উত্তর-পূর্বের পাহাড় থেকে হিরো আইএসএলের সর্বোচ্চ শিখরে— বিপিন সিং ও লালেঙমাউইয়া রালতে সম্পর্কে এক লাইনে বলতে গেলে এটাই বোধহয় সবচেয়ে উপযুক্ত কথা। এ বারের হিরো আইএসএলের দুই সেরা আবিষ্কার এই জোড়া প্রতিভা, যে দু’জনকে নিয়ে দুবাই রওনা হতে চলেছেন ভারতীয় দলের কোচ ইগর স্টিমাচ।

শনিবার ফতোরদার জওহরলালা নেহরু স্টেডিয়ামে হিরো আইএসএল ৭-এর ফাইনালে ৯০ মিনিটে তাঁর করা গোলেই প্রথম আইএসএল খেতাব জিতে নেয় মুম্বই সিটি এফসি। ওডিশা এফসি-র বিরুদ্ধে তাদের ৬-১ জয়ে যে হ্যাটট্রিক করেছিলেন বিপিন, সেটা অনেক বেশি রোমহর্ষক হলেও এই গোলটা সেই হ্যাটট্রিকের চেয়েও দামী।

ক্ষিপ্রতাই বিপিনের প্রতীক

মাঠে বাইশজন ফুটবলারের মধ্যে তাঁকে খুঁজে বার করাটা মোটেই কঠিন কাজ নয়। যদিও বা কেউ অন্য কারও সোনালী চুলের সঙ্গে তাঁকে গুলিয়ে ফেলেন, তা হলে তাঁর ক্ষিপ্র গতি ঠিক জানান দেবে, তিনি আর কেউ নন, মণিপুরের পাহাড়ি চিতা বিপিন সিং।

আট বছর বয়স থেকে যখন ফুটবল শুরু করেন বিপিন, তখন থেকেই তিনি নাকি এ রকমই ক্ষিপ্র। ভীড়ের মধ্যে থেকে ছিটকে বেরিয়ে গিয়ে গোল করাটা তাঁর ‘সিগনেচার মুভ’। যা দিয়ে বিপিনকে চেনা যায়। ছোটবেলায় ওয়াঙ্গোই-এর ক্লাবের কোচ তাঁকে লেফটব্যাক হিসেবে খেলালেও বাঁ দিকের উইং দিয়ে উঠে বারবার বিপক্ষের গোল এরিয়ায় ঢুকে পড়তেন তিনি। যার জন্য বহুবার বকাও খেতে হয়েছে বিপিনকে।

যখন অনূর্ধ ১৪ দলে ডাক পেলেন, তখন তাঁর এই গতি ও প্রবণতাই সবচেয়ে কার্ষকরী হয়ে ওঠে। এখান থেকেই উইঙ্গার বিপিন সিংয়ের শুরু। পরবর্তীকালে শিলং লাজং, এটিকে ও মুম্বই সিটি এফসি যে ক্লাবেই খেলেছেন, সেখানকার কোচেরা বিপিনের এই বৈশিষ্টকেই কাজে লাগিয়েছেন।

জহুরি সের্খিও লোবেরা

গতবার মুম্বইয়ের দলের কোচ জর্জ কোস্টা বিপিনকে যে ভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিলেন, এ বার সের্খিও লোবেরা তাঁকে অন্য ভাবে কাজে লাগান। কোস্টা তাঁকে লেফট উইঙ্গার ও লেফট ব্যাকের গণ্ডী থেকে বেরতে দিতে চাইতেন না। লোবেরা বিপিনের গতি ও ক্ষিপ্রতা দেখে তাঁকে দলের অ্যাটাকিং মিডফিল্ডে রাখার সিদ্ধান্ত নেন এবং এতেই বাজিমাত করে দেন বিপিন।

হিরো আইএসএলের মাঝামাঝি সময়ে বিপিনকে বলতে শোনা যায়, “আমার গতি বেশি এবং আমি সেটাকে কাজে লাগাই ঠিকই। কিন্তু আমার সবচেয়ে বড় সুবিধা আমি আমার দুটো পা-কেই সমান ভাবে কাজে লাগাতে পারি। এর ফলে আমি বাড়তে আত্মবিশ্বাস পাই”। তাঁর এই আত্মবিশ্বাসই লোবেরার মূলধন হয়ে ওঠে। তিনি শুধু বাঁদিকে নয়, ডানদিক দিয়েও আক্রমণ করার পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে দেন।

শনিবার দলকে ট্রফি এনে দেওয়ার গোলটা করার পরে ২৬ বছর বয়সি বিপিন বলেন, “গোল করে দলকে জেতানো শুধু নয়, দলকে চ্যাম্পিয়ন করার অনুভূতিটাই আলাদা। আমেজিং। দারুণ লাগছে। মনে হচ্ছে জীবনের সেরা অনুভূতি এটাই”।  কোচ লোবেরার কাছ থেকে যে মানসিক সমর্থনটুকু পেয়েছেন, তাতেই তাঁর খেলা অনেকটা খুলে গিয়েছে বলে স্বীকার করে নেন বিপিন। বলেন, “কোচ আমাকে সব সময়ই বলেন, বল পায়ে রেখে খেলো। চেষ্টা করো গোল তৈরির। দু-একবার ভুল হলেও কোনও অসুবিধা নেই। চেষ্টা করে যাও। কোচের কাছ থেকে এই ভরসা পাওয়াটা বড় ব্যাপার। উনি সবসময়ই আত্মবিশ্বাস জুগিয়ে যান”।

আসল ভূমিকায় ফেরা

২০১৭-য় এটিকে-র জার্সি গায়ে হিরো আইএসএলে ১২টি ম্যাচে দু’টি গোল করেন ও একটি অ্যাসিস্ট করেন। তার পরের বছরেই মুম্বই সিটি এফসি তাঁকে নিয়ে আসে। কিন্তু সেই রক্ষণের দায়িত্বে। “রক্ষণের দায়িত্ব সামলাতে সামলাতে আমি তখন মানসিক ভাবে কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। আক্রমণে ওঠার সুযোগ পেলেও যাওয়ার সাহস হত না। লোবেরা স্যর এসে সেই আত্মবিশ্বাসটা ফিরিয়ে দেন আমাকে”, বলেন বিপিন।

যার ফল, হ্যাটট্রিক সহ পাঁচ গোল এবং চারটি অ্যাসিস্ট। ভারতীয়দের মধ্যে তাঁর মতো কার্যকরী ফুটবলার বড় একটা পাওয়া যায় না বলেই ভারতীয় দলের কোচ ইগর স্টিমাচ তাঁকে দুবাইগামী ২৭ জনের দলে রেখে দিয়েছেন। আশা করা যায় প্রথম এগারোতেও হয়তো থাকবেন বিপিন।

শিলং লাজংয়ে তাঁর কোচের দায়িত্বে থাকা থাঙবোই সিঙতোর মতে, “লাজংয়ে ওর কৌশলগত সমস্যা ছিল। কোন সময়ে কী করা উচিত, ঠিকমতো সিদ্ধান্ত নিতে পারত না। হিরো আইএসএলে এসে ভাল কোচেদের হাতে পড়ে বিপিন সেই সমস্যা দ্রুত কাটিয়ে উঠে অনেক উন্নতি করে। ভাল কোচ, সতীর্থ, পরিবেশ, উন্নত সরঞ্জাম, মাঠ পেয়ে নিজেকে উন্নত করার ইচ্ছাটা ওর আরও প্রবল হয়ে ওঠে। একজন প্রতিভাবান ফুটবলার ভাল মানের প্রশিক্ষণ পেলে যা হয়, বিপিনের ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে”। এ বার হয়তো নিজেকে আন্তর্জাতিক ফুটবলে মেলে ধরার সুযোগ পাবেন বিপিন। নিজেকে আরও উন্নত করো তোলার চেষ্টা করবেন নিশ্চয়ই।

বালোতেলি-ভক্ত আপুইয়া

একই কথা লালেঙমাউইয়া রালতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। খটমট নাম বলে আদরের নাম আপুইয়া বলেই ডাকা হয় তাঁকে। ২০ বছর বয়সি মিজোরামের এই মিডফিল্ডার এতটাই মনে ছাপ ফেলার মতো ব্যক্তিত্ব যে নর্থইস্ট ইউনাইটেডের কোচ জেরার নুস তাঁকে দু’টি ম্যাচে দলের নেতৃত্বের ভারও দিয়ে দেন। হিরো আইএসএলের ইতিহাসে এর আগে ২০ বছর বয়সে কেউ অধিনায়কত্ব করেননি।

নুস দায়িত্ব ছেড়ে চলে গেলেও ভারপ্রাপ্ত কোচ খালিদও তাঁকে সমান গুরুত্ব দিতেন দলে। তার প্রতিদানও দিয়েছেন লালেঙ। দলকে সেমিফাইনালে তোলার নেপথে তাঁর অবদান কিছু কম ছিল না। তাই তাঁর এ বছর হিরো আইএসএলের সেরা উঠতি ফুটবলারের পুরস্কার পাওয়ার মধ্যে কোনও বিতর্ক নেই।

প্রথম এগারোর মাঝমাঠে অটোমেটিক চয়েস ছিলেন তিনি। মাঝমাঠে ৪৫ নম্বর জার্সির ছেলেটি থাকা মানেই বিপক্ষের ফুটবলাররা তাঁকে সমীহ করেছে ম্যাচের পর ম্যাচ। ৪৫ নম্বরটা তাঁর নিজেরই পছন্দের। মারিও বালোতেলিকে দেখে। সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আপুইয়া এই নিয়ে বলেছেন, “বালোতিলে আমার প্রিয় ফুটবলার। ওঁর আত্মবিশ্বাস দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। কখনও দিশাহীন হয়ে যায় না বা মাথা গরম করে না। ওঁর জন্যই জার্সিতে ৪৫ নম্বরটা আমার পছন্দ”।

ম্যাঞ্চেস্টার সিটির প্রাক্তন ফরোয়ার্ডের খেলার স্টাইলের সঙ্গে যদিও আপুইয়ার খেলার ধরণ মেলে না। তবে যে জায়গাটায় মেলে, তা হল তাঁর আত্মবিশ্বাস ও হাল না ছাড়ার প্রবণতা। বল পায়ে এলে তিনি কাউকে ভয় পান না বা পরেয়া করেন না। বিপক্ষের প্রবল চাপ সামলেও তাদের রক্ষণের বুক চিরে ফরোয়ার্ডদের গোলের পাস দেওয়ার ঘটনা বহুবার ঘটিয়েছেন সদ্য টিন-এজ পেরিয়ে আসা এই ছেলেটি।

এ বার লক্ষ্য দেশের জার্সি

গোলের সুযোগ তৈরি করেন, নিজে বড় একটা গোল করেন না। কিন্তু কেরালা ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে তাদের দ্বিতীয় লেগের ম্যাচে যে গোলটা করেন লালেঙমাউইয়া, তা ছিল রীতিমতো বিশ্বমানের। মাঝমাঠে বল পেয়ে নিজের মার্কারকে ছিটকে ফেলে দিয়ে দ্রুত এগিয়ে বক্সের অনেকটা বাইরে থেকে দূরপাল্লার যে শটটা পোস্টের নীচের দিকে লেগে গোলে ঢোকে, সেটা মরশুমের সেরা দশটি গোলের মধ্যে রাখা যায় অনায়াসে। এই ম্যাচে জয়ের ফলেই সেমিফাইনালে জায়গা পাকা করে নেয় নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি। বালোতেলিও দূরপাল্লার শটে গোল করার জন্য বিখ্যাত।

আইএসএল চলাকালীন ইগর স্টিমাচের মেসেজ আসে তাঁর কাছে। সেই মেসেজ নিয়ে লালেঙ বলেন, “ওঁর মেসেজ পেয়ে আমি চমকে যাই। উনি জানান, আমাকে ওঁর ভারতীয় শিবিরে রেখেছেন। কী ভাবে আমি ওঁকে সাহায্য করতে পারি, তাও জানতে চান। আমি ওঁকে জানাই, আমার ওপর যে আস্থা রেখেছেন উনি, তার যথাযথ দাম আমি দেব। এখনও আমার কিছুই পাওয়া হয়নি। সুযোগ পেলে দেশকে গর্বিত করার জন্য নিজেকে উজাড় করে দেব”।

অনূর্ধ্ব ১৭ বিশ্বকাপে ভারতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন আপুইয়া। এ বার তাঁর নজর আরও উঁচুতে। সেই সুযোগটাও পেয়ে গিয়েছেন তিনি। স্টিমাচ তাঁকে দুবাইগামী দলে রেখেছেন। এ বার নিজেকে প্রমাণ করার পালা।