অনুশীলনে এটিকে মোহনবাগানের খেলোয়াড়রা অনেকে একে অপরের সঙ্গে কথা বলছেন, হাসি ঠাট্টাও করছেন। কিন্তু একজনকে দেখা গেল মুখ বুজে পরিশ্রম করে যেতে। কেউ কোনও কিছু বললে তবেই এক কথায় জবাব দিচ্ছিলেন তিনি। এ ছাড়া মুখে কুলুপ এঁটেছেন বললেই বোধহয় সঠিক বলা হয়। তিনি আর কেউ নন, লিস্টন কোলাসো, গত মরশুমে যিনি হয়ে উঠেছিলেন এটিকে মোহনবাগানের গোলমেশিন।

বৃহস্পতিবার বিকেলের দৃশ্য এটি। একটু আগেই সাংবাদিক বৈঠকে চোখা চোখা প্রশ্ন শুনতে হয়েছে কোলাসোকে। তিনিও পাল্টা ও জুতসই জবাব দিয়েছেন সকলকে। কিন্তু মুখে যাই বলুন, নিজের গোলখরায় যে মোটেই সন্তুষ্ট নন, তা অনুশীলনে তাঁর শরীরি ভাষা দেখলেই বোঝা যাচ্ছিল। মনমরা নন, বরং চোয়াল শক্ত। সাংবাদিক বৈঠকে একের পর এক প্রশ্নবাণ শোনার পরে যেন চ্যালেঞ্জটা জিততে আরও মরিয়া হয়ে উঠেছেন গোয়ানিজ ফরোয়ার্ড। গোল তাঁকে পেতেই হবে। এক নয়, একাধিক। সেই লক্ষ্যেই যে অক্লান্ত ও নীরব পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, তা জানিয়েও দিলেন।  

গলায় অভিমানের সুর স্পষ্ট। বললেন, “আসলে সবাই আমার গোলের কথাই ভাবে, আমি দলকে খেলায় কী ভাবে সাহায্য করছি, সেটা দেখে না। গত বছর আট গোল করেছিলাম, এ বারও আমার অনেক গোল করা উচিত, এটা ঠিকই। এই মরশুমটা আমার ভাল যাচ্ছে না, এটাও মেনে নিচ্ছি। কিন্তু আমার কাছ থেকে দল যেটা চাইছে, সেটা দিতে পারছি কি না, সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ক’টা গোল করলাম, সেটা বড় কথা নয়। দলের জয়টাই বড় কথা, সে আমি গোল করি বা না করি। তবু আমি চেষ্টা করছি, পরিশ্রম করছি, যাতে আরও বেশি গোল করতে পারি”।

চলতি হিরো আইএসএলে এ পর্যন্ত ৪৯৮ মিনিট মাঠে থেকে মাত্র একটি গোল পেয়েছেন কোলাসো ও তিনটি গোলে প্রত্যক্ষ সাহায্য করেছেন। গত মরশুমে ২২টি ম্যাচে আট গোল পাওয়া কোলাসোর কাছে সমর্থকদের প্রত্যাশা অনেক বেশি। সেই প্রত্যাশার চাপই হয়তো নিতে পারছেন না তিনি। এমন এমন সব গোল মিস করছেন, যা ইদানীং তাঁকে করতে দেখা যায়নি। তবে এই নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নন কোলাসো। এ জন্য বাড়তি চাপ নিতেও চান না। বরং কিছুটা হলেও ভাগ্যকে দুষছেন।

এই প্রসঙ্গে ২৪ বছর বয়সি ফরোয়ার্ড বলেন, “সবাই গোলের সুযোগ  মিস করে। বিশ্বের সেরা ফুটবলারদেরও সুযোগ নষ্ট করতে দেখা যায়। কে বেশি সুযোগ তৈরি করছে, সেটাই দেখা উচিত। এটা ঠিকই যে, আমাকে আরও পরিশ্রম করতে হবে। কিন্তু সহজ সুযোগ নষ্ট করছি, এই কথাটা ঠিক নয়। এই মরশুমে যে খুব খারাপ খেলছি তা নয়। তবে আশা করি তাড়াতাড়িই সেরা ফর্মে ফিরব। আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিছুটা ভাগ্যের সহায়তাও প্রয়োজন, যেটা এখন আমি পাচ্ছি না। আশা করি, শীঘ্রই গোলে ফিরব। হয়তো পরের ম্যাচেই গোল পাব”।

পরিসংখ্যান বলছে, চলতি লিগে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি গোলে শট (১৮) নিয়েছেন মুম্বই সিটি এফসি-র গ্রেগ স্টুয়ার্ট। এই তালিকায় স্টুয়ার্টের পরেই রয়েছেন তাঁর সতীর্থ বিপিন সিং। তিন নম্বরে রয়েছেন লিস্টন কোলাসো, যাঁর গোলমুখী শটের সংখ্যা ১০। কিন্তু গ্রেগ স্টুয়ার্টের মতোই অবস্থা কোলাসোর। স্টুয়ার্ট এতগুলো শট গোলে রাখতে পারলেও জালে বল জড়াতে পেরেছেন মাত্র দু’বার। অর্থাৎ সাফল্যের শতকরা হার মাত্র ১১ শতাংশ। সেখানে কোলাসোর সাফল্যের হার ১০ শতাংশ। বরং বিপিনের সাফল্যের হার অনেক ভাল, প্রায় ৩১ শতাংশ।

কিন্তু কী করে গোল পাবেন কোলাসো? দেখা যাচ্ছে, প্রতিপক্ষের গোল এরিয়ায় অনেকক্ষণ পায়ে বল রাখছেন তিনি। যার ফলে প্রতিপক্ষ তাদের রক্ষণ গুছিয়ে নেওয়ার যথেষ্ট সময় পেয়ে যাচ্ছে এবং গোলের মুখও ক্রমশ বন্ধ করে দিচ্ছে। সম্প্রতি তাঁকে নিয়ে এমনই অভিযোগ উঠছে। যা মানতে রাজি নন তিনি। তাঁর ব্যাখ্যা আগের মতোই সব কিছু আছে, শুধু আত্মবিশ্বাসের অভাব হচ্ছে।

তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের জবাব দিয়ে কোলাসো বলেন, “বল পায়ে থাকলেই আমি বেশি ভাল খেলি। এটাই আমার গুণ বলতে পারেন। গত মরশুমেও এটাই করেছিলাম। কিন্তু তখন সফল হয়েছি বলে কেউ কিছু বলেনি। এই মরশুমটা ভাল যাচ্ছে না আমার। তাই অনেকের হয়তো এরকমই মনে হচ্ছে। তার মানে এই নয় যে, আমি অনেকক্ষণ বল পায়ে রাখছি। শুধু আত্মবিশ্বাসের অভাব হচ্ছে। আশা করি, আসন্ন ম্যাচগুলোতে সেই হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পাব”।

সবুজ-মেরুন বাহিনীর কোচ হুয়ান ফেরান্দো মনে করেন গোল নয়, কোলাসোর উপস্থিতিই দলকে বেশি চাঙ্গা করে তোলে। চলতি মরশুমেই একাধিকবার দলকে চাঙ্গা করার জন্য তিনি তাঁকে কাজে লাগিয়েছেন বলেও জানান তিনি, “ওর মধ্যে যে অফুরান প্রাণশক্তি রয়েছে, তা দলের ওপর দারুন প্রভাব ফেলে। ও হল আমাদের দলের ব্যাটারি। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওর মুখে যখন হাসি লেগে থাকে, তখন দলের অন্যদেরও দারুন মেজাজে পাওয়া যায়”।

এই দু’বছরে লিস্টনকে যিনি এই জায়গায় নিয়ে আসার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন, সেই ফেরান্দো সম্প্রতি হিরো আইএসএলের ওয়েবসাইটকে বলেন, “আমার মনে হয়, লিস্টন ফুটবলে আক্রমণ ও রক্ষণের ধারণাটা বোঝার চেষ্টা করে সব সময়। কোন সময় বিপক্ষের ওপর চাপ বাড়াতে হবে, কখন ফাঁকা জায়গা কাজে লাগিয়ে আক্রমণে উঠতে হবে, কখন সতীর্থদের কাছাকাছি আনতে হবে এবং পায়ে বল রাখতে হবে, এগুলো ভাল বোঝে ও। এই মরশুমে এগুলো খুব বেশি করে দেখা যাচ্ছে ওর মধ্যে”।

কোলাসো গোল না পেলেও তাঁর দল অবশ্য বেঙ্গালুরু এফসি-র বিরুদ্ধে ম্যাচের আগে ফুরফুরে মেজাজে রয়েছে। শনিবারই সেই ম্যাচ। প্রতিপক্ষে রয় কৃষ্ণা, সন্দেশ ঝিঙ্গন, প্রবীর দাস, হাভিয়ে হার্নান্ডেজের মতো প্রাক্তন সবুজ-মেরুন তারকা। তাঁদের বিরুদ্ধে সবুজ-মেরুন বাহিনী আত্মবিশ্বাসী তো বটেই, উজ্জীবিতও।  কোলাসো নিজেই সে কথা জানিয়ে বলেন, “আত্মবিশ্বাস একই জায়গায় রয়েছে। তবে এখন আমরা আরও উজ্জীবিত। এফসি গোয়ার কাছে হারের পর নিজেদের পারফরম্যান্স নিয়ে খুবই অখুশি ছিলাম। পরের অনুশীলনগুলোতে আমরা ক্রমশ উন্নতি করেছি। ধাপে ধাপে উন্নতি করাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বেঙ্গালুরুর বিরুদ্ধে আমরা একই রকম আত্মবিশ্বাস নিয়ে নামব এবং তিন পয়েন্ট পাওয়ার জন্য ঝাঁপাব”।