদিল খান, এ বার সেই একই ভাবে সম্মান রক্ষা করলেন ‘লেন’।  

তবে ‘লেন’-এর গোলে যে বৃহস্পতিবার মান বাঁচল দেশের, এটাই সবচেয়ে ভাল খবর। ‘লেন’ ডাকনাম সেমিনলেন দুঙ্গেলের। ২০১১ থেকে ২০১৪ খেলেছিলেন লাল-হলুদ জার্সি গায়ে। তখন থেকেই ফুটবলের আসল জীবন শুরু তাঁর। তার পরে পৈলান অ্যারোজ, শিলং লাজং, নর্থ ইস্ট ইউনাইটেড, বেঙ্গালুরু এফসি, দিল্লি ডায়নামোজ, কেরালা ব্লাস্টার্স ও গোয়া এফসি-র হয়ে খেলেছেন। খেলেছেন ভারতের অনূর্ধ্ব ২৩ দলের হয়েও। কিন্তু সিনিয়র দলের হয়ে মাঠে নামার সুযোগ পেলেন এই প্রথম। আর প্রথম সুযোগেই বাজিমাত করে ফেললেন। জয় এনে দিতে না পারুন, ভারতের সম্মান তো বাঁচালেন।

প্রথম ৪৫ মিনিট আবহাওয়া ও মাঠের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার লড়াইয়ে ফুটবলটাই ঠিকমতো খেলতে না পারায় প্রথমার্ধ্বের শেষ মিনিটে জেলফাগার নাজারির গোলে যে পিছিয়ে যায় ভারত, সেই গোলেই প্রায় জয় ছিনিয়ে নিতে চলেছিল আফগানিস্তান। ম্যাচের শেষে বাড়তি সময়ে কর্নার থেকে হেড করে দেওয়া গোলেই মান বাঁচালেন দুঙ্গেল। দ্বিতীয়ার্ধে বারবার আক্রমণ করেও সাফল্য পাননি ভারতীয় দলের নামী ফুটবলাররা। এক গোলে এগিয়ে থাকা আফগান খেলোয়াড়রা ‘ফিজিকাল অ্যাডভান্টেজ’ নিয়ে বারবার আটকে দেন তাঁদের। সুনীল ছেত্রী, উদান্ত সিং, আশিক কুরুনিয়ান, সাহাল আব্দুল সামাদদের একাধিক শট, হেড লক্ষ্যভ্রষ্টও হয়। তবে শেষ পর্যন্ত যে হারতে হয়নি ভারতকে, এটাই সৌভাগ্যের।    

ম্যাচটা যখন শুরু হয়, তখন পারদ ১১ ডিগ্রিরও নীচে। ভারতীয় ফুটবলারদের হাতের গ্লাভস দেখেই অবশ্য সেটা আন্দাজ করা যাচ্ছিল। এই সমস্যার সঙ্গে যে তাঁদের লড়াই করতে হবে, তা সুনীল ছেত্রীরা দুশানবে পৌঁছেই বুঝতে পেরেছিলেন। তবে বুধবার সন্ধ্যার চেয়েও ঠান্ডাটা বেশিই ছিল এ দিন। তার ওপর কৃত্রিম ঘাসের মাঠ। যে মাঠে আফগানিস্তানের ফুটবলাররা খেলতে অভ্যস্ত হলেও ভারতীয়রা নন একেবারেই। দু-তিন দিন অনুশীলন করে যে কিছুটা সড়গড় হয়ে নেবেন, সেই উপায়ও ছিল না একেবারেই। প্রাকৃতিক ঘাসের মাঠে বলের গতি স্বাভাবিক থাকলেও কৃত্রিম ঘাসে বলের বাড়তি গতিই সমস্যা বাড়িয়ে তোলে ভারতীয়দের। কৃত্রিম ঘাসে বল পড়ে কতটা লাফাতে পারে সেটাও অনভ্যস্ত গোলকিপারের পক্ষে বোঝা কঠিন। ভারতীয় গোলকিপার গুরপ্রীতকেও এই সমস্যার মধ্যে পড়তে দেখা যায় মাঝে মাঝে।

তিন ম্যাচে ন’গোল খাওয়া আফগানিস্তান তাদের হোম অ্যাডভান্টেজ পুরোপুরি নেওয়ার উদ্দেশ্যেই এই মাঠে ম্যাচ নিয়েছে বলে শোনা যায়। প্রথমার্ধে তারা এই সুবিধাটা কাজেও লাগিয়ে নেয়। ভারতীয়রা পরিবেশ ও মাঠের সঙ্গে মানিয়ে নিতে যতটা সময় নেন, সেই সময়ে বারবার দ্রুত আক্রমণে উঠে প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলে দেন ওমরান হায়দারিরা। মূলত ডানদিকের উইং দিয়েই আক্রমণে উঠছিলেন আফগানরা। তবে ভারতীয় রক্ষণ বিভাগ এ দিন যথেষ্ট তৎপর ছিল বলে গুরপ্রীতকে অত্যাধিক চাপ নিতে হয়নি। আর আফগানিস্তানের গোলরক্ষক ওভেইস আজিজি-কে তো প্রায় পরীক্ষা দিতেই হয়নি প্রথম ৪৫ মিনিটে।

সুনীল ছেত্রীও প্রত্যাশিত ভাবেই ছিলেন কড়া পাহাড়ায়। যার ফলে সাহাল ও আশিকদেরই আক্রমণের দায়িত্ব নিতে হয় বেশির ভাগ সময়। বাঁ দিক থেকে মান্দার মাঝে মাঝে আক্রমণ তৈরির চেষ্টা করছিলেন। প্রীতম ও উদান্তও ডান দিক থেকে বারবার আক্রমণে উঠে বিপক্ষকে চাপে রাখার চেষ্টা করছিলেন। ২৬ মিনিটে সাহালের সঙ্গে যুগলবন্দীতে সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলেন আশিক। কিন্তু বারের ওপর দিয়ে শট মারেন তিনি। ইউরোপে খেলা আফগানদের শারীরিক সুবিধা তাঁদের বারবার ব্যর্থ করে দিচ্ছিল। আফগানিস্তান বরং এ দিন প্রথমার্ধে বারবার পাল্টা আক্রমণে উঠে বেশ চাপে রেখেছিল ভারতকে।

৪৫ মিনিটে ডেভিড নাজেমের স্কোয়ার পাস থেকে ভারতের বক্সের একেবারে মাঝখানে থাকা জেলফাগার নাজারি গোলের ওপর দিয়ে জালে জড়িয়ে দেন। দীর্ঘদেহী গুরপ্রীত বলের লাইনে পৌঁছলেও তার গতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারেননি।

প্রথমার্ধের এই গোলে পিছিয়ে গেলেও ভারতীয়দের মধ্যে চাপে পড়ে যাওয়ার বিন্দুমাত্র লক্ষণ দেখা যায়নি বিরতির পরে। বরং কোচের নির্দেশে প্ল্যান বি ব্যবহার করে আরও আক্রমণাত্মক ফুটবল শুরু করে তারা। এক গোলে হার যা, দু’গোলে বা তার বেশি গোলে হারও তাই। এই নীতিতেই অল আউট চলে যান স্টিমাচের দলের ছেলেরা। সুনীল ছেত্রীও তাঁর অভিজ্ঞতা ও ক্ষিপ্রতা কাজে লাগিয়ে তাঁর ওপর কড়া পাহাড়া ভেদ করে বেরিয়ে আসার মরিয়া চেষ্টা শুরু করেন। ৫৮ মিনিটে আশিকের ক্রসে মাথা ছুঁইয়ে গোলের চেষ্টাও করেন তিনি। কিন্তু ভারতীয় অধিনায়ক অল্পের জন্য বলের নাগাল পাননি। অন্য দিক থেকে প্রীতম ফের ক্রস করেন ছেত্রীর উদ্দেশে। এ বার তিনি নিখুঁত হেড করলেও তা বাঁচিয়ে দেন আজিজি।

এই সময় থেকেই ভারতের আক্রমণের তীব্রতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। আফগানরা এক গোলে এগিয়ে থাকায় তখন রক্ষণেই বেশি নজর দিচ্ছিলেন তাঁরা। ৬১ মিনিটে মনবীরের পাস ধরে ব্যাক পাস করে আশিককে দারুণ একটা সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলেন ছেত্রী। কিন্তু আশিক ঠিকমতো বল ধরেতেই পারেননি। ৬৬ মিনিটে উদান্তর হেড গোলকিপার কোনওক্রমে বাঁচিয়ে নেন। ব্রেন্ডন ফার্নান্ডেজ দ্বিতীয়ার্ধে উঠে খেলতে শুরু করার পর থেকে গোলের সুযোগ তৈরির জন্য বেশ তৎপর হয়ে ওঠেন। প্রথমার্ধে কৃত্রিম ঘাসের গতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে যে অসুবিধা হচ্ছিল ভারতীয় ফুটবলারদের, দ্বিতীয়ার্ধে সেই অসুবিধা অনেকটাই তাঁরা কাটিয়ে উঠেছিলেন বলে মনে হচ্ছিল। মাঝমাঠের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে দু’দিকের উইং দিয়ে বারবার গোলের সুযোগ তৈরির মরিয়া চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন উদান্ত, প্রণয়, রাহুল, আশিকরা। কিন্তু সাফল্য ধরা দিচ্ছিল না।

৭৮ মিনিটে প্রণয় হালদারের জায়গায় সেমিনলেন দুঙ্গেলকে নামানোর সিদ্ধান্তটাই শেষ পর্যন্ত কাজে লেগে যায় স্টিমাচের। ভারতের জার্সি গায়ে প্রথম খেলতে নামা ২৪ বছর বয়সি মণিপুরের এই ফরোয়ার্ডই এই আক্রমণের তীব্রতা আরও বাড়িয়ে তোলেন এবং শেষ পর্যন্ত দেশের সম্মান বাঁচান তাজিকিস্তানের মাটিতে। ৮৪ মিনিটে আশিকের ক্রস থেকে মনবীরের হেড ফের লক্ষভ্রষ্ট হয়। দু’মিনিট পরেই ব্রেন্ডনের দূরপাল্লার শট বারের ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। ম্যাচের শেষ কয়েক মিনিট আফগানদের এলাকাতেই খেলা চলছিল। ভারতীয়রা সমতা ফেরানোর একের পর এক চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন।

চতুর্থ রেফারি যখন জানিয়ে দিয়েছেন, নির্ধারিত সময়ের চেয়ে আর পাঁচ মিনিট বাড়তি দেওয়া হবে এবং তার দু’মিনিট পেরিয়েও গিয়েছে, হতোদ্যম ভারতীয় সমর্থকেরা যখন দেশের হয়ে গলা ফাটানোও প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন, তখনই দুঙ্গেল তাঁদের ফের উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ার কারণ হয়ে ওঠেন গোল শোধ করে। ব্রেন্ডনের নিখুঁত কর্নারে অনেকটা লাফিয়ে তাঁর মার্কারকে বোকা বানিয়ে উড়ে আসা বলে হেড করে বিপক্ষের জালে বল জড়িয়ে দেন। বাড়তি সময়ের শেষ মিনিটে হাসান আমিনের গোলমুখী শট আটকে দলকে বিপদ থেকে রক্ষা করেন গুরপ্রীত। না হলে ভারতকে হয়তো হারের লজ্জা নিয়েই মাঠ ছাড়তে হত।