নতুন কোচ, নতুন ফুটবলার-সহ নতুন উদ্যমে এ বার হিরো ইন্ডিয়ান সুপার লিগে নামতে চলেছে এসসি ইস্টবেঙ্গল। তার প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গিয়েছে জোর কদমে। এ বার যেমন কোচ বদল হয়েছে দলে, রবি ফাউলারের জায়গায় কোচের দায়িত্ব নিয়েছেন হোসে মানুয়েল দিয়াজ, তেমনই গত বার যে বিদেশিরা লাল-হলুদ জার্সি গায়ে খেলেছিলেন, এ বার তারা কেউই নেই। সম্পুর্ণ নতুন বিদেশি ব্রিগেড নিয়ে নামছে দিয়াজের এসসি ইস্টবেঙ্গল।

স্লোভেনিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ক্রোয়েশিয়া থেকে যেমন ফুটবলার যোগ দিয়েছেন কলকাতার দলে, তেমনই নাইজেরিয়ান ছোঁয়াও থাকবে তাদের পারফরম্যান্সে। কে কেমন, সে তো মাঠে না নামলে বোঝার উপায় নেই। তবে তাঁদের মধ্যে একজন এ বার হিরো আইএসএলে চমক দিতে পারেন, বলে মনে করেন দলের নবাগত তারকা গোলকিপার অরিন্দম ভট্টাচার্য। যিনি সেপ্টেম্বরেই এটিকে মোহনবাগান থেকে তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দী শিবিরে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।   

গত দুই মরশুমে অসাধারণ পারফরম্যান্সের পরে ফুটবলমহলে অরিন্দমের সবুজ-মেরুন শিবিরে থাকা নিয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না। কিন্তু অরিন্দম এই সিদ্ধান্ত নেওয়ায় অনেকেই হতাশ হয়েছেন। গত হিরো আইএসএল ফাইনালে মুম্বই সিটি এফসি-র কাছে এটিকে মোহনবাগান হারলেও তাদের গোলকিপার মুম্বইয়ের অমরিন্দর সিংকে পিছনে ফেলে গোল্ডেন গ্লাভের দৌড়ে এক নম্বরে ছিলেন অরিন্দম। আসলে এই বছর অমরিন্দর এটিকে মোহনবাগানে যোগ দেওয়ার পরে ছবিটা পাল্টাতে শুরু করে।

লিগের দুই সেরা গোলকিপারের একই দলে থাকা নিয়ে দেশের ফুটবল মহলে অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাদের সন্দেহই সঠিক বলে প্রমাণিত হয়। আগামী ২৭ নভেম্বর দুই চিরপ্রতিদ্বন্দী ক্লাব যখন মুখোমুখি হবে, তখন সেই কলকাতা ডার্বির অন্যতম আকর্ষণের বিষয় হয়ে উঠবে অরিন্দম ও অমরিন্দরের দ্বৈরথ।

কেন শিবির বদল?

অরিন্দম অবশ্য সবুজ-মেরুন শিবির ছেড়ে তাদের ‘শত্রু শিবির’-এ যোগ দেওয়ার অন্য কারণ জানিয়েছেন। indiansuperleague.com-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “সবাই জানে যে, এটিকে মোহনবাগান ছাড়ার সিদ্ধান্ত আমি একটু দেরিতেই নিই। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে আমার হাতে দু-তিনটে প্রস্তাব ছিল। আমি একটু ধন্দে ছিলাম। শেষে আমি আমার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলি। আমার বাবা-ঠাকুরদারা বরাবরই ইস্টবেঙ্গল সমর্থক। শেষ পর্যন্ত এই আবেগই আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। আমার এই সিদ্ধান্তে ওঁরা খুশি হবেন বুঝেই আমি এসসি ইস্টবেঙ্গলে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ১৬ বছর পেশাদার ফুটবলে থাকলেও কখনও ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের জার্সি পরার সুযোগ পাইনি। তাই এ বারে সুযোগটা পেয়ে আর হাতছাড়া করিনি”।

২০১৮-১৯ মরশুমের আগে অরিন্দম মুম্বই সিটি এফসি থেকে এটিকে এফসি-তে যোগ দেন । সেই বছর থেকেই কলকাতার দলের এক নম্বর গোলকিপার তিনি। ২০১৯-২০ মরশুমে চ্যাম্পিয়ন এটিকে দলের সদস্য ছিলেন। গত মরশুমেও অসাধারণ পারফরম্যান্স দেখান ও টানা দ্বিতীয় বার হিরো আইএসএল ফাইনালে খেলেন। ২৩ ম্যাচে ৫৯টি সেভ ছিল তাঁর। ১৯টি গোল খান। গত বছর লিগ পর্বে এটিকে মোহনবাগান সবচেয়ে কম গোল (১৬) খায়। 

তার আগের মরশুমেও ২০ ম্যাচে ৫৩টি সেভ করেছিলেন ও ১৭টি গোল খেয়েছিলেন অরিন্দম। টানা দুই মরশুমে ফুটবল জীবনের অন্যতম সেরা সময়ের মধ্যে দিয়ে যান তিনি। কিন্তু এই মরশুমে হিরো আইএসএলের আর এক সেরা গোলকিপার অমরিন্দর সিংকে নিয়ে আসে এটিকে মোহনবাগান। অগস্টে এএফসি কাপের গ্রুপ পর্বের তিনটি ম্যাচেই রিজার্ভ বেঞ্চে বসে কাটাতে হয় অরিন্দমকে। তার পরই দেশে ফিরে এটিকে মোহনবাগান ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

প্রথম খেতাবের স্মৃতি

প্রথম হিরো আইএসএল খেতাব জয় যে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে তাঁর কাছে, তা জানিয়ে অরিন্দম এই একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, “দারুন অনুভূতি। খুব হার্ড ট্রেনিং করেছিলাম আমরা। নতুন দল, বিদেশিরা নতুন, নতুন কোচ। তবু সবাই সবার সঙ্গে দারুন ভাবে মানিয়ে নিয়েছিলাম। আমার কাছে এটা ছিল স্পেশ্যাল। কারণ, ওটাই আমার প্রথম আইএসএল ট্রফি। এ বার আরও একটা ট্রফি জিততে চাই”।

সে বার ফাইনালে ২-০ এগিয়ে যাওয়ার পরেও চেন্নাইন এফসি-র তারকা ফুটবলার নেরিয়ুস ভাল্সকিস একটি গোল শোধ করে দেন। শেষে এটিকে এফসি ৩-১ গোলে জেতে। সেই ফাইনালের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অরিন্দম বলেন, “সে বার চেন্নাইনের বিরুদ্ধে আমরা ঘরের মাঠে হেরেছিলাম। ড্রেসিং রুমে ফিরে আমরা আলোচনা করি, ঘরের মাঠে এই হারটা মেনে নেওয়া যায় না। এর পর চেন্নাইনকে মাঠে পেলে হারাতেই হবে। ফাইনালেই ওদের পাই। আমরা যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে নেমেছিলাম সেই ম্যাচে। ৬৯ মিনিটে গোল খেলেও আমরা জানতাম ম্যাচের রাশ আমাদের হাতেই আছে এবং শেষ পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই থাকবে। শেষ পর্যন্ত সেটাই হয়, আমরা জিতি”।

সে বার তাঁকে ফাইনালের নায়ক আখ্যা দেওয়া হলেও তার দাবিদার তিনি একা ছিলেন না বলে জানান দেশের অন্যতম সেরা গোলকিপার। বলেন, “সেই ফাইনালে আমাকে ম্যাচের সেরা বাছতে দিলে আমি হাভিকে (হাভিয়ে হার্নান্ডেজ) বাছতাম। আমাদের খেতাবটা যুগ্মভাবে দিলে বোধহয় ভাল হত। কারণ, হাভি দু’টো দুর্দান্ত গোল করে সেই ম্যাচে। সারা ম্যাচে ও দুর্দান্ত খেলেওছিল”।

সাফল্যের রহস্য

গত মরশুমে লিগের সেরা গোলকিপারের খেতাব পেয়েও তা উপভোগ করতে পারেননি ফাইনালে দলের হারের জন্য। নিজের মনের এই কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “গত বার গোল্ডেন গ্লাভের চেয়েও চ্যাম্পিয়নের ট্রফিটা আমার কাছে বেশি জরুরি ছিল। কারণ, আমরা ফুটবলাররা নিজেদের জন্য যত না খাটি, তার চেয়ে বেশি পরিশ্রম করি দলের জন্য। তাই দল সফল না হওয়ায় গোল্ডেন গ্লাভের আনন্দ উপভোগ করতে পারিনি”।

কী ভাবে সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন, তা জানতে চাইলে অরিন্দম বলেন, “ম্যাচের আগে সারা সপ্তাহ পরিশ্রম করলে ম্যাচটা অনেক সোজা হয়ে যায়। আমি প্রতিটা দিন ধরে ধরে প্রস্তুতি নিই। প্রতিটা ছোটখাটো ব্যাপার, যেমন খাবার, হাইড্রেশন, বিশ্রাম এ সবের দিকেও নজর রাখি। পরিশ্রমের পাশাপাশি এই ছোট ছোট ব্যাপারগুলো আমাকে খুব সাহায্য করে”।

নতুন মরশুম, নতুন ক্লাব। তবে লক্ষ্য একই বলে জানালেন তারকা গোলকিপার। বলেন, “প্রথম লক্ষ্য সেমিফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করা। তার পরে ফাইনাল এবং অবশ্যই চ্যাম্পিয়ন হওয়া। তবে আমাদের প্রতি ম্যাচ ধরে ধরে এগোতে হবে। আমরা নতুন (খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া) দল। আমাদের আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে হবে। নিজেদের মধ্যে ভাল বোঝাপড়া তৈরি করতে হবে। তার জন্য প্রতি ম্যাচ ধরে এগোনোই ভাল। কিন্তু আসল লক্ষ্য চ্যাম্পিয়ন হওয়া”।

জৈব সুরক্ষা বলয় নিয়ে অনেকে অসুবিধার কথা জানালেও অরিন্দমের তেমন কোনও সমস্যা নেই বলে জানান। বলেন, “সত্যি বলতে, গত বছর এই বলয়ে থাকাটা আমরা খুব উপভোগ করেছিলাম। কারণ, আমরা সবাই মিলে খুব ভাল সময় কাটিয়েছিলাম এই বলয়ে থেকে, কোনও সমস্যা হয়নি। শুরুর দিকে কোয়ারান্টাইনের সময় খারাপ লেগেছিল। কিন্তু তার পরে যখন সবাই এক জায়গায় হওয়ার সুযোগ পেলাম, একসঙ্গে খাওয়া, একসঙ্গে সিনেমা দেখা, খুব ভাল ভাবে সময় কাটিয়েছি সবাই। গোটা দলের একসঙ্গে থাকাটা খুব ভাল অভিজ্ঞতা”।

সারপ্রাইজ প্যাকেজ

তা হলে যে চমকের কথা বলছিলেন, তিনি কে? অনুশীলনে সবাইকে পিছন থেকে দেখা গোলপ্রহরী বলেন, “এ বারের আইএসএলে বড় চমক হতে পারে চিমা (ড্যানিয়েল চিমা চুকুউ)। ও যদি পরিবেশের সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নিতে পারে, তা হলে সবচেয়ে বড় চমক হয়ে উঠতে পারে। আমি ওকে যতটুকু দেখেছি আর আইএসএল নিয়ে আমার যতটুকু জ্ঞান রয়েছে, তার ভিত্তিতে বলতে পারি, ও খুবই ভাল ফুটবলার ও খেলাটা বোঝেও খুব ভাল। ও এ বারের লিগে একটা বড় ‘সারপ্রাইজ প্যাকেজ’ হয়ে উঠতে পারে”।

গত আশির দশকে নাইজিরিয়া থেকে চিমা ওকোরি এসেছিলেন কলকাতার ফুটবলে। তিন বছর তিনি মহমেডান স্পোর্টিংয়ের হয়ে খেলার পরে ইস্টবেঙ্গলে যোগ দেন তিন বছরের জন্য। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ খেলেন মোহনবাগান এসি-র হয়ে। এর পরের চার বছর পর ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাবে খেলার পরে ১৯৯৭-এ ফিরে আসেন মোহনবাগানে ও ১৯৯৯ পর্যন্ত সেই ক্লাবেই খেলেন। কলকাতার তিন প্রধানে হইচই ফেলে দেওয়া সেই স্ট্রাইকারের স্মৃতি উস্কে দিতে আসছেন এই নতুন চিমা। তার আগে অরিন্দমের এই মন্তব্য অবশ্যই আশা জাগাবে সমর্থকদের মনে।

নরওয়ের প্রথম ডিভিশন ক্লাব মোল্ড এফকে-র লিগ চ্যাম্পিয়ন দলে ছিলেন এই চিমা। একবার নয়, তিনবার। ২০১০ থেকে ২০১৫-র মধ্যে দু’বার নরওয়েইয়ান কাপজয়ী মোল্ড দলেও ছিলেন তিনি। ২০১৩-য় সেই ক্লাবের সর্বোচ্চ স্কোরারও হয়েছিলেন ১৩ গোল করে। মোল্ডের প্রথম লিগ জয়ে চিমার গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। ২০১১-য় সেই মরশুমে ২৪ ম্যাচে পাঁচ গোল করেন তিনি। ২০১২-র ইউরোপা লিগে জার্মানির ঐতিহ্যবাহী ক্লাব ভিএফবি স্টুগার্টের বিরুদ্ধে ২-০ জয়ে গোল করে ক্লাবের নায়কের সন্মান পান তিনি। ২০১২-র মরসুমেও মোল্ডের লিগ জয়ে তাঁর পারফরম্যান্স ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

মোল্ড ছাড়াও পোল্যান্ডের ক্লাব লেগিয়া ওয়ারশর হয়েও মাঠে নেমেছেন ৩০ বছর বয়সি এই স্ট্রাইকার। ২০১৭-য় এই পোলিশ ক্লাবে যোগ দিয়ে তাদের হয়ে ন’টি ম্যাচ খেলেন তিনি। এর মধ্যে উয়েফা ইউরোপা লিগ ও উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের বাছাই পর্বের ম্যাচও ছিল। চিনের সুপার লিগ ক্লাব সাংহাই শেনজিন ও হেলঙজিয়াঙ লাভা স্প্রিং ক্লাবের হয়েও খেলেছেন।  গত বছর চিমা দু’বছরের চুক্তিতে যোগ দেন চিনেরই আর এক ক্লাব তাইঝু ইউয়ান্ডায়। এ বার এসেছেন এসসি ইস্টবেঙ্গলে। নতুন চিমাকে নিয়ে আশায় বুক বেঁধে রয়েছেন লাল-হলুদ সমর্থকেরা।