ফের এসে গেল ভারতীয় ফুটবলের সেরা উৎসব ইন্ডিয়ান সুপার লিগ এবং এ বছর মে-র প্রথম সপ্তাহে যেখানে শেষ হয়েছিল লিগের দশম মরশুম, শুক্রবার সন্ধ্যায় সেখান থেকেই শুরু হতে চলেছে একাদশ মরশুমের অভিযান।

মাস চারেক আগে, ৪ মে-র সেই সন্ধ্যার কথা কার না মনে আছে? বিশেষ করে মোহনবাগান এসজি ও মুম্বই সিটি এফসি সমর্থকদের তো মনে থাকবেই। আইএসএল ১০-এর ফাইনাল। সে দিন যুবভারতী ক্রীড়ঙ্গনে প্রথমে ৪৪ মিনিটের মাথায় জেসন কামিংসের গোলে এগিয়ে যায় কলকাতার দল। দ্বিতীয়ার্ধে, ৫৩ মিনিটের মাথায় জর্জ পেরেইরা দিয়াজ সমতা আনেন এবং ৮১ মিনিটের মাথায় বিপিন সিং ব্যবধান বাড়ান। বাড়তি সময়ের সাত মিনিটের মাথায় জাকুব ভইতুস মুম্বইয়ের জয় সুনিশ্চিত করে। 

তার তিন সপ্তাহ আগেই লিগের শেষ ম্যাচে যে মুম্বইকে নিজেদের মাঠে হারিয়ে শিল্ড জিতে নিয়েছিল মোহনবাগান এসজি, সেই মুম্বই প্লে অফ ফাইনালে নিজেদের পারফরম্যান্সে অভাবনীয় উন্নতি ঘটিয়ে কাপ জিতে মাঠ ছাড়ে। প্রথমার্ধে মোহনবাগান দাপুটে পারফরম্যান্স দেখালেও দ্বিতীয়ার্ধে ঘুরে দাঁড়ায় অতিথিরা। 

শুক্রবার সন্ধ্যায় ফের সেই দ্বৈরথ দিয়েই শুরু হচ্ছে আইএসএলের এগারো নম্বর মরশুম। বরাবরই কলকাতার ঐতিহ্যবাহী সবুজ-মেরুন বাহিনীর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী তাদের প্রতিবেশী ক্লাব ইস্টবেঙ্গল এফসি। কিন্তু আইএসএলের গ্রহে প্রবেশ করার পর থেকে আর এক চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর খোঁজ পেয়েছে তারা, মুম্বই সিটি এফসি। দুই দলের মধ্যে দশবার লড়াই হয়ে গিয়েছে আইএসএলে। এই দশবারের মধ্যে মাত্র একবার জিতেছে মোহনবাগান। গত মরশুমে সেই জয়ই তাদের এনে দেয় লিগের একমাত্র শিল্ড জয়ের আনন্দ। কিন্তু মুম্বইয়ের দলের বিরুদ্ধে তাদের সামগ্রিক পরিসংখ্যান মোটেই আনন্দদায়ক নয়। 

তাই মুম্বই সিটি এফসি-কে সামনে পেলেই প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছা করে সবুজ-মেরুন সৈনিকদের। যদিও কখনও তা প্রকাশ করেন না তাদের কোচ-খেলোয়াড়রা। এ বারেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। বদলার কথা মুখে না বললেও তাদের দ্বৈরথের পরিসংখ্যানে অবশ্যই বদল চান মোহনবাগানীরা। শুক্রবার ঘরের মাঠে নিজেদের সমর্থকদের সামনে মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে খেলতে নেমে পরিসংখ্যানে সেই বদল আনতে পারবে কি না তারা, সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। 

এ মরশুম শুরুর আগে ঢেলে দল সাজিয়েছেন মোহনবাগানের নতুন কোচ হোসে মোলিনা। অস্ট্রেলিয়ান ফরোয়ার্ড জুটি দিমিত্রিয়স পেট্রাটস ও জেসন কামিংসের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার আর এক নামী ফরোয়ার্ড জেমি ম্যাকলারেন এবং স্কটিশ মিডফিল্ডার গ্রেগ স্টুয়ার্ট। স্প্যানিশ সেন্টার ব্যাক আলবার্তো রড্রিগেজকে সই করিয়েছে তারা। অভিজ্ঞ স্কটিশ ডিফেন্ডার টম অ্যালড্রেডও যোগ দিয়েছেন মোহনবাগান শিবিরে। 

দেশীয় ফুটবলারদের মধ্যে দুর্দান্ত মিডফিল্ডার আপুইয়াকে এই মুম্বই সিটি এফসি থেকেই নিয়ে এসেছে তারা। চোট সারিয়ে এ মরশুমে ফিরছেন আশিক কুরুনিয়ানও। আর বিশাল কয়েথ, মনবীর সিং, লিস্টন কোলাসো, অনিরুদ্ধ থাপা, শুভাশিস বোস, আশিস রাই, সহাল আব্দুল সামাদরা মোহনবাগানেই রয়েছেন। সব মিলিয়ে ভাল ও ভারসাম্যযুক্ত দলই গড়েছে মোহনবাগান। কিন্তু খাতায় কলমে ভাল দল যে সব সময় মাঠেও ভাল খেলবে, তার কোনও মানে নেই। 

প্রাক মরশুম প্রস্তুতি, নতুন কম্বিনেশনের মধ্যে বোঝাপড়া, নতুন কোচের কৌশল, স্টাইলের সঙ্গে খেলোয়াড়দের মানিয়ে নেওয়া, এমন অনেক কিছুর ওপরই নির্ভর করে দলের পারফরম্যান্স। সব দিক দিয়ে কতটা তৈরি হয়ে উঠেছে তারা, তার ইঙ্গিত পাওয়া যাবে শুক্রবার প্রথম ম্যাচেই। চোটের জন্য এই ম্যাচে অনিশ্চিত ম্যাকলারেন। দলের বাকি সবাই ফিট।   

আইএসএলের গত চার মরশুমেই সফল মুম্বই সিটি এফসি শিবিরেও এ বার অনেকেই নতুন, যাদের সঙ্গে নতুন করে বোঝাপড়া গড়ে তুলতে হচ্ছে কোচ পিটার ক্রাতকিকে। গতবার মরশুমের মাঝখানে দলে যোগ দেওয়া ক্রাতকি এ বারই প্রথম পুরো মরশুমের জন্য দল সামলাবেন। 

গত মরশুমের অধিানায়ক রাহুল ভেকে, মিডফিল্ডার আপুইয়া, আলবার্তো নগুয়েরা, স্ট্রাইকার জর্জ পেরেইরা দিয়াজদের মতো তারকারা এ বার মুম্বই শিবিরে নেই। তাঁদের জায়গায় ব্র্যান্ডন ফার্নান্ডেজ, জেরেমি মানজোরো, জন টোরাল, টিপি রেহনেশ, নিকোলাওস কারেলিস, হিতেশ শর্মা, সাহিল পানওয়াররা যোগ দিয়েছেন আরব সাগর পাড়ের দলে। 

গোলকিপারের জায়গা নিয়ে যেমন রেহনেশ ও ফুর্বা লাচেনপার মধ্যে প্রতিযোগিতা রয়েছে, তেমন প্রথম এগারোয় রক্ষণ ও মাঝমাঠের প্রহরীদের বাছতে বেশ বেগ পেতে হবে ক্রাতকিকে। তবে আক্রমণে লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতে, বিক্রম প্রতাপ সিং ও বিপিন সিং অবধারিত বাছাই। নবাগত গ্রিক স্ট্রাইকার নিকোলাওস কারেলিসের সঙ্গে তাঁরা কতটা বোঝাপড়া তৈরি করেছেন, তার ইঙ্গিতই পাওয়া যাবে শুক্রবারের ম্যাচে। 

দিয়াজের স্থান পূরণ করার জন্য এই কারেলিসকে নিয়ে এসেছে মুম্বই। ইউরোপের বিভিন্ন লিগে খেলার অভিজ্ঞতা আছে এই সেন্টার-ফরোয়ার্ডের। ৩৬১টি পেশাদার ম্যাচে ১০৩টি গোল আছে তাঁর। ২০২২-২৩ মরশুমে পানেটোলিকোসের হয়ে খেলার সময় মরশুমের সেরা ফুটবলারের পুরস্কার জিতেছিলেন। এছাড়া, উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের বাছাই পর্ব ও উয়েফা ইউরোপা লিগে গোল গোল করার কৃতিত্বও রয়েছে এই ফুটবলারের। এই চার সদস্যের আক্রমণ বিভাগ মুম্বইকে কতটা ভয়ঙ্কর করে তুলতে পারে, সেটাই দেখার। 

পরিসংখ্যান বলছে 

ইন্ডিয়ান সুপার লিগের শেষ আটটি হোম ম্যাচের প্রতিটিতে গোল করেছে মোহনবাগান এসজি। এর মধ্যে সাতটিতে অন্তত দুগোল করেছে তারা। এই নিয়ে তৃতীয়বার আইএসএল মরশুমের প্রথম ম্যাচ খেলছে মোহনবাগান। এই তিন ম্যাচের মধ্যে দুবারই জিতেছে তারা, দুবারই কেরালা ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে। লিগে গোল হজম করার সেঞ্চুরি থেকে আর মাত্র দুগোল দূরে তারা। এর আগে আরও ১৩টি দল একশো বা তার বেশি গোল হজম করেছে এই লিগে। এ পর্যন্ত ৯৪ ম্যাচে ৯৮ গোল খেয়েছে সবুজ-মেরুন বাহিনী। এই ম্যাচে মোহনবাগান এসজি জিতলে তাদের গোলকিপার বিশাল কয়েথের এটি ৫০তম জয় হবে। অমরিন্দর সিং (৭৭) ও গুরপ্রীত সিং সান্ধুর (৬১) তিনিই হবেন ৫০টি আইএসএল ম্যাচে জয়ী তৃতীয় গোলকিপার।

মুম্বই সিটি এফসি তাদের শেষ ১৩টি আইএসএল-ম্যাচের মধ্যে মাত্র একটিতে হেরেছে ও একটিতে ড্র করেছে। বাকি ১১টি ম্যাচেই জয় পেয়েছে তারা। একমাত্র হারটি তারা মোহনবাগানের কাছেই হারে, এ বছর ১৫ এপ্রিল, ১-২-এ। এ পর্যন্ত মোট ৬৬টি আইএসএল ম্যাচে কোনও গোল খায়নি মুম্বই সিটি এফসি, যা এই লিগের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এই তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা ব্লাস্টার্স ও এফসি গোয়া ৪৮টি করে ম্যাচে ক্লিন শিট বজায় রেখেছে।  

দ্বৈরথের  ইতিহাস

আইএসএলে দুই দল মুখোমুখি হয়েছে ১০বার। তার মধ্যে সাতবার জিতেছে মুম্বই সিটি এফসি। দু’বার ড্র হয়েছে ও একবার জিতেছে মোহনবাগান। আইএসএলে প্রথম মুখোমুখিতে মুম্বই জেতে ১-০ ও ২-০-য়। সে মরশুমে ফাইনালে শেষ মুহূর্তে বিপিন সিংয়ের গোলে মুম্বই জেতে। ২০২১-২২ মরশুমে প্রথম লেগে ৫-১-এ জেতে মুম্বই। দ্বিতীয় লেগে মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে প্রথম ড্র ১-১ করে কলকাতার দল। ২২-২৩ মরশুমেও এই ব্যর্থতার খরা কাটেনি। ফল হয় ২-২। ফিরতি লেগে দুই দলের সাত নম্বর যুদ্ধে ফের ১-০-য় জেতে মুম্বই বাহিনী। গত মরশুমে সবুজ-মেরুন বাহিনীকে ২-১-এ হারায় আরব সাগর পাড়ের ক্লাব। ফিরতি লিগে মুম্বই সিটি এফসি-কে একই ব্যবধানে হারিয়ে প্রথম লিগশিল্ড খেতাব জিতে নেয় কলকাতার দল। তবে ফাইনালে এই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে কাপ জিততে পারেনি তারা। মুম্বই জেতে ৩-১-এ। 

ম্যাচ- মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট বনাম মুম্বই সিটি এফসি 

ভেনু- বিবেকানন্দ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন, কলকাতা 

সময়- ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, সন্ধ্যা ৭.৩০

সরাসরি সম্প্রচার ও স্ট্রিমিং 

স্পোর্টস ১৮-৩- বাংলা, স্পোর্টস ১৮ খেল ও স্পোর্টস ১৮-২- হিন্দি, স্পোর্টস ১৮-১ এসডি ও এইচডি- ইংলিশ;  জিও সিনেমা- বাংলা, হিন্দি, ইংলিশ, মালয়ালাম