হিরো আইএসলের লিগ পর্ব যত শেষ দিকে এগোচ্ছে, ততই সারা সেরা ছয়ের দৌড় জমে উঠছে। এখন সেরা ছয়ে থাকা দলগুলির প্রতিটি ম্যাচই গুরুত্বপূর্ণ। একটি ম্যাচে তিন পয়েন্টের কম পাওয়া মানে অনেকটা পিছনে চলে যাওয়া। এই অবস্থায় এটিকে মোহনবাগান ও ওডিশা এফসি দুই দলেরই সাম্প্রতিক ফর্মের সমস্যায় ভুগছে। দুই দলই তাদের গত পাঁচটি ম্যাচের মধ্যে মাত্র একটিতে জিতেছে। ফলে এই দুই দল যখন শনিবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে মুখোমুখি হবে, তখন দু’পক্ষই তিন পয়েন্টের জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে।

এটিকে মোহনবাগান টানা তিন ম্যাচে জয়ের পরই গত পাঁচ ম্যাচে হোঁচট খেয়েছে। ওডিশার বিরুদ্ধেই তারা গোলশূন্য ড্র করে এবং নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি-র কাছে এক গোলে হারে। এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে ২-১-এ জিতলেও পরের দুই ম্যাচে ফের জয়হীন থাকে তারা। মুম্বই সিটি এফসি-র কাছে এক গোলে হারে ও চেন্নাইয়ে গিয়ে গোলশূন্য ড্র করে।

ওডিশা এফসি-রও তথৈবচ অবস্থা। তারাও টানা তিনটি ম্যাচ জেতার পরে ছ’টি ম্যাচের মধ্যে মাত্র একটিতে জেতে, চারটিতে হারে এবং একটি ড্র করে। গত ম্যাচেই তারা বেঙ্গালুরুর কাছে ১-৩-এ হারে। অথচ তার আগের ম্যাচেই ইস্টবেঙ্গল এফসি-কে নিজেদের মাঠে ৩-১-এ হারায়। তবে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে নামার আগে টানা চারটি ম্যাচে জয়হীন ছিল তারা। সব মিলিয়ে দুই প্রতিবেশী রাজ্যের দল ইদানীং একেবারেই স্বস্তিতে নেই। এখন সাফল্যে না ফিরলে তাদের পক্ষে সেরা ছয়ে টিকে থাকাও মুশকিল হবে। এটিকে মোহনবাগান তবু ১৪টি ম্যাচ খেলার পরে চার নম্বরে। কিন্তু ওডিশা ছয়ে, অর্থাৎ খাদের কিনারায়।

এক সমস্যা মিটলেও অপর সমস্যা সমাধান-হীন

এত দিন এটিকে মোহনবাগানের সমস্যা ছিল চোট-আঘাত। সেই সমস্যা আপাতত মিটলেও তাদের গোলের সুযোগ নষ্টের সমস্যার কিছুতেই সমাধান হচ্ছে না। ম্যাচের পর ম্যাচ এত গোলের সুযোগ হাতছাড়া করছেন লিস্টন কোলাসোরা, যেগুলি কাজে লাগাতে পারলে গোলের বন্যা বইয়ে দিতে পারত সবুজ-মেরুন বাহিনী। মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধেই যেমন ছ-ছ’টা শট তিনকাঠির মধ্যে রেখেও গোল পাননি সবুজ-মেরুন তারকারা।

গত ম্যাচে চেন্নাইন এফসি-র বিরুদ্ধে ছ’টি শট গোলে রেখেও একটিও গোল করতে পারেননি এটিকে মোহনবাগান তারকারা। ব্রেন্ডান হ্যামিল সবচেয়ে সহজ দু’টি গোলের সুযোগ হাতছাড়া করেন। এ ছাড়া হুগো বুমৌস (২), দিমিত্রিয়স পেট্রাটস (৩), মনবীর সিংও (১) সুযোগ হাতছাড়া করে দলকে তিন পয়েন্ট এনে দিতে পারেননি। তবে শুধু গত দুটি ম্যাচে নয়, প্রায় প্রতি ম্যাচেই গোল মিসের প্রদর্শনী দেখছেন সমর্থকেরা।

পরিসংখ্যানও বলছে একই কথা। এ পর্যন্ত ১৪৮টি গোলের সুযোগ তৈরি করেছেন এটিকে মোহনবাগানের ফুটবলাররা। কিন্তু তাঁরা গোল পেয়েছেন ১৭টি। মুম্বই সিটি এফসি যেখানে ১৭৪টি সুযোগ পেয়ে ৪৫টি গোল করেছে, হায়দরাবাদ সিটি যেখানে ১৪৫টি সুযোগ পেয়ে ৩০টি গোল করেছে, কেরালা ব্লাস্টার্স যেখানে ১২৫টি সুযোগ থেকে ২৩টি গোল পেয়েছে, সেখানে এটিকে মোহনবাগানের কনভারশন রেট এত খারাপ হওয়াটা অবশ্যই চিন্তার বিষয়। কোচ হুয়ান ফেরান্দোর ধারণা, গোলের সুযোগ তৈরি করলে গোল আসবেই। কিন্তু চেন্নাইন এফসি দেখিয়ে দিয়েছে, গোলের সুযোগ তৈরি করলেই শুধু হয় না, গোল করতেও হয়, না হলে লিগ টেবলে পিছিয়ে পড়তে হয়। এই শিক্ষার পর নিশ্চয়ই নড়েচড়ে বসবে গতবারের সেমিফাইনালিস্টরা।

জয়ে ফেরার লড়াই ওডিশার

ওডিশা গত ম্যাচে বেঙ্গালুরুর কাছে ১-৩-এ হারার পর তাদের কোচ জোসেফ গোম্বাউ দায়ী করেন দলের ছেলেদের মনসংযোগের অভাবকে। সে দিন শুরুটা দুর্দান্ত করলেও বেঙ্গালুরু পরপর দু’টি গোল দিয়ে দেওয়ার ফলে দলটা মানসিক ভাবে বেশ পিছিয়ে পড়ে। ম্যাচের ২৫ থেকে ২৮ মিনিটের মধ্যে গোল খাওয়ার পরেই ছবিটা পুরো বদলে যায়।

কোচ নিজেই বলেছেন, “২৫ মিনিট পর্যন্ত ম্যাচ আমাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু ২৫ মিনিটে গোল খেতেই ছেলেদের মনসংযোগ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায় এবং তারা ২৮ মিনিটে আবার গোল খায়। এই দুটো পরপর গোলই প্রমাণ করে মানসিক দিক থেকে আমরা কতটা পিছিয়ে পড়ি। ফুটবলে এই ধরনের ভুল করলে তো তার মাশুল দিতেই হবে”।

দ্বিতীয়ার্ধে গোম্বাউয়ের দলের ছেলেরা কৌশল বদলে ফের আগ্রাসী হয়ে ওঠে এবং পেনাল্টি আদায় করে একটি গোল শোধ করে ঠিকই, কিন্তু বেঙ্গালুরু স্টপেজ টাইমে তৃতীয় গোলটি করে তাদের জয় সুনিশ্চিত করে ফেলে। স্টপেজ টাইমে গোল হয়ে গেলে ওডিশা কেন, বিশ্বের সেরা দলগুলির পক্ষেও তা শোধ করা বেশ কঠিন হয়ে ওঠে।

গত ছ’টি ম্যাচে মাত্র একটি জয় পাওয়া দলটি সম্প্রতি ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে যাওয়া অনিকেত যাদবকে পাকাপাকি ভাবে  নিজেদের শিবিরে সই করিয়েছে। শনিবারের ম্যাচ থেকেই তাঁকে মাঠে নামানোর পরিকল্পনা নিশ্চয়ই রয়েছে কোচের। কারণ, গত ম্যাচেই তিনি জানিয়ে দেন, পরবর্তী ছ’টি ম্যাচই তাঁর দলের কাছে ফাইনাল।

এটিকে মোহনবাগানের সুযোগ নষ্টের সমস্যাকে কী ভাবে কাজে লাগাতে পারবে তারা, এটাই এখন সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়। গোলের সুযোগ তৈরির (১২৭) দিক থেকে এটিকে মোহনবাগানের চেয়ে অনেক পিছিয়ে তারা। কিন্তু গোল করার (২১) দিক থেকে সবুজ-মেরুন বাহিনীর চেয়ে এগিয়ে তারা। তাদের ব্রাজিলীয় স্ট্রাইকার দিয়েগো মরিসিও (৮ গোল), নন্দকুমার শেখর (৫), পেদ্রো মার্টিন্স (৩), জেরি মাওইমিঙথাঙ্গা (৩)-রা গোলের মধ্যে রয়েছেন। সবুজ-মেরুন বাহিনীর চেয়ে তাদের কনভারশন রেট ভাল। তাদের এটা একটা বড় প্লাস পয়েন্ট হয়ে উঠতে পারে শনিবারের ম্যাচে।

ওডিশার থেকে মাত্র দুই পয়েন্ট বেশি পেয়ে লিগ টেবলের সেরা ছয়ে তাদের চেয়ে এগিয়ে এটিকে মোহনবাগান। এই ম্যাচে কলকাতার দলকে হারাতে পারলে তাদের টপকে যাবে ভুবনেশ্বরের দল। এটাই এখন সবচেয়ে বড় মোটিভেশন ওডিশা এফসি-র কাছে। গত ম্যাচের ভুলগুলি থেকে শিক্ষা নিয়ে যদি নিজেদের শুধরে জয়ের পারফরম্যান্স দেখাতে পারে তারা, তা হলে তো কথাই নেই। শনিবার যুবভারতীতে এটাই লক্ষ্য দিয়েগো মরিসিওদের।      

দ্বৈরথের ইতিহাস

হিরো ইন্ডিয়ান সুপার লিগের পরিসংখ্যান কিন্তু এগিয়ে রেখেছে এটিকে মোহনবাগান-কেই। দুই দল মুখোমুখি হয়েছে মোট পাঁচবার। তার মধ্যে দু’বার জিতেছে কলকাতার দল। বাকি তিনটিতে ড্র হয়। অর্থাৎ, ওডিশা এফসি এখন অবধি এটিকে মোহনবাগানকে হারাতে পারেনি। গত মরশুমে প্রথমবারের মুখোমুখি গোলশূন্য ভাবে শেষ হয়। দ্বিতীয় লেগও ড্র হয় ১-১-এ। কলকাতার দলের হয়ে গোল করেছিলেন জনি কাউকো। ২০২০-২১ মরশুমে দু’বারই জেতে এটিকে মোহনবাগান। প্রথমবার ১-০-য় ও দ্বিতীয়বার ৪-১-এ। দুই ম্যাচেই গোল করেন রয় কৃষ্ণা। দ্বিতীয় ম্যাচে রয়ের মতো জোড়া গোল ছিল মনবীর সিংয়েরও। চলতি মরশুমে প্রথম মুখোমুখিতে গোলশূন্য ড্র হয়।   

এটিকে মোহনবাগান স্কোয়াড: গোলকিপার- বিশাল কয়েথ, অর্শ শেখ, দেবনাথ মন্ডল; ডিফেন্ডার- আশিস রাই, ব্রেন্ডান হ্যামিল, স্লাভকো দামজানোভিচ, দীপক টাঙরি, প্রীতম কোটাল, রবি রাণা, শুভাশিস বোস, সুমিত রাঠি; মিডফিল্ডার- অভিষেক সূর্যবংশী, কার্ল ম্যাকহিউ, ইঙ্গসন সিং, হুগো বুমৌস, ফেদরিকো গালেগো, লালরিনলিয়ানা হ্নামতে, লেনি রড্রিগেজ, আশিক কুরুনিয়ান, রিকি সাবং; ফরোয়ার্ড- দিমিত্রিয়স পেট্রাটস, কিয়ান নাসিরি, লিস্টন কোলাসো, মনবীর সিং, মহম্মদ ফারদিন আলি মোল্লা।

কিক অফ- ২৮ জানুয়ারি, সন্ধ্যা ৭.৩০, কলকাতার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে

সম্প্রচার- স্টার স্পোর্টস নেটওয়ার্ক, হটস্টার ও জিও টিভি