দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে আন্তর্জাতিক ফুটবলে টিকে থাকাটা যে কতটা কৃতিত্বের, তা তাঁকে দেখলে বোঝা যায়। সাফল্যের দিক থেকে ভারত আন্তর্জাতিক ফুটবল মানচিত্রে তেমন উজ্জ্বল না হলেও ফুটবল বিশ্বের আকাশে যে তিনি অন্যতম নক্ষত্র, এ কথা বলাটা বোধহয় খুব একটা বাড়াবাড়ি হবে না।

কয়েক দিন আগেই বর্তমান ফুটবলারদের মধ্যে সর্বোচ্চ গোলদাতাদের তালিকায় দু’নম্বরে জায়গা করে নিলেন সুনীল ছেত্রী। প্রাক্তন ও বর্তমান মিলিয়ে যদি তালিকাটা তৈরি করা হয়, তা হলেও তিনি সম্ভবত প্রথম দশে থাকবেন। ভারতীয় ফুটবলের কিংবদন্তি তিনি। পরিসংখ্যানের দিক থেকে ভাইচুং ভুটিয়া, আই এম বিজয়ন, পিকে ব্যানার্জি, শৈলেন মান্নার চেয়ে এগিয়ে তিনি। সাফল্যের দিক থেকেও।  

শনিবার আন্তর্জাতিক ফুটবলে ১৬ বছর পূর্ণ করলেন ৩৬ বছর বয়সি এই ফুটবল কিংবদন্তি। ২০০৫-এর এই ১২ জুনেই ভারতের জার্সি গায়ে প্রথম মাঠে নেমেছিলেন সুনীল। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, সেখানকার কোয়েটায়।  দেশের হয়ে অভিষেকের ক্ষেত্রে এই একটা ব্যাপারে অদ্ভুত মিল রয়েছে সুনীল ও শচীন তেন্ডুলকরের। শচীনেরও আন্তর্জাতিক অভিষেক ঘটেছিল পাকিস্তানেই।

আন্তর্জাতিক ফুটবলে এতগুলো বছর কাটিয়ে দেওয়া প্রসঙ্গে আবেগপ্রবণ সুনীল বলেছেন, “অসাধারণ অভিজ্ঞতা। এতগুলো বছর দেশের হয়ে খেলা, এতগুলো ম্যাচে মাঠে নামা, দুর্দান্ত। কখনও স্বপ্নেও ভাবিনি। আমার পরিবারের সদস্যরা, আত্মীয়-বন্ধুরা, সতীর্থ খেলোয়াড়, কোচ, ট্রেনাররা, ফিজিও, ডাক্তাররা ছাড়া এই জায়গায় এসে পৌঁছতে পারতাম না। যেটুকু সাফল্য পেয়েছি, তাতে এঁদের প্রত্যেকের অবদান সমান”। সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শনিবার সুনীল বলেছেন এ কথা।

সে বছর জুনে তিনটি ম্যাচের আমন্ত্রণী সফরে গিয়েছিল ভারত। সেই সফরেই ২০ বছর বয়সি সুনীলকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ভারতীয় দলের সঙ্গে। সেই দলের কোচ ছিলেন সুখবিন্দর সিং ও অধিনায়ক ছিলেন সম্মুগম ভেঙ্কটেশ, যিনি এখন ভারতীয় দলের সহকারী কোচ। প্রথম ম্যাচেই মাঠে নামার সুযোগ পেয়ে যান সুনীল এবং প্রথম ম্যাচেই গোল। ৬৫ মিনিটে গোল করেন তরুণ ‘ডেবিউটান্ট’। তবে তাঁর গোলে ভারত জিততে পারেনি। ৮১ মিনিটে পাকিস্তানি ফরোয়ার্ড মহম্মদ এসা গোল শোধ করে দেওয়ায় তা ড্র হয়ে যায়।

এমন স্মরণীয় দিনে ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সুনীল বলেন, “আমার বাবা বেশিরভাগ সময়েই বাইরে থাকতেন। তাই আমি আর দিদি মায়ের সঙ্গেই বেশি সময় কাটাতাম। তাই যা কিছু শিখেছি, যে ভাবে বড় হয়েছি, তাতে আমার মায়ের অবদানই বেশি। একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। দিল্লির প্রবল গরমে দুপুরে আমার সঙ্গে কেউ ফুটবল খেলতে চাইত না। তিনটে-চারটের সময় কেউ বাড়ি থেকে বেরোতেই পারত না। কারণ, দুপুরে প্রায়ই লু বইত। তাই মা-কে গিয়ে সেই অভিযোগ জানাই ও মা আমার সঙ্গে প্রায়ই মাঠে যেতেন। গরমের ছুটিতে ১০-১৫ দিন রোজ দুপুরে মায়ের সঙ্গে ফুট-টেনিস খেলতাম। তখন এটা আমার কাছে স্বাভাবিক লাগত। কিন্তু পরে বুঝি, বন্ধুর অভাবেও যাতে আমার ইচ্ছা পূরণ হয়, সে জন্যই মা আমার সঙ্গ দিতেন। দু-একবার নয়, মায়ের সঙ্গে আমার ভলিবল বা ফুটবল খেলা নিয়মিত ব্যাপার ছিল। হার না মানার প্রবণতাটা মায়ের থেকেই আমার মধ্যে এসেছে”।

সুনীল ছেত্রীর আগে ভারতীয় ফুটবলের সেরা তারকা ছিলেন ভাইচুং ভুটিয়া। সিকিমের ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম থেকে উঠে আসা সেই তারকার সঙ্গে খেলেই বড় হয়েছেন সুনীল। ভাইচুংয়ের আন্তর্জাতিক ফুটবল জীবন ১৭ বছরের। তবে সুনীলের চেয়ে অনেক কম ম্যাচ খেলেছেন তিনি। আর এক কিংবদন্তি ফুটবলার আইএম বিজয়নও দেশের হয়ে খেলেছেন প্রায় ১৪ বছর। তবে সুনীলের কেরিয়ারের শুরুর দিকটাই ছিল বিজয়নের জীবনের ফুটবল জীবনের শেষাংশ। তাই তাঁকে সে ভাবে না পেলেও ভাইচুংয়ের সান্নিধ্য সুনীল অনেক বছর ধরেই পেয়েছেন। ‘পাহাড়ী বিছে’-র প্রভাব যে তাঁর ফুটবল জীবনে অনেকটাই রয়েছে তা স্বীকার করতে দ্বিধা  নেই তাঁর। 

ভাইুচুং-অধ্যায় নিয়ে সুনীল এই সাক্ষাৎকারে বলেন, “অনেক কিছু শিখেছি ভাইচুংদার কাছ থেকে। ওঁর যে ব্যাপারটা আমার সবচেয়ে ভাল লাগত, তা হল উনি খুবই ‘ডাউন টু আর্থ’। আমাদের ক্যাপ্টেন ছিলেন, আমাদের দলের সবকিছু। কিন্তু ওঁকে সহজেই পাওয়া যেত। প্রত্যেকের সঙ্গেই উনি কথা বলতেন, সবার সমস্যার কথা শুনতেন। নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতেন আমাদের। কোথায় ভুল করছি আমরা, তাও বুঝিয়ে দিতেন। মাঠের ভেতরে তো বটেই, মাঠের বাইরের ভুলগুলোও বলতেন। অন্যান্য সিনিয়ররাও খুব ভাল ছিলেন। সবার কাছ থেকেই শিখেছি অনেক কিছু। তবে ভাইচুংদার চেয়ে ভাল কেউ ছিলেন না”।

ভাইচুংয়ের মানসিকতার প্রশংসা করে সুনীল বলেন, “ওঁর মানসিকতা ছিল বুলেটপ্রুফ। হাল ছাড়ার কোনও লক্ষণ ওঁর মধ্যে দেখিনি কখনও। প্রথম চ্যালেঞ্জ, প্রথম ট্যাকলের ক্ষেত্রে সব সময়ই ভাইচুংদাই এগিয়ে যেতেন। হারের মুখেও লড়াইয়ের ব্যাপারে এক নম্বরে থাকতেন। যখন দেখতাম ওঁর মতো একজন সিনিয়র দিন-রাত এক করে পরিশ্রম করছেন, তখন দলের অন্যান্যদের মধ্যেও তার প্রভাব পড়ত। এখন যারা ৯ নম্বর জার্সি পরে খেলতে নামে, তাদের বলি ওঁর কথা। ভাইচুংদার মতো ফুটবলে নিবেদিত প্রাণ ও ক্ষুধার্ত আর কাউকে দেখিনি”।

গোলদাতা হিসেবে তাঁর মতো সফল যে এই দেশে আর কেউ নেই, তা তাঁর পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে। ২০১৩ থেকে বেঙ্গালুরু এফসি-র হয়ে খেলছেন তিনি। দেড়শো ম্যাচ খেলেছেন তিনি এই ক্লাবের হয়ে। ৬৮টি গোল করেছেন। কলকাতার দুই প্রধানেও খেলেছেন সুনীল। ক্লাব কেরিয়ারের প্রথম তিন বছর (২০০২-০৫) মোহনবাগানেই কাটিয়েছিলেন। পরে ২০১১-১২ মরশুমে ফের সবুজ মেরুন শিবিরে যোগ দেন। ইস্টবেঙ্গলেও ছিলেন একটিমাত্র মরশুম (২০০৮-০৯)। দুই প্রধানের হয়ে সব মিলিয়ে ২৫টি গোল করেছেন। জেসিটির হয়েও ২১টি গোল রয়েছে সুনীলের। বসব মিলিয়ে ক্লাব ফুটবলে প্রায় ১৪০টি গোল করেছেন তিনি। আর দেশের সিনিয়র দলের হয়ে খেলে যে ৭৪টি গোল হয়ে গিয়েছে তাঁর, তা তো এখন সবারই জানা।

‘গোলস্কোরার’ হিসেবে তাঁর সাফল্যের রহস্য জানতে চাইলে সুনীল বলেন, “প্রচুর অনুশীলন ও খিদে। এই দুটোই আসল। যদি আমি না মনে করি যে আমি গোল করব, তা হলে কাজটা কঠিন হয়ে যায়। দক্ষতা, প্রতিভা, পরিশ্রম যতই থাকুক, গোল করার ইচ্ছেটা খুবই প্রয়োজন। আমি গোল করবই, এটা আমাকে ভাবতে হবে। আমি গোল করছি, চোখের সামনে এই ছবিটা বারবার ভাসিয়ে তুলতে হবে। সারা দুনিয়ায় যত সফল গোলস্কোরার রয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকেরই এই বৈশিষ্টটা থাকে। দল হারলে তো আমাকে গোল করতেই হবে। দল ৬-০ জিতলেও আমার গোল করার ইচ্ছেটা বিন্দুমাত্র কমে না”।